ক্লুলেস হত্যার রহস্য উদঘাটন করলো পিবিআই

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2024-07-03 14:52:31

৮ মাসের চেষ্টার পর ক্লুলেস একটি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। 

জানা গেছে, মাদক ও অনলাইনে জুয়ার টাকা জোগাড় করতে পরিকল্পনা করা হয় ছিনতাইয়ের। এরপর ছিনতাইয়ে বাধার মুখোমুখি হতে হবে না এমন একজনকে নির্বাচন করে আসামিরা।

তারপর বন্ধুরা মিলে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে নির্দিষ্ট সময়ে নির্জন স্থানে ডেকে নেওয়া হয় ভিকটিমকে। বিভিন্ন স্থান ঘুরিয়ে হত্যার উপযুক্ত স্থান খুঁজে হত্যা করা হয় ১৮ বছর বয়েসি তরুণ রবিউল ইসলামকে। ছিনিয়ে নেওয়া হয় তার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাটি।

এ  হত্যায় সরাসরি জড়িত ৩ জন আসামির ২ জনকে এবং বিক্রি চক্র ও রং পরিবর্তন চক্রের ৫ জনসহ মোট ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন)।এ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ১ জন এখনো পলাতক রয়েছে বলে জানা গেছে।

বুধবার (৩ জুলা্ই) রাজধানীর ধানমণ্ডির পিবিআই হেডকোয়ার্টার্সে আয়োজিত ক্লুলেস হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান নরসিংদী জেলার পিবিআই পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত) মো.এনায়েত হোসেন মান্নান।

গ্রেফতাররা হলেন, নাহিদ শেখ (২২), মো. হুমায়ুন (৪০), মো. লিটন খান (৪৫), জুবায়ের হাসান অমি (১৯), শাজিদুল ইসলাম হাসিব (১৯), রাকিবুল (২০) ও জুয়েল (২০)।

ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরে মো.এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর সকালে জানা যায় যে, নরসিংদী জেলার শিবপুর থানা এলাকার সাতপাইকা পাকা রাস্তার পাশে ধানক্ষেতে অজ্ঞাতপরিচয় এক কিশোরের গলাকাটা মরদেহ পড়ে রয়েছে।

খবর পেয়ে নরসিংদী জেলার পিবিআই ও ক্রাইমসিন টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করে। এরপর তথ্যপ্রযুক্তি ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ভিকটিমের পরিচয় শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।

পরবর্তীতে ভিকটিম রবিউল ইসলামের মা বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। গুরুত্ব বিবেচনায় মামলাটি নরসিংদীর পিবিআই গ্রহণ করে। তদন্তকালে ঘটনার সম্ভাব্য কারণ, ঘটনার প্রকৃতি এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সম্ভাব্য আসামিদের শনাক্ত করার বিষয়ে নানান তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। 

ক্লুলেস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে নেমে পিবিআই জানতে পারে যে, নেশার টাকার জোগাড় করতে এই অটোরিকশাটি ছিনতাই করা হয়, ছবি- বার্তা২৪.কম


জানা যায় যে, ভিকটিম একজন অটোরিকশা চালক। আসামিরা নেশার টাকা জোগাড় করতে ভিকটিম রবিউল ইসলামকে হত্যা করে তার ভাড়া করা অটোরিকশাটি নিয়ে যায়। ভিকটিম কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন না। ঘটনাস্থল থেকে সম্ভাব্য যেসব দিকে ছিনতাই করা অটোরিকশাটি নিয়ে যেতে পারে, অনুমান করে সম্ভাব্য ও সন্দেহজনক কিছু অটো গ্যারেজের প্রতি নজরদারি বাড়ানো হয়।

ঘটনার কোনো ক্লু না থাকায় শিবপুর অঞ্চলে যাদের চোরাই অটো বাইক/গাড়ি কেনাবেচার দুর্নাম রয়েছে, তাদের যাচাই করার পর সন্দেহভাজন আসামি রাকিবুলকে (২০) গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে রাকিবুল ঘটনায় সংশ্লিষ্ট অটোরিকশাটি নাহিদের মাধ্যমে বিক্রিতে সহায়তা করেছে বলে জানা যায়। কিন্তু হত্যার বিষয়ে কোনো কথা স্বীকার করেনি সে। রাকিবুলের দেওয়া তথ্যমতে, মো. নাহিদ শেখকে (২২) গ্রেফতার করা হয়।

নাহিদ অটোরিকশাটি বিক্রির কথা স্বীকার করে এবং যে গ্যারেজে বেচাকেনা হয়েছে, তা দূর থেকে শনাক্ত করে দেয়।

এরপর শিবপুর কলেজ গেট এলাকায় এধরনের একটি অটোরিকশা দেখেছে বলে সোর্স জানালে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ওই সব এলাকার একাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে অটোচালককে শনাক্ত করে মো. হুমায়ুনকে (৪০) গ্রেফতার করা হয়।

তার দেওয়া তথ্যমতে, হত্যাকাণ্ডের পরে ছিনতাই করা অটোরিকশাটি গ্যারেজ মালিক আসামি মো. লিটন খাঁনের (৪৫) গ্যারেজ থেকে উদ্ধার করা হয়।

ক্লুলেস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের বর্ণনা দিচ্ছেন পিবিআই কর্মকর্তারা, ছবি- বার্তা২৪.কম


পুলিশ সুপার মো.এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, জানা যায়, অটোরিকশাটি যাতে কেউ চিনতে না পারেন, সে কারণে এর রং ও কিছু পার্টস পরিবর্তন করা হয় এবং তা গ্যারেজ মালিক মো. লিটন খাঁনের কাছে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়

পরে আসামি নাহিদকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এসময় যারা নাহিদের কাছে ছিনতাই করা অটোরিকশাটি নিয়ে এসেছিল তাদের নাম জানা যায়।

তিনি বলেন, হত্যার পর আসামিরা গা ঢাকা দেয়। মামলার ঘটনার তদন্তে তদন্তকারী একাধিক টিম নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ভৈরব, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

তিনি আরো বলেন, হত্যাকারী ২ জনসহ অটোরিকশা কেনাবেচা, রং ও মডেল পরিবর্তন ও সংরক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মোট ৫ জন আসাম নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

তাদের দেওয়া তথ্যমতে জানা যায় যে, ভিকটিম রবিউল হত্যাকাণ্ড ও অটোরিকশা ছিনতাইয়ে প্রত্যেক্ষভাবে জড়িত অমি, নিহাল, হাসিব একই সঙ্গে চলাফেরা করতো। তারা নিয়মিত মাদক সেবন করা ছাড়াও অনলাইনে জুয়া খেলতো। একপর্যায়ে আসামিরা মাদক ও জুয়ার টাকা সংগ্রহের জন্য অটোরিকশা ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে। তারা সহজ-সরল অটোচালক ভিকটিম রবিউল ইসলামকে চিনতো এবং তাকে হত্যা করে অটোরিকশাটি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে।

ঘটনার দিন ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর দুপুর ২টার দিকে আসামি অমি, নিহাল, হাসিব শিবপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ভিকটিম রবিউল ইসলামকে পেয়ে তার অটোরিকশা নিয়ে বিকেল ৪টার দিকে শাজিদুল ইসলাম হাসিবের বাড়ির সামনে থাকতে বলে।

অমি ও নিহাল বিকেল ৪টার আগেই হাসিবের বাড়ির সামনে উপস্থিত হয়। রবিউল ইসলাম বিকেল ৪টার দিকে হাসিবের বাড়ির সামনে এলে অমি, নিহাল, হাসিব ভিকটিম রবিউল ইসলামের অটোরিকশা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে এবং বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা দেয়।

একপর্যায়ে শিবপুর থানার সাতপাইকার ঘটনাস্থলে পৌঁছে ১০ থেকে ১৫ মিনিট আড্ডা দেয়। আড্ডা শেষে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার কথা বলে আসামিদের দুইজন পেছনে এবং একজন সামনের আসনে চালক রবিউল ইসলামের পাশে বসে।

পরে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, গোপনে নিয়ে আসা চাপাতি বের করে এবং আসামি হাসিব ও নেহাল ভিকটিম রবিউলের হাত পা জাপটে ধরে রাখে। এ সময় অমি চাপাতি দিয়ে বেপরোয়াভাবে গলায় কোপাতে থাকে। ঘটনাস্থলেই রবিউলের মৃত্যু নিশ্চিত করে মৃতদেহটি ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে থাকা ধানক্ষেতে ফেলে দিয়ে অটোরিকশাটি নিয়ে চলে যায়।

পরবর্তীতে রাকিব, নাহিদ, জুয়েল ও হুমায়ুন অটোরিকশাটির রং ও মডেল পরিবর্তন করে লিটন মিয়ার কাছে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয়।

মো.এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, আসামি অমির স্বীকারোক্তি মতে নাহিদের চাচাতো ভাই বিশালের বাড়ি থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাপাতিটি উদ্ধার করা হয়েছে। পলাতক আসামি নেহালকে ধরতে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

অটোরিকশা ছিনতাই প্রতিরোধে পরামর্শ পিবিআইয়ের

ভয়ঙ্কর নেশা থেকে জুয়া, ছিনতাই, হত্যা প্রতিরোধে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানান পুলিশ সুপার মো.এনায়েত হোসেন মান্নান। মো.এনায়েত হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অটোরিকশা ছিনতাই করে চালককে হত্যা করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এজন্য তিনি বেশ কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলি হচ্ছে-

ছিনতাই ও হত্যা প্রতিরোধে-
১. প্রতিটি অটোরিকশার ৩ দিকে গ্রিলের তৈরি গেট নির্মাণ করতে হবে।
২. চালকের পাশে কোনো ধরনের যাত্রী তোলা যাবে না।
৩. প্রয়োজনে গাড়িতে জিপিএস ট্রাকার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
এবং
৪. এই সমস্ত গাড়িগুলি রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর