চট্টগ্রাম: পান্তা ও ইলিশের ঐতিহ্য বহু বছরের। বাঙালির বৈশাখ মানে পান্তা-ইলিশের আয়োজন। কালের আবর্তে ধীরে ধীরে গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এই পান্তা-ইলিশ। কারণ গ্রাম বাংলার প্রত্যেকের ঘরে পান্তা থাকলেও বাজারে ইলিশ নেই। সাগর থেকে জেলেরা ফিরছেন ইলিশ ছাড়া। এখন আর সেভাবে ধরা পড়ছে না ইলিশ মাছ।
চট্টগ্রামের ফিশারিঘাটের সোনালি যান্ত্রিক মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাবুল সরকার বার্তা২৪.কমকে বলেন, ইলিশ জালে ধরা পড়ছে না। এক সময় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়তো, এখন সাগর থেকে ইলিশশূন্য হয়ে ফিরছেন জেলেরা। তাছাড়া অন্য মাছের সাথে সামান্য পরিমাণে ইলিশ পাওয়া গেলেও দাম অনেক চড়া। দুই থেকে তিন হাজার টাকায় পাইকারি বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসার মুমিনুল হক বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বছরের নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত জাটকা ইলিশ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বর্তমানে সাগরে জাটকা বড় হচ্ছে। তাই এ সময়ে জাটকা ইলিশ আহরণ ও বিপণন করলে মৎস্য আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ হবে। জাটকা ইলিশ দিয়ে বর্ষবরণের দিন পান্তা ভাত না খাওয়াই ভালো।
বাঙালির প্রিয় সামুদ্রিক ইলিশ নদীতে ডিম দেওয়ার পর বেড়ে ওঠার সময় হচ্ছে নভেম্বর থেকে মে মাস। এ সময়ে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত ভোলা, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, পটুয়াখালী ও শরীয়তপুর। তাই এসব জেলায় এই সময়ে মাছ ধরা নিষেধ থাকে।
কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই আবার ১৪ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখ। আর তাই এ সময়ে নয় ইঞ্চির চেয়ে ছোট ইলিশ আহরণ ও বিক্রি মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় নিষিদ্ধ করলেও, বন্ধ নেই জাটকা নিধন। বাজারে জাটকা প্রচুর পাওয়া যাচ্ছে। বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর।
তবে ইলিশ দুষ্প্রাপ্য। যে কয়টি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো দাম অত্যধিক। তাই দিয়েই নববর্ষের পান্তা-ইলিশ আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, ‘দেশে খাদ্যের অন্যতম জোগানদাতা গ্রামের কৃষক ও খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ। সাধারণত রাতের খাবার শেষে অবশিষ্ট ভাত সংরক্ষণের জন্য পানি দিয়ে রাখা হয়। পানি দিয়ে সংরক্ষিত এই খাবারই মূলত পান্তা ভাত। কৃষকরা মাঠে কাজ করার সময় এ পান্তা ভাত খায়। দরিদ্রদের এই পান্তা খাওয়া কিন্তু কোনো শখের বিষয় নয়। গ্রামের মানুষ পান্তা ভাত খায় লবণ ও মরিচ মাখিয়ে। হাতের নাগালে পাওয়া যেত বলে বিশেষ দিনে পান্তা ভাতের সাথে ইলিশের আয়োজন থাকতো। এখন ইলিশ না থাকায় মেহনতি মানুষের সেই রেওয়াজ নেই।’
নববর্ষের পান্তা-ইলিশ আয়োজনের সুযোগে অসাধু কিছু ব্যবসায়ী ইলিশের গলাকাটা দাম নিচ্ছে অভিযোগ করে মৎস্য বিশেষজ্ঞ ড. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, পান্তা-ইলিশ খেয়ে আমরা এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের ইলিশের দাম বাড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছি। এদেশে কোনো জিনিসের দাম একবার বেড়ে গেলে তা আর কমানো যায় না। শুধু বাড়তে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে প্রথম এবং জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বিতীয় দফায় ইলিশের প্রজনন মৌসুম। দেশের অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে বর্তমানে জাটকা ইলিশ বিচরণ করছে। এ সময়ে ইলিশ খাওয়ার ধুমের কারণে অসাধু জেলেরা ব্যাপকহারে জাটকা ইলিশ আহরণ করছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশের বংশবৃদ্ধি।’
গবেষণায় দেখা গেছে, নির্বিচারে আহরণের কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ নদী থেকে ধীরে ধীরে ইলিশের পরিমাণ আশংকাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। অপরদিকে, ইলিশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ভারত ও মিয়ানমারে। দেশের ইলিশের জন্য এটি একটি অশনি সংকেত। ইলিশ অভিপ্রায়নকারী মাছ। একবার এদের প্রজনন ক্ষেত্র পরিবর্তন করলে এটা বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইলিশকে বাঁচানোর লক্ষ্য পহেলা বৈশাখে ইলিশ না খাওয়াও পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।