কে এই বাউন্ডারি শহীদ

ঢাকা, জাতীয়

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 11:35:12

ভালুকা (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে: বন বিভাগের জমি দখল করতে তিনি সিদ্ধহস্ত। যখনই জমিতে বাউন্ডারি দিয়ে দখলের প্রসঙ্গ আসে, প্রথমেই ডাক পড়ে তার। আবার অনেক সময় তিনি নিজেই লোক ডেকে এনে জমি দখল করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

যে কারণে এখন তার নামই হয়ে গেছে বাউন্ডারি শহীদ। কে এই শহীদ, কী তার পরিচয়? পুরো নাম শহীদুল ইসলাম শহীদ। জন্মসূত্রে গফরগাঁওয়ের বাসিন্দা হলেও হবিরবাড়ি মৌজায় স্থানান্তির হয়ে আসেন। রাজনৈতিক পরিচয় হচ্ছে ভালুকা উপজেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ। এক সময় দৈনিক পাঁচ কেজি গমের বিনিময়ে বন বিভাগের নার্সারীতে কাজ করতেন।

এখন শত কোটি টাকার মালিক। গাড়ি-বাড়ি, বিত্ত-বৈভব সবই এখন তার হাতের মুঠোয়। ভালুকা রেঞ্জ সংলগ্ন এলাকায় আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন। রয়েছে একাধিক খামার ও শিল্প কারখানা। সিডস্টোর বাজারের পুর্বদিকে ২০ বিঘা জমির উপর রয়েছে সুপ্তি সোয়েটার ও সুপ্তি প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং, দক্ষিণ দিকে ১০ বিঘা জমির উপর রয়েছে সুপ্তি ওয়েল লিমিটেড।

কোকাকোলার পশ্চিমে সাত বিঘা জমির উপর রয়েছে তার হাজী এন্টারপ্রাইজ নামে আরসিসি পিলারের কারখানা। জনশ্রুতি আছে ঢাকাতেও তার রয়েছে একাধিক বাড়ি। চলেন কোটি টাকা দামের গাড়িতে।

বন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, নব্বই সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সেই যে শুরু করেছেন, তা এখনও চলছে। নিত্য-নতুন ফন্দিতে বনের জায়গা দখল করে চলেছেন তিনি। তার এক ডাকে কয়েকশ লোক নেমে আসে। দখল প্রক্রিয়ায় মাঠে নেতৃত্ব দেন আমতলী গ্রামের ইন্নুস আলীর ছেলে শাহজাহান। শহীদের কথায় যে কারো মাথা ফাটিয়ে দিতে পারেন। এমন নজীর অনেক রয়েছে।

আরও পড়ুন:

** ১৫৯৯ একর জমির মালিক মল্লিকবাড়ি বন বিট নিজেই ভূমিহীন
*বনের জমি দখলের খেলার নাম ‘ডিমার্কেশন’

স্থানীয়রা বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও ভালুকা চলে বিএনপি নেতা শহীদের আঙ্গুলের ইশারায়। আর টাকা দিয়ে প্রশাসনের লোকের মুখ বন্ধ রেখে অনায়াসে দখল করে নেন বনের জমি। তার কারণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে ময়মনসিংহ বন বিভাগের ভালুকা রেঞ্জ। এরই মধ্যে মল্লিকবাড়ি বন বিটের এক হাজার ৫৯৯ একর জমি পুরোটাই জবরদখলকারিদের ভোগে চলে গেছে। খোদ বিট অফিসার এখন অন্য বিটের আশ্রিত হিসেবে রয়েছেন।

অপর দুইটি বিটের অবস্থাও সংকটাপন্ন। হবিরবাড়ি বিটের প্রায় সাত হাজার ১০ একর জমির মধ্যে চার হাজার ১৪৪ একর জমি শহীদদের ভোগে, কাদিগড় বিটের চার হাজার ৬৮৬ একর জমির মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জমি অর্থাৎ তিন হাজার ৬০ একর জমি অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে গেছে। এই বিটের পারাগাঁও মৌজায় বন বিভাগের জমি ছিলো এক হাজার ৬৪৬ একর ৭২ শতক। এ জমির এক শতকও আর বন বিভাগের দখলে নেই। সবটাই বেদখল হয়ে গেছে।

সোনার চেয়ে দামী হওয়ায় এখানকার জমির দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ভূমিদস্যুরা। সেই লোলুপ দৃষ্টিতে সলতে যুগিয়ে যাচ্ছেন শহীদ। আর এর পেছনে চলে কোটি কোটি টাকার খেলা। শহীদের টাকা ও প্রতিপত্তির কাছে বন বিভাগের লোকজনও অসহায়। অনেকে ভয়ে, আবার কেউ কেউ আখের গোছাতে নিজেকে সপে দিয়েছেন তার হাতে।

সদ্য বিদায়ী একজন ফরেস্টার বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘দিনের বেলা যদি কোনো বনকর্মী তার বিরুদ্ধে কথা বলেন, রাতে সেই কর্মীর ওপর হামলা হয়। মুখে কালো কাপড় বেঁধে হামলা করে কিলঘুষি দিয়ে চলে যায়। দুই একবার রাতের আধারে অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয় দেখানোর ঘটনাও ঘটেছে। যে কারণে শহীদের কথা অনেকেই মুখে আনতে চান না।’

ভালুকার হবিরবাড়িতে বাউন্ডারি শহীদের বাড়ি

ভালুকার বাসিন্দাদের দাবি, ২০০০ সালে ভালুকা থানার শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় উঠেছিলো শহীদের নাম। কিন্তু কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে সব কিছু। শহীদের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে। বনের জমি দখলের পেছনে প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি যুক্ত থাকলেও সংশ্লিষ্টরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে এড়িয়ে গেছেন।

কোনো মামলায় তার নাম ভুল, কোনো মামলায় তার পিতার নাম ভুল, আবার কোনো মামলায় তার ঠিকানা ভুল দেওয়া হয়েছে। কখনও জমির দাগ নম্বরে ভুল করে তাকে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক ঘটনায় তাকে খলনায়ক মনে করা হয়। কিন্তু তিনি থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তার নামে প্রথম মামলা হয় ১৯৯৩-৯৪ সালে (১৯হবি/৪০ ভালু)। ঐ সময়ে আরও গোটা তিনেক মামলা হয়। এরপর ধীরে ধীরে দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেন শহীদ। বদলে যেতে থাকে বনের লোকদের ভূমিকা। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিট অফিসার মুস্তাফিজুল হক (ফরেস্টার) নিজের পিঠ বাঁচাতে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করেন। সবগুলো মামলায় তার নামের ক্ষেত্রে নানান রকম ক্রটি রেখে দেন।

এসব মামলার মধ্যে ২২হবি/৩১ ভালু মামলায় শহীদুল ইসলামের বদলে কৌশলে এস. ইসলাম এবং পিতার নাম আলাউদ্দিনের বদলে আঃ উদ্দিন লেখা হয়। এরপর মামলা নম্বর ২৩হবি/৩২ ভালু একই ভুল করা হয়।

২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৮হবি/৮ভালু মামলায় শহীদের নাম ঠিক লিখলেও পিতার নাম অফিমুদ্দিন লেখা হয়। অনেক মামলায় নানা রকম ভুল করে তাকে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বন বিভাগ।

১৯৯৮ সালে কোরবানি ঈদের দিনে নিজের ঘরে খুন হন ভালুকার আকবর মেম্বার। সেই মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাউন্ডারি শহীদকে। ওই মামলায় বেশ কিছুদিন হাজত খাটতে হয় তাকে। পরে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তার প্রভাব বিস্তার করে মামলা থেকে ছাড় পেয়ে যান। আরও কয়েকটি হত্যাকান্ডের জন্য তাকে সন্দেহ করে ভালুকাবাসী।

বন বিভাগ মনে করে, বাউন্ডারি শহীদ ও সম্প্রতি গজিয়ে ওঠা যুবলীগ নেতা মনিরকে ঠেকানো গেলে বনকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। না হলে মল্লিকবাড়ি বিটের মতো অন্যান্য বিটের জমিও ধীরে ধীরে বেহাত হয়ে যাবে।

ময়মনসিংহ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা একেএম রুহুল আমিন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমি সম্প্রতি  এখানে  যোগদান করেছি। জেলা প্রশাসককেও জিজ্ঞেস করুন, তিনিও হয়তো বাউন্ডারি শহীদের কথা জেনে থাকবেন। তাকে সবাই বাউন্ডারি শহীদ নামেই জানে।’

শহীদের বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। ফোন কল করলেও রিসিভ করেননি। এমনকি এসএমএস দিলেও সাড়া দেননি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর