নুসরাতের চলে যাওয়া ও আমাদের দায়বদ্ধতা

ঢাকা, জাতীয়

ঊর্মি মাহবুব, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 02:10:31

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার ছাত্রী ছিল নুসরাত জাহান রাফি। ফুটফুটে ফুলের মতো সুন্দর এক তরুণী। চার ভাইয়ের এক মাত্র বোন ছিল সে। এক কথায় বাবা-মায়ের চোখের মনি। হয়তো অনেক স্বপ্ন ছিল নুসরাতকে ঘিরে তার পরিবারের। কিন্তু নিমিষেই সব শেষ।

গত ২৭ মার্চ ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার কাছে যৌন হয়রানির শিকার হয় নুসরাত। প্রতিবাদও করে সে। এমনকি মামলাও করেছিল। পরবর্তীতে গ্রেফতার করা হয় ওই অধ্যক্ষকে। কিন্তু তার তো নূর উদ্দীনের মতো সাঙ্গ পাঙ্গ আছে! তাহলে কিসের ভয় এই নরপিশাচের?

রুটিন অনুযায়ী গত ৬ এপ্রিল পরীক্ষা দিতে যায় নুসরাত। কিন্তু তার জন্য যে আগে থেকে অপেক্ষা করছে ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয়, সেটা বুঝতে পারেনি সে। নিশাত নামের এক সহপাঠীকে ছাদে মারধর করা হচ্ছে বলে ডেকে নেওয়া হয় নুসরাতকে। সেখানে বোরকা পরিহিত কয়েকজন ‘বহিরাগত’ নুসরাতকে চাপ দেয় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিতে। কিন্তু প্রতিবাদী নুসরাত সাফ জানিয়ে দেয় অন্যায়ের প্রতিবাদ সে করবেই। এরপরই তারা হাত-পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় নুসরাতের শরীরে।

পাষণ্ডদের দেওয়া আগুনে নুসরাতের শরীরের ৭৫ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে হাসপাতালে চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বুধবার (১০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টায় না ফেরার দেশে চলে যায় সে।

এখন প্রশ্ন হলো- এ দায় কার? রাষ্ট্র ও সমাজ কেউই এই দায় এড়াতে পারবে! সিরাজ উদ দৌলা এক সময় জামায়াতের রোকন ছিলেন। পরে তাকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতি, মাদরাসার অর্থ আত্মসাৎ করা, শিশু নির্যাতন, নাশকতার মামলা রয়েছে। কিন্তু তার শাস্তি হয়নি কখনো। বরং তার বলয় বাড়তে থাকে জ্যামিতিক হারে। ছোট ছোট অপরাধ করতে করতে আজ তিনি দাম্ভিক হয়ে উঠেছেন।

এর আগেও সিরাজ উদ দৌলা ও নুর উদ্দীনের মতো পাষণ্ডদের কারণে জীবন দিতে হয়েছে অনেক কিশোরী ও তরুণীকে। কিন্তু অপরাধ ঘটার পর অধিকাংশ দোষী ব্যক্তির বিচার হয়নি। আর হলেও তার বাস্তবায়ন আটকে যায় অজানা নির্দেশে। যদিও ঘটনা ঘটার প্রথম কয়েকদিন আমরা প্রতিবাদ করি, মানববন্ধন করি। তারপর আবার সব ভুলে যাই। হয়তো ভাবি, আমি কেন কথা বলব, আমার তো কিছু হয়নি। কিন্তু মনে রাখা ভালো, আগুন লাগলে তার আঁচ থেকে দেবালয় কিন্তু বাঁচতে পারবে না।

দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, সিরাজ উদ দৌলার মুক্তির জন্য ২৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আন্দোলনে নেমেছেন অনেকে। মিছিলের সামনে দাঁড় করানো হয়েছে নারীদের। কতটা বিবেকহীন হলে এই সমাজের মানুষ এমনটা করতে পারে তা হয়তো সহজেই অনুমান করা যায়।

অন্যদিকে নুসরাতে শরীরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় মামলার পর সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বারবরই ঘটনাটি আত্মহত্যার চেষ্টা বলে দাবি করে। এ কারণে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি’কে সরিয়ে নিয়েছে প্রশাসন। তবে এ ঘটনার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভে ফুঁসছেন সাধারণ মানুষ। সবার দাবি নুসরাতের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক।

অন্যথায় আজ সিরাজ উদ দৌলা, নুর উদ্দীনরা বেঁচে গেলে পরে এমন হাজারো সিরাজ উদ দৌলা তৈরি হবে। ফের ঝলসে যাবে হাজারো নুসরাত। তাই নুসরাতের লড়াইটা ধরে রাখতে হবে এই সমাজকেই। আর নয়তো নুসরাতের পরবর্তী শিকার হতে পারি আমি বা আপনিও।

এ সম্পর্কিত আরও খবর