আমরা অভাবী মানুষ, যেনোই রাইত হেনোই কাইত

ময়মনসিংহ, জাতীয়

রাকিবুল ইসলাম রাকিব, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ), বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 03:15:58

ও খালা, ও চাচি বেইল গেছে গা। যাইয়াম গা। যাই কিছু বেছোইন লইয়্যাইন। মেশিন ভাঙা, সাইকেল ভাঙা, বই-খাতা, পুরান লোহা, নষ্ট ব্যাটারি, টিন ভাঙা, ছিঁড়া জুতা, পেলাস্টিকের মাল যা আছে, লইয়্যা আইন। বাড়ি ঘর পরিষ্কার করোইন, আনাচে-কানাচে কতো কিছু পইড়্যা রইছে। লইয়্যা আইন। সব নগদ টেকা দিয়া কিনবাম, বাকি নাই।

আঞ্চলিক ভাষায় রেকর্ডকৃত এই ছন্দগুলো ভ্যানগাড়িতে মাইক বসিয়ে বাজানো হচ্ছে। আর চালকের আসনে বসে থাকা চল্লিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি ভ্যানগাড়ি নিয়ে ছুটে চলছেন সড়ক ধরে।

শুক্রবার (১২ জানুয়ারি) বিকেলে গৌরীপুর পৌর শহরের ইসলামাবাদ এলাকায় এ দৃশ্য দেখা যায়।

হাতে ইশারা দিলে ভ্যানচালক গাড়ি থামায়। পরিচয় দিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। এ প্রতিনিধিকে তিনি জানান তার নাম সাহাব উদ্দিন (৪৮)। বাড়ি জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের মইন্যাপাড়া গ্রামে। বাবা মৃত মো. সিদ্দিক আকন্দ। পেশায় তিনি একজন ভাঙারি (পরিত্যক্ত জিনিস) ব্যবসায়ী। দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্যানগাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভাঙারির মালামাল সংগ্রহ করেন।

গাড়ি নিয়েই হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা শুরু করেন সাহাব। তিনি জানান, তার বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র বর্গাচাষি। অভাবের কারণে পড়াশোনা হয়নি। তাই জীবিকার তাগিদে ১৫ বছর বয়সেই রিকশা চালানো শুরু করেন সাহাব। কিন্তু এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় রিকশা চালাতে খুব কষ্ট হয়। তাই এই পেশায় এসেছেন।

সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘আমগোর এদিকে অনেক মাইনষ্যে ভাঙারির ব্যবসা করত। হেগোর লগে কথা কইয়্যা জানবার পারি ব্যবসাডায় লাভ মন্দ না। রিকশা চালাইতে খুব কষ্ট হইত তাই এই ব্যবসায় নাইম্যা পড়ছি। পরথম পরথম মাল কিনার সময় মুখে চিৎকার কইর‌্যা ডাকতে গলার মইধ্যে বেদনা করত। তাই আমি ও গেরামের এক পোলা বুদ্ধি কইর‌্যা নিজেরাই ছন্দ মিলাইয়্যা কথা মোবাইলে রেকর্ড কইর‌্যা মাইকে বাজানো শুরু করি। এহন আর কষ্ট হয় না। মাইকের আওয়াজও যায় মেলা দূর।’

কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, সাহাব একবার বাড়ি থেকে ভ্যানগাড়ি নিয়ে বের হলে দুই সপ্তাহের আগে বাড়ি ফেরে না। এই সময়টা তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ভাঙারির মালামাল কেনেন। পরে ময়মনসিংহ শহরে এনে বিক্রি করেন। ঘুরতে ঘুরতে যেখানে রাত হয় সেখানেই ভ্যানগাড়ি রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। ক্ষুধা লাগলে অল্প টাকায় খাবার কিনে খেয়ে নেন।

সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘দুই-তিন দিন হইল আপনেগোর এলাকায় আইছি। লোহা, টিন ভাঙা মাল বিশ টেকা, পেলাস্টিকের মাল দশ টাকা কেজিতে কিনতিছি। পুরান বইখাতাও প্রতি কেজি দশ থেকে ১৫ টাকায় কিনি। হারাদিন ভ্যানগাড়িত কইর‌্যা গেরামে-গঞ্জে ঘুইর‌্যা দুই হাজার টেকার মাল কিনবার পাড়ি। সদরে (ময়মনসিংহ শহর) বেইচ্যা লাভ হয় ৩-৪শ টেকা। হেইডা দিয়াই সংসার চালাই।’

দাম্পত্য জীবনে সাহাবের মা-স্ত্রী ছাড়াও দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে শরীয় হাফেজ হয়েছে কিছুদিন আগে। মেজ মেয়ে শিমুলের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে শাপলা স্থানীয় মাদরাসায় আরবি পড়ে।

এরইমধ্যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। সাহাব এই প্রতিনিধির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন হাতেম আলী রোড এলাকায়। মাইকের ডাক শুনে ব্যাগ ভর্তি প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত জিনিস নিয়ে ভ্যানগাড়ির সামনে আসেন স্থানীয় সাংবাদিক মো রইছ উদ্দিন। জিনিসগুলো পাল্লায় ওজন করে সাহাব বলেন, ‘ভাই দুই কেজি মাল হইছে, এই লন বিশ টাকা।’

রইছ উদ্দিন বলেন, ‘টাকা লাগবে না। এগুলো আপনাকে ফ্রি দেয়া হল। আপনার ব্যতিক্রমী মাইকিং শুনে আমি এখানে এসেছি।’

জবাবে সাহাব বলেন, ‘আমরা অভাবী মানুষ, জীবনে ব্যতিক্রমী বলে কিচ্ছু নাই। যেনোই রাইত, হেনোই কাইত।’ এই বলেই মাইক বাজিয়ে ভ্যানগাড়ি নিয়ে ছুটে চলে সাহাব। অন্ধকার সড়কে ধীরে ধীরে মিলে যেতে থাকে তার মাইকিংয়ের শব্দ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর