‘বিদেশি পানি’র বন্যা

, জাতীয়

কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-06-18 19:57:43

কানাইঘাটের তালবাড়ি এলাকার ‘চড়া ভাই’ বৃষ্টি ভেঙে পাড়ি দিয়েছেন সুরমা নদী। ‘চড়া ভাই’ মূল নাম নয় তার; তবে এ নামে এলাকায় বেশ পরিচিত। মূল নাম আড়ালে পড়ে গেছে এ নামের আড়ালে, অথবা বলা যায়, কখনো জিগ্যেস করা হয়নি অন্য কোন নামের। ‘চড়া’ বলতে কঠিন মেজাজ কিংবা অতিরিক্ত কিছু নয়, তিনি নরম স্বভাবের, সজ্জন; এবং এ নাম এসেছে নাকি তার চড়ুই পাখি থেকে। এমনটা হেসে-হেসে তিনিও বলেন। লোকজন মায়া করে ‘চড়া ভাই’ নামে ডাকে, দাবি করেন তিনি।

সুরমায় বেশ স্রোত। এমন স্রোতে নৌকার মাঝি কায়দা করে নৌকা চালান। পাড়ের কাছ দিয়ে উজানের দিকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এরপর নদী অতিক্রম করতে ভাসিয়ে দেন স্রোতে। স্রোতের টান আর ইঞ্জিনের শক্তিতে নৌকা এগোয়। এরপর নির্ধারিত ঘাটের কাছাকাছি এসে তীরে ভেড়ান। বৈঠার নৌকা নয় এটা, ইঞ্জিনচালিত বলে এই স্রোতে এখনো মানুষ নদী পাড়ি দিতে পারছে।

আলীনগর ঘাটের নদীর এই পাড়ে বিয়ানীবাজার উপজেলা, অন্য পাড়ে কানাইঘাট। বিয়ানীবাজারের পাড়ের নদীর তীর তুলনামূলক উঁচু। উপচে পানি ঢুকেনি এখনো। তবে কানাইঘাট পাড়ের তীরের অনেক জায়গায় পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। রাস্তাঘাট ডুবিয়েছে, কারো কারো ঘরেও ওঠেছে পানি; এছাড়া বেশিরভাগই আছেন ঝুঁকিতে। মানুষই কেবল নয়, গবাদি পশু, গোলার ধান সব আছে ঝুঁকিতে। গত ক'বছর এমনটা হয়ে পড়েছে নিয়মিত দৃশ্য, যেন নিয়তির লিখন।

‘চড়া ভাই’র ভাষায় এটা ‘বিদেশি পানি’। সত্তরোর্ধ তিনি। অনেক বন্যা দেখেছেন জীবনে, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোর বন্যা তার কাছে যেন অন্যরকম। দুই বছর আগে তার ঘরে পানি ওঠেছিল। এবার এখনই তেমনটা না হলেও লক্ষণ সুবিধার না বলছেন তিনি। বললেন, বিদেশি পানি আর বৃষ্টি বন্ধ না হলে এবারের অবস্থা আগের চাইতে খারাপ নাকি হবে! আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, মেঘ (বৃষ্টি) কমার লক্ষণ নাই। বৃষ্টি সিলেটের নিয়মিত দৃশ্য এখন। টানা বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত। এ কেবল বৃষ্টি নয়, যেন কলসি উপচে পানি পড়া!

‘চড়া ভাই’ নদী পাড়ি দিয়ে নিয়মিত আসেন এ পাড়ে, কাজের সন্ধানে। ছয় সদস্যের সংসার তার। একমাত্র উপার্জনক্ষম তিনি। এই বয়সে দিনমজুরের কাজ করেন। হাসিমাখা মুখ আর মজার ছলে কথা বলেন বলে প্রয়োজন ছাড়াই অনেকেই তাকে দিয়ে কাজ করায়। আধাবেলা কাজ করে বেশিরভাগ সময় মজুরির অর্ধেক নিয়ে তিনি চলেও যান। তার পাড়ের লোকজনের কাছে তার কাজ নাই বলে এখানে আসেন। বন্যা-বৃষ্টি উপেক্ষা করে এবার এসেছেন তিনি কোরবানির মাংসের সন্ধানে। ঈদের দিন কিছু সংগ্রহ করেছেন, ঈদের পরের দিনও কিছু সংগ্রহ করবেন। মায়া করে কেউ কেউ তার জন্যে ফ্রিজে রেখে দেয়, বলেন তিনি।

সেলিম উদ্দিন, বাড়ি-বাড়ি ঘুরে মুরগি বিক্রি করেন। ত্রিশের কোটার যুবক। তার ঘরের বেড়ার কাছাকাছি পানি চলে গেছে। আরেকটু বাড়লে ঘরে ঢুকে পড়বে। পরিবার নিয়ে আছেন ঝুঁকিতে। বললেন, বন্যার সময় এক কষ্ট, আর বন্যার পরে আরেক কষ্ট। বেড়া ধ্বসে পড়ে যায়। তার এলাকা এরইমধ্যে প্লাবিত। নদীর তীর উপচে পানি ঢুকেছে লোকালয়ে। নদীর পাড়ের কোথাও কোথাও কোমর সমান পানি। আছে স্রোতও। সন্তানদের নিয়ে ঝুঁকি আর ভোগান্তির অন্ত নেই। সঙ্গে আছে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তা। ত্রাণ কি পৌঁছেছে কিছু, এমন প্রশ্নে সেলিম উদ্দিনের ভাষ্য—অন্যের সাহায্য সহযোগিতায় বেঁচে থাকা যায় না। দুই-তিন কেজি চাউল আর কয়েক মুঠো ডাইল দিয়ে কি দিন যায়; একদিন দিলে বাকিটা সময় নাই, সব নাকি লোকদেখানো!

উল্লিখিত দুইজন, সামগ্রিক পরিস্থিতির খণ্ড চিত্র। এরা নদী পাড়ি দিয়ে এ পাড়ে এসেছে বলে তাদের মুখ থেকে জানা গেল। এরবাইরে বৃহত্তর একটা শ্রেণির মানুষ আছে সেখানে যারা না পারছে বের হতে, না পারছে কিছু করে নিয়ে যেতে। অনেকেই আছে বিবিধ সামাজিক সীমাবদ্ধতায় কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। নদীর পাড় ঘেঁষে তালবাড়ি-রাজাগঞ্জের বাসিন্দাদের অনেকেই গরিব। অনেক পরিবারে আছে প্রবাসী, তারা অবশ্য সচ্ছল। তারাও প্লাবিত, তবে অন্যদের মতো আর্থিক দুর্দশায় নয় এমন।

গত মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’-এর প্রভাবে যে বন্যা হয়েছিল সিলেটে, সে সময়ও গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জকিগঞ্জের মতো কানাইঘাটও প্লাবিত হয়েছিল। বানের পানি নামতে না নামতেই এবার ফের বন্যা এসেছে। আষাঢ়ের আগ থেকে যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটে, সবচেয়ে বড় কথা উজানে, তাতে এবারের এ বন্যায় দীর্ঘ হচ্ছে। উজান বলতে আমরা বুঝে থাকি ভারতকে। ভারতের পানি বরাক হয়ে সুরমা-কুশিয়ারা দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানিপ্রবাহের এই সময়ে প্লাবনে ঢাকা পড়ে সিলেট বিভাগের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এ পানিকে গণমাধ্যম বলে পাহাড়ি ঢল অথবা উজানের পানি, স্থানীয়দের কাছে এটা ভারতের পানি বা বিদেশি পানি। এজন্যে সিলেটে যত বৃষ্টিই হোক এটাকে স্থানীয়রা বন্যা বলার চাইতে ‘মেঘের পানি’ বলতেই আগ্রহী। চড়া ভাইদের কাছেও এবারের এই পানিও তাই বিদেশি পানি।

সিলেট বিভাগের অনেক উপজেলা এরইমধ্যে বন্যায় প্লাবিত। সিলেট নগরও প্লাবিত, জলাবদ্ধতায়। অতিবৃষ্টির প্রভাবে নগরের বেশিরভাগ এলাকা ঈদের দিনে ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়েছে। সঙ্গে আছে সুরমার পানি বিভিন্ন ছড়া বা খাল দিয়ে নগরে প্রবেশ। কেবল সিলেট শহরই নয়, সুনামগঞ্জ শহরেও পানি প্রবেশ করেছে। ভারি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে ভারতের পানিতে সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটা, চলতি, চেলা, খাসিয়ামারা নদীসহ জেলার সব নদ-নদীর পানি বেড়েছে। এই ঢল ও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে নদীর পানির উচ্চতা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সিলেটের মধ্য দিয়ে যে নদীগুলো প্রবাহিত হয়েছে তার অন্তত তিনটি নদীর ছয়টি পয়েন্টের পানি এরইমধ্যে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে মঙ্গলবার সকালের খবর। এছাড়া যেভাবে প্রতিবার ভারি বৃষ্টিতে নগর যেভাবে ডুবছে তাতে বৃষ্টি সিলেটে ভয়ের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।

সিলেট নগর কেন ডুবছে বারবার—এনিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। দুই বছর আগের বন্যার পর বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, সুরমা নদী ভরাট হওয়ার কারণে বন্যা। বলছিলেন, পানিপ্রবাহের বাধা পাওয়ার কথা। এরপর কয়েকটি জায়গায় নদী খনন কাজের শুরু হয়েছিল, কিন্তু কাজ শেষ হয়নি দুই বছরেও। নগরে জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছিল অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও সংস্কার কাজের দীর্ঘসূত্রিতা এবং পানিপ্রবাহের বাধা থাকার কথা। কারণগুলো কারণ হিসেবেই থেকেছে, উদ্যোগ নেয়নি কেউ। ফলে সিলেটে বৃষ্টি এখন অভিশাপ হয়ে ওঠেছে।

বিদেশি পানির কারণে বন্যায় হয়তো আমাদের কোন হাত নেই, কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, কাজে দীর্ঘসূত্রিতা এবং নদী ভরাটে আমাদের হাত রয়েছে অবশ্যই। হাত রয়েছে উন্নয়নের নামে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টিতেও। এসব আমাদের কাছে যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা, ঠিক ততটা পাচ্ছে না।

সিলেটে বন্যা এখন তাই স্বাভাবিক ঘটনা। বছরে কয় বার ডুবল সিলেট, এটা এখন তেমনই বুঝি এক সংখ্যার হিসাব!

এ সম্পর্কিত আরও খবর