পাখির চোখে তাকালে মনে হবে সবুজের এক কার্পেট গোটা এলাকায় বিছিয়ে রাখা হয়েছে। চারদিকে উঁচু নিচু পাহাড় আর সবুজের সমারোহ। বান্দরবান জেলার কোন উঁচু স্থান বা ভবন থেকে তাকালে এমন নজরকাড়া দৃশ্য বিমোহিত করবে যে কাউকে। বান্দরবানের লামার মিরিঞ্জা পাহাড় যেন বাংলার ‘ভূ-স্বর্গ’।
মিরিঞ্জা পাহাড় এখন পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা হয়ে উঠেছে। বর্তমান সময়ে এটি এখন ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।
বান্দরবান জেলার দক্ষিণে- লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা, পশ্চিমে- কক্সবাজারের রামু ও চকরিয়া এবং চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা, উত্তরে-বান্দরবানের সুয়ালক ইউনিয়ন, পূর্বে-বান্দরবানের থানছি ও রুমা উপজেলা। রাত হলে মিটমিট করে জ্বলে উঠে সমগ্র এলাকার দূরের আলো গুলো। আলো আঁধারের এমন দৃশ্য কাছে টানে যে কাউকেই।
বান্দরবানে দিনদিন বিকশিত হচ্ছে পর্যটন শিল্প। তরুণ উদ্যোক্তাের হাতে গড়ে উঠছে নতুন নতুন পর্যটন স্পষ্ট। সঠিক প্রচার প্রচারণায় প্রকৃতির অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চায় বান্দরবানের তরুণ উদ্যোক্তারা। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে স্থানীয় তরুণ উদ্যোক্তা এগিয়ে এসে বিনিয়োগ করছে নতুন নতুন পর্যটন স্পটে।
বান্দরবানের পর্যটন শিল্পে নতুনভাবে যোগ হয়েছে বেশ করেকটি পর্যটন স্পট। পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে, লামা উপজেলার মিরিঞ্জা পাহাড়ে গড়ে উঠছে নতুন নতুন রিসোর্ট, কটেজ ও ভিউ পয়েন্ট। মিরিঞ্জা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে দেখা যায় চারিদিকে সবুজে ঘেরা শুধু পাহাড় আর পর্বত। মেঘ ও কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়গুলোর সঙ্গে আকাশের মিতালি যেকোনো পর্যটকের নজর কেড়ে নিবে। বসে বসে বিরক্তহীন দিন-রাত কাটিয়ে দেওয়া যাবে এই পাহাড়ের চূড়ায়। দেখা যাবে লামা ও আলীকদম উপজেলাসহ কক্সবাজার জেলার সুদূরের বিস্তীর্ণ এলাকাসমূহ।
চারিদিকে সবুজ, উঁচু-নিচু পাহাড়। পূর্বদিকে তাকালেই লামা উপজেলা শহর। আরেকটু দূরে তাকালে আলীকদম উপজেলা এবং পশ্চিমে চোখ ফেললেই কক্সবাজার জেলা। রাত হলে দূরের বাতির আলোগুলো মিটমিট করে জ্বলে উঠে। সবই যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি।
মিরিঞ্জা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ৮শ ফুট উঁচুতে অবস্থিত লামা উপজেলার পর্যটন স্পটসমূহে বসে সময়ের ব্যবধানে দেখা যাবে পূর্বদিকের সূর্যোদয় এবং পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়ার দৃশ্য। প্রতি মুহূর্তে ভিন্ন ভিন্ন রক্তিম অবয়ব ধারণ করে এখানের পর্যটন স্পটগুলো।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে ৮৬ কিলোমিটার ও কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা হতে ২৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লামা উপজেলায় মিরিঞ্জা পাহাড়। উপজেলা শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে চকরিয়া-লামা সড়কের পাশে এই মিরিঞ্জা পাহাড় পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান। সেখানে বসবাসরত ম্রো, মারমা, ত্রিপুরাসহ ১১টি ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি দেখার সুযোগও পাওয়া যায় পাহাড়ের আশেপাশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পাড়াগুলো থেকে।
সম্প্রতি নান্দনিক ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর চোখ জুড়ানো সবুজ প্রকৃতি এবং রোমাঞ্চকর লামার মিরিঞ্জা পাহাড় এলাকা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এখানকার প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য ও মেঘ-পাহাড়ের লুকোচুরি খেলা উপভোগ করতে প্রতিদিনই হাজার হাজার সৌন্দর্য পিপাসু পর্যটকের আগমন ঘটছে। এসব পর্যটকদের সেবা দিতে ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে মিরিঞ্জা ভ্যালি , মারাইংছা হীল , সানসেট , মেঘবেলা , ডেঞ্জার হীল , টপ পয়েন্ট ভিউ , চুংদার বক, সবুজ দিগন্ত রিসোর্ট, মারাইংচা ওয়াইল্ডসহ বেশ কয়েকটি রিসোর্ট। এসব রিসোর্টের কর্টেজ , জুম ঘর ও তাবুতে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক রাত্রি যাপন করে প্রকৃতির রূপসুধা উপভোগ করছেন।
মিরিঞ্জা ভ্রমণ শেষে চাইলে পর্যটকরা ঘুরে আসতে পারে লামা শহর থেকে। এখানে লামা পৌরসভা কার্যালয় সংলগ্ন এলাকায় প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে গড়ে উঠেছে তং থমাং রিসোর্ট এন্ড রেস্টুরেন্ট। এসি এবং নন এসি রুম সার্ভিসসহ রয়েছে থাই চাইনিজ ও হরেক রকমের বাংলা খাবারের ব্যবস্থা। কলেজ সংলগ্ন নুনারঝিরি এলাকায় রয়েছে অন্যন্য রিসোর্ট। এখানেও একইভাবে থাকা খাওয়ার সু-ব্যবস্থা রয়েছে। লামা বাজারে থাকা-খাওয়ার জন্য রয়েছে ফুড হিল ও কুটুমবাড়ী রেস্টুরেন্ট এবং আবাসিক হোটেল সী-হীলসহ কয়েকটি হোটেল। এছাড়া রয়েছে সুখিয়া ভ্যালি, রিভার ভিউ, রিভার হীলসহ আরো কয়েকটি রিসোর্ট। লামা বাজার ঘেষে বয়ে গেছে পাহাড় কন্যা স্রোতস্বীনি মাতামুহুরী। চাইলে নৌকা যোগে এ নদী ভ্রমণে যেতে পারেন পর্যটকরা। মাতামুহুরীর বাঁকে বাঁকে প্রকৃতির যে অপার সৌন্দর্য, তা প্রত্যেকটি সৌন্দর্য্য পিপাসু মনকে বিমোহিত করবে।
বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে সহজেই এখানে আসা যায়। ঢাকা থেকে সরাসরি শ্যামলী এন.আর ট্রাভেলস্ এবং হানিফ বাস সার্ভিসে লামা-আলীকদমের গাড়িতে রাতে রওয়ানা দিয়ে ভোরে লামা মিরিঞ্জা এলাকায় নামতে হবে। এছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের চকরিয়া নেমেও যাত্রীবাহী বাস কিংবা জিপে করে আসা যায়। তবে আসার পূর্বে পছন্দের রিসোর্ট বুকিং দিয়ে আসতে হবে।
তিন পার্বত্য জেলা আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতির কারণে প্রায়ই পাহাড় অশান্ত থাকে। তাই অনেক সময় পাহাড়ে পর্যটকদের আগমন বন্ধ রাখেন প্রশাসন। নিরাপত্তা ইস্যুতে গত ১ মাস যখন তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটক আসা-যাওয়া নিষেধাজ্ঞা ছিল, তখনও লামা উপজেলা ছিল উন্মুক্ত। বিশেষ করে লামা সীমান্তবর্তী কোন উপজেলা না হওয়ায় এখানের পরিবেশ থাকে সবসময় শান্ত। কখনো সাম্প্রদায়িক বা জাতিগত দাঙ্গা হয়নি। এ যেন সব ধর্ম ও বর্ণের মিল বন্ধনের চমৎকার উদাহরণ।
সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা পেলে আবারও ঘুরে দাঁড়াবে প্রকৃতির অপার সুন্দর পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প। তাই আতঙ্ক না ছড়িয়ে, সঠিক প্রচার প্রচারণায় প্রকৃতির অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চায় বিনিয়োগকারীরা।
লামা উপজেলার সুখীয়া ভ্যালি স্বত্বাধিকারী মো. জাহেদুল হাসান বলেন, বান্দরবানের জেলা ব্রেন্ডিং পর্যটন। এখানে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আমরা তরুণ উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছি। তাই এ পর্যটন শিল্পকে বাঁচাতে সবারই এগিয়ে আসা উচিত। সবার ইতিবাচক প্রচার প্রচারণা পর্যটন শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মারইংছা হিলের ব্যাবস্থাপক কায়সার আহমেদ টিটু বলেন, লামা উপজেলার মিরিঞ্জা পাহাড়ে পর্যটকদের জন্য কোনো ঝুঁকি নেই। সীমান্তবর্তী উপজেলা না হওয়ায় এখানে কোন আতঙ্কের পরিবেশ নেই। এছাড়া উপজেলা সদর ও থানা খুব কাছে হওয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা চোখে পারার মতো। যে কেউ চাইলে নির্বিঘ্নে মিরিঞ্জা পাহাড়ে ভ্রমণে আসতে পারেন। কম খরচে বান্দরবানে সবচেয়ে ভালো মানের সেবা দিতে আমরা সর্বদা প্রস্তুত।
লামা উপজেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান চৌধুরী বলেন, মিরিঞ্জা পাহাড় একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পানি, বিদ্যুৎ ও রাস্তার ব্যবস্থাসহ পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় টুরিস্ট পুলিশের ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে সমন্বয় ও যোগাযোগ করা হয়েছে। শীঘ্রই এসবের সুফল পাওয়া যাবে।