গণপরিবহন শৃঙ্খলার উদ্যোগ কাজে আসছে না

, জাতীয়

রুহুল আমিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,ঢাকা | 2024-10-09 12:26:29

রাজধানীর গুলিস্তান হয়ে মোহাম্মদপুরের দিকে যাচ্ছিলো মালঞ্চ পরিবহনের একটি বাস। পল্টন মোড়ের কাছে সচিবালয় পার হয়ে একটু সামনে আগাতেই পিছনের বাম্পারের এক পাশ খুলে পড়ে যায় রাস্তায়। অন্য পাশটি লেগে থাকায় অনেকটা আধ-ঝুলা বাম্পার নিয়েই চলছিলো গাড়িটি। পিছন থেকে ডাকাডাকিতে সংবিৎ ফিরে পায় চালক। রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে নেমে আসে চালক ও সহকারী, জিআই তার দিয়ে ভাঙা অংশটি বেঁধে আবারও রওনা হয় গন্তব্যের পথে।

এ তো গেলো শুধু একটি বাসের কথা। রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোতে চলাচল করা অধিকাংশ সিটি বাসের দশা এই মালঞ্চের মতই। এক বাস অন্য বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে উঠে যায় বডির রঙ, ভেঙে যায় লুকিং গ্লাস। তবে নির্বিকার গাড়ির চালক, মালিক থেকে যাদের তদারকি করবার কথা সবাই।

এসব লক্কড়-ঝক্কড় রঙচটা বাসে অনেকক্ষেত্রেই থাকে না ইন্ডিকেটর লাইটও। দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে দেখা যায় হেডলাইটসহ গাড়ির বিভিন্ন অংশ। ভাঙা জানালার কাচ, ভাঙা সিট, থাকে না কাভারও। তবুও বীরদর্পে চলে সড়কে। এসব অনিয়ম খালি চোখে দেখা গেলেও আইনের চোখ বাঁধা, তাই ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেও নেই আইনের প্রয়োগ।

সম্প্রতি এসব লক্কড়-ঝক্কড় বাস, ২০ বছরের বেশি পুরোনো বাস ও মিনিবাস এবং ২৫ বছরের বেশি পুরোনো ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান রাস্তা থেকে প্রত্যাহার ও পুরোনো ডিজেল চালিত বাস ও ট্রাকের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার সময় বাধ্যতামূলকভাবে নিঃসরণ পরীক্ষা চালুর অনুরোধ জানিয়ে বিআরটিএকে চিঠি দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

গত রোববার বিআরটিএকে অনুরোধ জানিয়ে এই চিঠি পাঠায় মন্ত্রণালয়টি। তবে এরপর দুই দিন পার হলেও কিছুই না জানার কথা জানান বিআরটিএ রোড সেফটি পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী।

বার্তা২৪.কম থেকে এই চিঠির বিষয়টি জানিয়ে পদক্ষেপের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কবে চিঠি দিয়েছে? আমি এখনো চিঠিটি দেখিনি। তবে ২০ বছরের পুরনো গাড়িকে বিআরটিএ থেকে কোন নবায়ন করা হয় না। এটা আমাদের অনেক আগের সিদ্ধান্ত। অনেক আগে থেকেই আমরা আর ২০ বছরের পুরনো গাড়ির লাইসেন্স নবায়ন করছি না।

তবে বিআরটিএ এসব পুরনো গাড়ির লাইসেন্স নবায়ন না করলেও সড়কে বন্ধ হয়নি চলাচল। নানাজনকে নানাভাবে ম্যানেজ করেই সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব গাড়ি। সড়কে শৃঙ্খলার অভাবে এক কোম্পানির গাড়ির সঙ্গে চলে অন্য গাড়ির প্রতিযোগিতা। এমন বিশৃঙ্খলায় রাস্তায় প্রাণ হারাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষের। এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না বাসের হেলপাররাও।


এনিয়ে গত আওয়ামী লীগ সরকার বার বার নানা উদ্যোগের কথা জানালেও সড়কে তা কোন কাজে আসেনি। বহুবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে লক্কড়-ঝক্কড় এসব বাস সরিয়ে ফেলার, আছে হাইকোর্টের রায়ও কিন্তু কোন এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় এখনো বহাল তবিয়তে আছে এসব বাস, মিনিবাস।

গত বছরের অক্টোবরে সারা দেশে ৫ লাখেরও বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসহীন গাড়ি রয়েছে বলে জানিয়েছিলো বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিআরটিএ হিসাবে সারা দেশে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহনের সংখ্যা ৫৮ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৬ ও ঢাকায় ২০ লাখ ৫১ হাজার ৯৪৫টি।

এ ব্যাপারে গত আওয়ামী লীগ সরকারের সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সড়ক থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি উঠিয়ে নেয়ার জন্য মালিকদের প্রথমে চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত সময় বেধে দিয়েছিলেন। পরবর্তী অল্প সময়ের অজুহাতে তা বাড়িয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করেন। তবে তাতেও কাজের কাজ কিছু হয়নি, সড়ক থেকে ওঠেনি এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ি।

গত ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. মাইনুল হাসান ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সে এক মতবিনিময় সভায় বাস মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে রাজধানীর সড়কের যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ড্রাইভার ও বাস শ্রমিকদের এসব বিষয়ে আরও সচেতনতা ও সাবধানতা অবলম্বন করার কথা জানিয়ে আরও বেশি মনিটরিং ও জবাবদিহির আওতায় আনার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।

এর আগে গত ১০ সেপ্টেম্বর বিকেলে ঢাকার তেজগাঁওয়ে অবস্থিত ডিটিসিএর সভাকক্ষে আয়োজিত ‘গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনয়নে করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায়ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা বাস্তবায়নে কাজ করার কথা জানিয়েছিলেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) নীলিমা আখতার।

সেদিন তিনি সকল অংশীদারদের পরামর্শ অনুযায়ী অতি দ্রুত বাসের রুট পারমিট চালু করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নিয়মিত সকল অংশীজনের সাথে আলোচনা করা, ক্যাপাসিটি বিল্ড আপ করা, ই-টিকিট চালু করা এবং ধীরে ধীরে গণপরিবহন ব্যবস্থাকে অটোমেশনে রূপান্তর করার ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছিলেন।

তবে এতো এতো কাগুজে সিদ্ধান্তের কোন সুফল পাচ্ছে না এসব গণপরিবহনে চড়া সাধারণ মানুষ। গত দুই মাসে রাজধানীতে বেড়েছে যানজট, অনিয়ম-বিশৃঙ্খলায় ত্রাহি অবস্থা গণপরিবহনে চড়া এসব মানুষের। আওয়ামী লীগ সরকার পতনে সড়ক হয়ে পড়েছিলো ট্রাফিক পুলিশ বিহীন। এখন ট্রাফিক পুলিশ ফিরে আসলেও পুরোপুরি সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে থাকা পুলিশের এই ইউনিটটিকে।

এনিয়ে কথা হয় আবু সাইদ নামের এক যাত্রীর সঙ্গে। গুলিস্তান থেকে মিরপুর যাবার উদ্দেশ্যে উঠেছিলেন শিকড় পরিবহন নামের একটি বাসে। বাসের সিটগুলো এতোটাই চাপা যে, বাধ্য হয়ে পা সিটের সামনে থেকে বের করে দুই সারি আসনের মাঝখানের চলাচলের জায়গায় কিছুটা বাঁকা করে রাখেন। তবে শান্তি নেই সেখানেও, যত্রতত্র যাত্রী উঠানামায় একটু পরপরই পা চাপিয়ে রাখতে হচ্ছিলো সিটের সঙ্গে।

আবু সাইদ বলেন, বাসের অবস্থা তো খুবই খারাপ। আমরা খালি চোখেই দেখতেছি, এটি রাস্তায় চলাচল করতে পারে না। এর ফিটনেস থাকার কথা না, কিন্তু পুলিশের সামনেই তো চলতেছে। কেউ তো কিছু বলছে না। জরিমানাও করছে না। তাহলে তো চলবেই। আর আমাদের তো গন্তব্যে যাওয়া লাগবে সুতরাং গাড়ি যত খারাপই হক গাড়িতে উঠা ছাড়া তো আর কোন পথ নেই।

ফার্মগেট থেকে একই বাসে মিরপুর কাজিপাড়া যাবার উদ্দেশ্যে উঠেন ছামিউল হক নামের এক শিক্ষার্থী। পড়াশোনা করেন সরকারি বিজ্ঞান কলেজে। তাই এই রাস্তায় যাতায়াত তার প্রতিদিনের। কাজিপাড়া থেকে মেট্রোরেলে ফার্মগেটে আসতে পারলেও হাঁটতে হয় অনেকটা পথ তাই বাসেই করেন যাতায়াত।

ছামিউল বলেন, বাসে উঠতে গেলে সমস্যা নেই। আপনি যেখানেই হাত উঠাবেন বাস থামিয়ে আপনাকে উঠাবে কিন্তু নামাতে গেলেই ওদের শুরু হয় যত সমস্যা। গাড়ি অনেকটা স্পিডে রেখেই কোন রকম ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার অবস্থা হয়। আবার এতো যাত্রী উঠায় যে, পিছন দিক থেকে কেউ আসতে আসতেই দেখা যাচ্ছে গাড়ি অনেক সামনে চলে গেছে।

যত্রতত্র গাড়ি থামানো, গাড়ির কোন ফিটনেস নাই তারপরেও গাড়ি চালাচ্ছেন কিভাবে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করে এক চালক বলেন, আমাদের মালিক গাড়ি দেয়, আমরা মালিকের গাড়ি চালাই। গাড়ির ফিটনেস, পুলিশ না ধরা এইসব মালিকরাই ম্যানেজ করে। আর এই কদিন তো রাস্তায় কেউ ধরেও নাই। তাই গাড়ি চালাইতে কোন সমস্যা হয় নাই।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তথ্য সম্পাদক কাজী জোবায়ের মাসুদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, সরকার যদি আমাদের ক্ষতিপূরণ দেয়, বাস উঠিয়ে দিতে বলে তাহলে আমরা অবশ্যই বাসগুলো সরিয়ে নেবো।

এনিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, এখন পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়েছে এটি অবশ্যই ভাল। তবে এটার বাস্তবায়ন কতটা হবে সেটাই দেখার বিষয়। আমরা ২০০০ সাল থেকে এসব নানা সরকারি সিদ্ধান্ত দেখে আসছি কিন্তু বাস্তবে কোন কার্যকারিতা থাকে না। বাস্তবে কার্যকর হলে তো ভাল।

তবে বাস উঠানোর আগে বিকল্প ব্যবস্থার পরামর্শ দিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, ঢাকা শহরে যে পরিমাণ ঘনবসতি তাতে করে আপনি যদি রাস্তা থেকে কোন বাস উঠাতে চান তাহলে অবশ্যই বিকল্প ব্যবস্থাও করতে হবে। একটা বাস রাস্তা থেকে উঠালে আরেকটি বাস আপনাকে নামাতে হবে। না হয় যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়বে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর