২০ লাখ টাকার লোকসানেও থামেননি সালমা, এবার হাটে তার ১৪ গরু

, জাতীয়

সীরাত মঞ্জুর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম | 2024-06-15 20:49:30

গরুর প্রতি ভালোবাসার শুরুটা সেই শৈশবেই। জীবনের ৩৪টি বছর পেরিয়ে এলেও সেই ভালোবাসা একটুও কমেনি সালমা খাতুনের। সেই ভালোবাসা থেকেই ২০২০ সালের দিকে বেসরকারি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে কেনন একটি গাভী। শখের বসে পোষা সেই গরুটি কয়েকবছরের মধ্যে জন্ম দেয় দুটি বাছুর। চোখের সামনে দুই বাছুরকে বড় হতে দেখে সালমার মনের মধ্যেও বড় হতে থাকে একটা স্বপ্ন। সেই স্বপ্নটি উদ্যোক্তা হওয়ার। মনের মধ্যে বুনে রাখা সালমার সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু হলো খামার দিয়ে। সেই খামারে বড় করে তোলা ১৪ গরু নিয়ে এবার অদম্য এই নারী ৫৬৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বহুদূরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছুঁটে এসেছেন চট্টগ্রাম নগরীর বিবিরহাট প্রাণীর হাটে।

এক গরু দিয়ে পথ চলা শুরু হওয়া সালমাকে এই পর্যন্ত আসতে নানা ঘাত প্রতিঘাত সইতে হয়েছে। খামার শুরুর পর ২০ লাখ টাকা লোকসান গুনলেও সাহস আর গরুর প্রতি ভালোবাসা তাকে খামার থেকে দূরে সরাতে পারেনি। এবার সেই লোকসান পোষাতে চান সালমা। নিজের হাতে বড় করা ১৪টি গরু তুলে দিতে চান অন্যের হাতে।

ছবি:  আনিসুজ্জামান দুলাল, বার্তা২৪.কম

গত বুধবার সালমা ১৪ গরু নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর এই শতবর্ষী হাটে আসেন। শুক্রবার (১৪ জনু) বিকেলে বিবিরহাটে গিয়ে সালমার দেখা মিলে। দেখা যায়, হাটের মাঝামাঝি একটি সারিতে পুরুষদের পাশাপাশি গরুকে পানি ও ঘাস খাওয়াচ্ছেন সালমা। শুরুতে অনেকেই সালমাকে ক্রেতা মনে করেন। কিন্তু যখন দেখেন সালমা বিক্রেতা, তখন অনেকেই বিস্মিত হন।

গরুর বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে সালমা নিজের উদ্যোক্তা হওয়ার সেই গল্প শোনান বার্তা২৪.কমকে।

কীভাবে, কোথায় থেকে এলেন, কীভাবে এত সাহসী হলেন? এমন সব প্রশ্নে প্রথমে মুখ লুকাতে চাইলেও পরে তিনি খোলেন তার গল্পের ঝুড়ি। বলেন, ‘ছোটকাল থেকেই আমার গরুর প্রতি ভালোবাসা ছিল। সেই ভালোবাসা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে ২০২০ সালের দিকে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটি গরু কিনি। পরে সেটি থেকে আরও দুইটি গরু হয়। এসময় আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। পরে করোনার সময় সেটি ছেড়ে দিই। মাথায় চিন্তা আসে কীভাবে একটি খামার করতে পারি। সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় একটি শাখা থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে আরও ১০ টি গরু নিয়ে খামার শুরু করি। এরপর ২০২২ সালে প্রথম গরুগুলো নিয়ে চট্টগ্রামের এই হাটটিতে এসেছিলাম। তখন সব গরুই ভালো দামে বিক্রি করতে পেরেছি। কিন্তু মাঝখানে আমার ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কারণ খামারে তেমন সময় দিতে পারিনি। তাই সেসময় আমার ২০ লাখ টাকা মত লোকসান দিতে হয়েছে।’

কীভাবে সেই ধকল সামলে উঠেছেন, সেটিও সালমা শুনিয়েছেন। বলেন,‘আমি হাল ছাড়তে চাইনি। নিজের ওপর অগাধ আত্মবিশ্বাস ছিল। সেই আত্মবিশ্বাসের জোরে লোকসানের পর আমি আবার স্থানীয় একটি ব্যাংকের শাখা থেকে ৫ লাখ টাকা ঋণ নিই। আবার গরু লালন-পালন করি। এর মধ্যে আমি ১৪টি গরু নিজের সন্তানের মতো দেখভাল করে এই কোরবানের ঈদের জন্য প্রস্তুত করেছি।’

ছবি:  আনিসুজ্জামান দুলাল, বার্তা২৪.কম

হাটে খুঁটিতে বাঁধা গরুগুলোকে খাবার তুলে দিতে দিতে সালমা তার জীবনের গল্প শোনান প্রতিবেদককে। জানান, জেলা শহরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ স্নাতকে পড়ার সময় ২০১৩ সালে তার প্রথম মেয়ের জন্ম হয়। এর কিছুদিন পর সালমার সঙ্গে তার স্বামীর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। সালমা এসবের মধ্যেও হতাশ না হয়ে নেমে পড়েন জীবন সংগ্রামে। টিকিয়ে রাখেন পড়ালেখা। রাজশাহী কলেজ থেকে ২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নেন। তবে করোনাকালে সেই চাকরিটা বাঁচানো যায়নি। চাকরিটা ছাড়তে হয়। এতেই সালমার মাথায় ঢুকে খামার করার চিন্তা।

এতদূর থেকে এসে নারী হয়ে গরু বিক্রি করছেন, অস্বস্তি লাগছে কিনা-এমন প্রশ্নে একেবারেই নির্ভার সালমা। বলেন, এখানে আমি আগেও এসেছি। তাছাড়া আমার এলাকার অনেক লোক এই হাটে (বিবিরহাট) গরু নিয়ে আসেন। তাই আমিও নিয়ে এসেছি।

নিজে উদ্যোক্তা হয়েছেন, অনেকের করেছেন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও। সেটি ভেবে গর্বে ভরে যাচ্ছে সালমার মন। বলেন, ‘আমার সঙ্গে এখানে গরু দেখভাল করতে আরও দুইজন লোক রেখেছি। তাছাড়া আমার গ্রামে খামারে অনেক মহিলাদের কর্মসংস্থানে ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ওই মহিলারা আমার খামারে কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। এটা কি সবাই পারে! আমি নারী হয়ে অন্যে অসহায় নারীর পাশে দাঁড়াতে পেরেছি-এটা তো গর্বের।’

সালমা ১৪ টি গরু বিক্রি করে এবার ১৬-১৭ লাখ টাকা আয় করতে চান। সেই গরুগুলোকে লালন-পালন করার কথা তুলে ধরে বলেন, আমার দুজন লোক আছে, তারপরও গরুগুলোকে আমি নিজের হাতে খাওয়াই। ভালোবাসি বলেই তো এমন করি। এদের আমি একটু ব্যথা লাগতে দিই না, অসুখ হলে আমি নিজের হাতে অষুধ খাওয়াই। কষ্ট করে বড় করেছি, আশা করছি দামও ভালোই পাব।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর