রিমালে বিধ্বস্ত রেখামারীর বাসিন্দাদের ঈদ বলে কিছু নেই

, জাতীয়

সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-06-17 15:54:46

গত ২৬ মে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত রেখামারী গ্রামবাসীর জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে খরস্রোতা পশুর নদী প্রবল প্লাবনে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দাকোপ উপজেলার অধীন বানিশান্তা ইউনিয়নের রেখামারী গ্রামের ঘরবসতি। তারপরে কেটে গেছে তিন সপ্তাহ। কিন্তু শেষ হয়নি রেখামারীবাসীর ভোগান্তি।

সরেজমিন ঘুরে বার্তা২৪.কমের প্রতিনিধি দেখেছেন লবণাক্ততা-প্রবণ এই এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো তীব্র পানীয়জলের সংকটে ভুগছে। তাদের কাছে পর্যাপ্ত খাবার নেই। নেই পয়ঃনিস্কাশনের ব্যবস্থা। তারা হারিয়েছেন মাথাগোজার ঠাঁইটুকুও। ঘূর্ণিঝড় রিমাল অতিক্রমের তিন সপ্তাহ পরেও পরিস্থিতির নেই সামান্য উন্নতি।

এরই মধ্যে এসেছে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ-উল-আজহা। অথচ ৫৮ বছর বয়সী ইনসান ব্যাপারীর কোনো উৎসাহ নেই তা নিয়ে। রিমালে নিঃস্ব জেলে ইনসান বলেন, “আগে থেকেই আমরা অতি দরিদ্র। আমাদের নিজেদের ঈদ বলে কিছু্ নেই! তবে আগের ঈদে এ গ্রামের পুরুষরা খুলনা শহরে ঘুরে ঘুরে কোরবানির পশুর মাংস সংগ্রহ করতো। কিন্তু এ বছর আমাদের ঘরের মাটির চুলাও তলিয়ে গেছে। কোথায় এবং কিভাবে আমরা মাংস রান্না করব?"

নূর এ আলম

ঘূর্ণিঝড় রিমালে ইনসান ব্যাপারীর ঘরের ছাদ উড়ে গেছে। প্রবল স্রোতে তলিয়ে গেছে তার ঘরের মেঝের মাটি। ভেসে গেছে ঘরের সকল জিনিসপত্র।

ইনসানের মতো, রেখামারী গ্রামের ৬৫টি পরিবার ঘূর্ণিঝড় রিমালে কমবেশি আক্রান্ত হয়েছে। পরিবারগুলো অতি-দরিদ্র এবং সুন্দরবনের মাছ এবং কাঁকড়া আহরণ ছাড়া তাদের বিকল্প আয়ের সংস্থানও নেই। এসব পরিবার যখন ঘূর্ণিঝড় এবং নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দুর্যোগকালীন ত্রাণের প্রাপ্যতা তখন তাদের কাছে মৌলিক চাহিদা পূরণের সমতুল্য। দুর্ভাগ্যক্রমে, ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত রেখামারী গ্রামবাসীর কাছে প্রয়োজনীয় ত্রাণ পৌঁছেনি।

“এখন পর্যন্ত আমাদের দেওয়া হয়েছে ১ কেজি মুড়ি, ১ কেজি চিড়া, আধা লিটার রান্নার তেল এবং আধা কেজি লবণ। গত কয়েকদিন ধরে একটি এনজিও আমাদের এক বেলা খাবার দিয়ে আসছে,” বলেন রেখামারী গ্রামের গৃহবধু রোকসানা বেগম।

নূর এ আলম 

খরস্রোতা পশুর নদীর তীরে দাঁড়িয়ে, ৪৬ বছর বয়সী রোকসানা নদীর তীরে ভেঙ্গে যাওয়া একটি অংশের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন সেখানে তার পরিবারের থাকার একটি ঘর ছিল।

যেদিন ঘূর্ণিঝড় রিমাল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আছড়ে পড়ে সেদিন রোকসানা এবং তার স্বামী নজরুল সিকদার নিজেদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র আগলে রাখতে ঘরের ভিতরেই থেকে যান। যদিও তারা তাদের সন্তানদের পাঠিয়েছিলেন কাছের এই ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে।

“আমাদের বাড়ির গোলপাতার ছাদ ইতিমধ্যেই উড়ে গেছে। নদীর জলের উচ্চতা তখন আমার বুক পর্যন্ত উঠে গেল। আমাদের বিছানাসহ সব জিনিসপত্র জলে ভাসমান। জোয়ারের প্রবল স্রোত যখন বাড়তে থাকলো, তখন আর সেই ঘরে থাকতে পারিনি। সাঁতরে কাছাকাছি এক উঁচু জমিতে গিয়ে আশ্রয় নিই। কারণ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে আর কোন ফাঁকা জায়গা ছিলনা। পরের দিন (২৭শে মে) যখন আমরা এই জায়গায় ফিরে আসি ততক্ষণে আমাদের সহায় সম্বল সব ভেসে গেছে।” এভাবেই রোকসানা সেই কঠিন সময়ের কথা বর্ণনা করছিলেন।

জানালেন, গৃহস্থালীর সামগ্রীর মধ্যে ছিল একটি বিছানা, একটি ৮০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার সিস্টেম, একটি মাটির চুলা এবং একটি আধা-পাকা পায়খানা। সব ভেসে চলে গেছে।

নূর এ আলম 

ঘূর্ণিঝড়ের পরে রোকসানার পরিবারের একটি ৫০০ লিটারের প্লাস্টিকের পানির ট্যাঙ্ক [বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য] খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে একদিন পর কয়েকজন প্রতিবেশী নদীতে ভাসমান অবস্থায় তা উদ্ধার করে। পানির ট্যাঙ্কটি পুনঃস্থাপন করা ব্যয়বহুল। তাই রোকসানার পরিবার সেটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রেখেছে।

বাস্তুহীন রোকসানা তার পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে এখন বাবা আনোয়ার মুন্সীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে আনোয়ারের টিনশেড ঘরের মাটির মেঝেও ভেঙে গিয়েছে। একই সাথে ঘরে থাকা বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখার পাত্রগুলোরও কোন খোঁজ নেই।

যেদিন আমরা আনোয়ারের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, সেদিন সেই আঙ্গিনায় নদীর লবনাক্ত পানি ভর্তি কিছু পুরানো প্লাস্টিকের পাত্র দেখতে পাই।

আনোয়ারের স্ত্রী রাজিয়া বেগম জানালেন যে, এই পানি ব্যবহার করলে হাত পা ও মুখ জ্বালা করে।

তবুও, রেখামারী গ্রামের পরিবারগুলো লবনাক্ত নদীর পানি পাত্রে জমা করে রেখেছে এই মনে করে যে হয়তো কোন সংস্থা তাদের পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে সাহায্য করবে।

এমনিতেই পয়ঃপরিষ্কার এবং কাপড় ধোয়ার জন্য গ্রামবাসী সরাসরি নদীর পানিই ব্যবহার করেন। বর্তমানে তীব্র পানির সংকটে গ্রামবাসীরা, বিশেষ করে নারীরা তাদের ঘর থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি পানি পরিশোধন কেন্দ্র থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন।

নূর এ আলম

“আমাদের পায়খানাটি ভেসে গেছে। এখন আমরা বাঁশের উঁচু মাচা পুরানো কাপড় দিয়ে ঘিরে সেটিকে খোলা পায়খানা হিসেবে ব্যবহার করছি। আমরা এই অসহনীয় নোনা পানি দিয়ে নিজেদের ধুই। আমাদের এই জীবন খুব দুর্বিষহ,” রাজিয়া ব্যাখ্যা করে করে বলেন।

রেখামারী গ্রামের বাসিন্দাদের জীবনে সংকট আরো ঘণীভূত হয়ে পড়ে যখন বন বিভাগ সুন্দরবনে প্রবেশে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। উল্লেখ্য যে সুন্দরবনই এই গ্রামবাসীর আয়ের প্রধান উৎস।

রোকসানা এবং রাজিয়ার মতো গ্রাম্যবধু কুলসুম খাতুন জানান কীভাবে তার পরিবার ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

কোন চিহ্ন অবশিষ্ট না রেখে ঘূর্ণিঝড় রিমাল কুলসুমের নদীর ধারের ঘরটি সম্পূর্ণভাবে ভেসে নিয়ে গেছে। এখন নতুন করে ঘর বানাতে অনেক টাকার প্রয়োজন। অথচ সুন্দরবনে প্রবেশ নিষেধ। টাকাও নেই আয়ের পথও বন্ধ।

“আমার স্বামীর জাইল্যা (জেলেদের) কার্ড না থাকায় আমরা কোন খাদ্য সহায়তা পাইনি। একারণে এখন আমার স্বামী দিনমজুরি দিতে খুলনা শহরে যায়, বললেন ২৬ বছর বয়সী এই গৃহবধু।"

সচরাচর ইউনিয়ন পরিষদই তৃণমূল পর্যায়ে দুর্গত পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করে। রেখামারী গ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে বানিশান্তা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুদেব কুমার রায়কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানালেন, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।

নূর এ আলম

“প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। আমরা ঈদের আগেই সেই চাল বিতরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি,”

ঈদের দুই দিন আগে ১৫ জুন বিকেলে সুদেবের সাথে কথা বার্তা২৪ এর এই প্রতিবেদককের।

তিনি আরও বলেন, রেখামারী গ্রামবাসী অতিদরিদ্র এবং সরকারের পক্ষ থেকে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ত্রাণ পর্যাপ্ত নয়। তিনি এনজিও এবং অন্যান্য সমাজসেবীদের ত্রাণ সহায়তা নিয়ে ঘূর্ণিঝরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে থাকার অনুরোধ জানান ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর