দূর্গম থানা ‘ঢুষমারা’, বাহন একটি ট্রলার

, জাতীয়

আল-আমিন রাজু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-10-13 14:29:28

কুড়িগ্রাম থেকে ফিরে: দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রাম। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলাসহ অন্তত ১৬টি নদ-নদী বেষ্টিত জেলা। সারা বছরই এ জেলার মানুষ বন্যা ও নদী ভাঙনের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকে। ১১টি থানা নিয়ে গঠিত কুড়িগ্রাম জেলায় মূল ভূখণ্ডের পাশাপাশি অন্তত ৪০০টি চর রয়েছে। কোনো চর এতোই দূর্গম যে, কোনো কোনো চরে যেতে দিন পেরিয়ে যায়। নদী পথই এই চরগুলোর একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম। আর এই নদী কেন্দ্রীক মানুষদের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে কাজ করা একটি থানারও একমাত্র বাহন ছোট ট্রলার। নেই কোনো ধরনের যানবাহন। বলছি কুড়িগ্রামের দূর্গম চরাঞ্চলের থানা ঢুষমারা’র কথা। আশ্চর্য হলেও সত্য থানাটি দুটি উপজেলার অর্ন্তভূক্ত।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর দিনভর থানাটির সরেজমিনে গিয়ে উঠে এসেছে জনবলসহ নানা সংকটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার এসব চিত্র।

সরেজমিনে দেখা গেছে, তিন একর একটি জমিতে বাউন্ডারি ঘেরা থানা। পাঁচটি টিনের ঘর ও একটি আধাপাকা ঘরে চলছে কার্যক্রম। সাধারণ এ সব টিনের ঘরে বানানো হয়েছে অস্ত্রগার। আসামিদের জন্য ছোট সেল ও রাখা হয়েছে থানার গুরুত্বপূর্ণ সব কাগজপত্র। এছাড়া এই সকল টিনের ঘরেই থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদের থাকতে হচ্ছে। বাজার করতে কয়েক ঘণ্টার নৌপথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় পাশের রৌমারি উপজেলায়। থানা এলাকায় নেই কোনো সরকারি হাসপাতাল। থানার দেড় কিলোমিটার দূরে একটি স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক। সেখানে নেই চিকিৎসক শুধুমাত্র সাধারণ কিছু ঔষধ ও গর্ভবতী নারীদের অল্প কিছু সেবা ছাড়া মেলে না কিছুই। এক্ষেত্রেও পুলিশ সদস্যদের ভরসা পাশে রৌমারি থানার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। আর জেলা শহরে যেতে হলে তো দিন পেরিয়ে যায়।


থানার ইতিহাস সম্পর্কে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিস্তাপাড়ে গড়ে ওঠা চরের ভাঙা-গড়ার মাঝেই ঢুষমারা থানা ১৯৭৬ সালে প্রথম নৌ থানা হিসেবে যাত্রা করে। এরপর ১৯৮৩ সালে নৌ ও স্থল থানা হিসেবে কাজ শুরু হয়। দীর্ঘদিন একই থানায় নৌপুলিশ ও সাধারণ থানা পুলিশের কার্যক্রম চলমান ছিলো। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ঢুষমারা পূর্ণাঙ্গ থানা হিসেবে যাত্রা করে। তবে ঢাটিয়ার চরের থানার বর্তমান ঠিকানায় আসার আগে এই থানাও তিন বার ভাঙনের শিকার হয়। এমন কি বর্তমান ঠিকানার স্থান ভাঙায় অন্যত্র যেতে হয়েছিল। স্থানীয় এক ব্যক্তি থানার নামে ৬ একর জমি লিখি দিয়েছেন। যার তিন একর দৃশ্যমান হলেও বাকি তিন একর পানির নিচে। এই থানার আওতায় প্রায় ৪৮টি চর রয়েছে। তবে প্রতি বছর এই চরের সংখ্যা কমে বাড়ে। এর কারণ নদী ভাঙন।

থানা সূত্রে জানা গেছে, ঢুষমারা থানার কার্যক্রম একজন পরিদর্শক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)’র নেতৃত্বে মাত্র ১৮ জন জনবল নিয়ে চলছে। দু’জন উপপরিদর্শক (এসআই), তিনজন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ও ১৩ জন কনস্টেবল থানায় দায়িত্ব পালন করছেন। তবে নেই কোনো নারী সদস্য।

থানায় কর্মরত একাধিক পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দূর্গম এই চরাঞ্চলে কোনো ঘটনায় ছুটে যা্ওয়ার জন্য কোনো যানবাহন নেই। পায়ে হাঁটাই একমাত্র ভরসা। আর দ্রুত যেতে স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া উপায় নেই। ছোট একটি ট্রলার থাকলেও সেটি চালানোর জন্য নেই মাঝি। তাই বাধ্য হয়ে অন্য মাঝিদের বাড়ি থেকে ডেকে আনতে হয়।

কোনো ঘটনায় ভুক্তভোগীরা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে সেবা পেতে কল করলেও একই চিত্রের দেখা মিলে। থানা থেকে দূরে হলে অন্যের সহযোগিতা ছাড়া ঘটনাস্থলে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এমন কি নিরাপত্তার জন্য টহলও দিতে হয় পায়ে হেঁটে। থানা এলাকায় পারিবারি ও জমিজমা সংক্রান্ত অভিযোগের সংখ্যাই বেশি। তবে কোনো ঘটনায় নারী অভিযুক্ত বা আসামি আটকেও নিতে হয় সাধারণ মানুষের সহযোগিতা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অথবা সাধারণ গৃহবধূরাই থানার ভরসা। থানায় নারী ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার থাকলেও সেবা দেওয়ার কেউ নেই।


ভোগান্তির আরেক নাম আদালতে সাক্ষী। বিভিন্ন থানায় কর্মরত থাকা অবস্থায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত বা বাদী হন পুলিশ কর্মকর্তারা। সাধারণ নিয়মে এক থানা থেকে আরেক থানায় বদলি হলেও আদালতের নির্দেশে সাক্ষী দিতে যেতে হয়। তবে ঢুষমারা থানায় কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে আদালতে সাক্ষী দেওয়া কিংবা জরুরি প্রয়োজনে জেলা শহর বা অন্য শহরে যেতে পোহাতে হয় ভোগান্তি। একটি সাক্ষী দিয়ে আসা যাওয়ার জন্য অন্তত তিন থেকে চার দিন সময় লেগে যায়। আছে আরও সংকট। চর কেন্দ্রীক অন্যসকল থানার সদস্যরা চর ভাতা পেলেও সেটি থেকেও বঞ্চিত ঢুষামারা থানার সদস্যরা। সদস্যরা বলছেন, চরভাতার কথা বারবার তুলে ধরা হলেও কার্যকর হচ্ছে না।  

চিলমারি উপজেলা ঢুষমারা থানার অষ্টামিরচর ১-৬ নম্বর ওয়ার্ডের দুই বারের নির্বাচিত ইউপি সদস্য মো মকরম আলী। তিনি বলেন, ঢুষমারা থানা অনেক পুরাতন থানা। একটা সময়ে নৌ থানা ছিলো। পরে যৌথ থানা হয়। স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে এটা পূর্ণাঙ্গ থানা হিসেবে রূপ পায়। এই থানা হওয়ার আগে কোনো ঘটনায় মামলা হলে সাধারণ মানুষের চরম ভোগিন্তা পোহাতে হত। রৌমারি কিংবা চিলমারি যেতে হতো। নদী পথে একদিকে ব্যয়বহুল অন্য দিকে অনেক সময় লাগত। তবে বর্তমানে থানা পুলিশ সব সময় আমাদের পাশে আছে। যেকোনো সমস্যায় তাদের আমরা পাশে পাই।

স্থানীয়দের সহযোগিতায় থানাটি টিকে আছে জানিয়ে এই প্রবীণ জনপ্রতিনিধি বলেন, এই থানা বহুবার ভাঙনের শিকার হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে যখন থানা এখানে আসে তখন স্থানীয় এক ব্যক্তি নিজের ছয় একর জমি লিখে দেন। এখানে একটা সময়ে থানা ছিলো কিন্তু ভাঙনের কারণে অবার অন্যত্র চলে যায়। আবার ৬-৭ বছর আগে আসে। থানার এই সব ঘর তৈরি করতে গ্রামের মানুষ চাল ডালসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করেছেন। সবার সহযোগিতায় থানার প্রথম ঘর তৈরি করা হয়।

দেশের এই দূর্গম থানার নানা সমস্যা ও সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার আল আসাদ মোঃ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, এটি একটি চর থানা। স্থানীয় মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে থানাটি স্থাপন করা হয়েছে। থানায় গাড়ি না থাকলেও একটি নৌকা আছে। যাতায়াতের সুবিধার জন্য। আর থানার সংকটের বিষয়টি আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জানা আছে। তবে থানাটি একটি চরের মধ্যে গাড়ি চালানো সুযোগ কম। তবে আমরা একটি স্পিড বোট দেব। আর চর ভাঙার কারণে স্থায়ী ভবন তৈরি করা কঠিন। এ বিষয়ে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি হচ্ছে। ভাঙনের সমস্যা সমাধান হলে ভবন নির্মাণ করা হবে। তবে নামাজের চর বা সাহেবের চরে কিন্তু সুন্দর এবং দৃষ্টিনন্দন একটি তদন্ত কেন্দ্র বা ফাঁড়ি আছে।

জনবল সংকট ও নারী সদস্য না থাকার বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, এই থানায় সাধারণ জনবলের চেয়েও কম সংখ্যক সদস্য কাজ করছে। আর নারী সদস্য না থাকলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আনসার বিডিবি ও গ্রাম পুলিশের সহায়তায় কাজ করা হয়। তারাও অনেক সহযোগিতা করে। আর ভবিষ্যতে নারী সদস্যও সংযুক্ত করা হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর