চট্টগ্রাম: পথচারীদের অসচেতনতা আর পরিবহন চালকদের আইন না মানার কারণে সরকারের একার পক্ষে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে মনে করেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানিয়েছেন, কেবল হাত উঁচিয়ে তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পার হওয়ার সময় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে চালককে দোষ দিলে হবে না। লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ, অযোগ্য, নেশাগ্রস্থ চালকদের হাতে পরিবহন তুলে দেওয়া যাবে না।
বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর নীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) মিলনায়তনে সড়ক নিরাপত্তা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক সেমিনারের আয়োজন করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। অনুষ্ঠানে গণপরিবহনের মালিক, চালক ও সহযোগীরা এসব কথা বলেন।
তবে সেমিনারে ট্রাফিক পুলিশের নানা হয়রানি আর চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠে আসে বারবার। এ নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম জেলা পরিবহন বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অলি আহমেদ বলেন, আমরা চালকদের ওভারলোড, ওভার টেকিং না করতে নিষেধ করেছি। কেবল আমাদের দোষী করা হয়, বিআরটিএ -এর চট্টগ্রাম অফিসের সামনে ১২ কি ১৩ বছরের ছেলে ড্রাইভিং করছে, তারা কোনোদিন গাড়ি থামিয়ে যাচাই-বাছাই করেননি। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান মুরাদপুর, অলংকারে দূরপাল্লার গাড়ি চলাচল করে এমন কোনো টার্মিনাল নেই। যাত্রীদের বিশ্রমাগার নেই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের পরিবহন সেবা দিতে হয়।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সরকার গত বছর সড়ক আইন পাশ করে। এই আইনে চালকদের লাইসেন্স প্রদানের কঠিন শর্ত দেওয়া হয়েছে। অনেক চালক আছে যাদের পড়াশোনা নেই, কিন্তু তারা এই পেশায় দক্ষ। পড়াশোনায় না থাকায় তারা পরীক্ষায় বাতিল হয়ে যাচ্ছে। আমরা বিআরটিএ -এর কাছে অনুরোধ করব, চালকদের লাইসেন্স প্রদান যেন আরও সহজতর করা হয়।
চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে কোনো গাড়ির ডকুমেন্ট নাই, তথ্য হালানাগাদ নেই, ফিটনেস নেই, অদক্ষ চালক, রুট পারমিট না থাকা সত্ত্বেও কেবল টিআই সার্কেলের পুলিশের সাথে চুক্তি করে গাড়িগুলো চলাচল করছে। ২২ সিট রাতারাতি হয়ে যায় ৪০ সিট। মাসে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। উল্টো রং পার্কিং, সংকেত না মানার অজুহাতে বৈধ চালকদের হয়রানি করা হচ্ছে। আমার কাছে এমন অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে, বিগত কয়েক মাসে বৈধ চালকরা সবচেয়ে বেশি হয়রানি আর মামলার শিকার হয়েছেন। অসাধু কিছু ব্যবসায়ীর যোগসাজেশে টিআই পুলিশ এমন রমারমা ব্যবসা আর চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিভাগের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ম্যাজিস্ট্রেট এস এম মনজুরুল হক বলেন, পথচারী এবং চালকরা যদি সচেতন না হোন, বিআরটিএ কেন; সরকারের পক্ষেও সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের জিডিপির দুই শতাংশ চলে যাচ্ছে এই পরিবহন খাতে। ১৮ কোটি মানুষ এর সাথে সম্পৃক্ত। সড়কে শৃঙ্খলা বিষয়টি দেখভালের কথা ট্রাফিক পুলিশের। তারা পারছেন বলে ক্ষণিক সময়ে আমরা দায়িত্ব নেই। দায়িত্বের সময় আমরা প্রশাসন, চালক, সহযোগী এবং পথচারীদের অনিয়ম এবং অসচেতনতা লক্ষ্য করি। তারা অর্থ লেনদেনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন, এমন প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে। মামলা করার সময় নিচ্ছেন দুই হাজার টাকা, স্লিপে লিখছেন দুই শত টাকা! বিশাল পরিমাণ বাণিজ্য হচ্ছে। এমন বাণিজ্য আর ধান্দা বন্ধ করা সম্ভব না হলে সভা-সেমিনারে মুখরোচক আলোচনা করে সড়কে শৃঙ্খলা আসবে না।
তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামকে দেখলে মনে হয়- ফুটপাত দখলের শহর। যে যেভাবে পারছে দখল করে বসে আছে। পথচারী বাধ্য হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। অনেক নারী হাত তুলেই রাস্তা পার হচ্ছেন। কেন তিনি ফুটওভার ব্রিজ, জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করছেন না? এতটুকু ধৈর্য না থাকলে যেকোনো সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতেই পারে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (সার্বিক) মাশহুদুল করিব বলেন, আমরা সব সময় মনে করি- আইন অন্যের জন্য, আমার জন্য নয়। কেবল পরিবহন চালকদের আইন মানতে হবে, একজন নাগরিক হিসেবে আপনি কতটুকু আইন মানছেন? আমরা অতিমাত্রায় অসহিষ্ণুতায় বোধ করি, মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হই। নিজে আত্মহত্যা করছি, পরিবারকে বিপদে ফেলছি। এক্ষেত্রে সবাইকে এক সাথে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে।
সেমিনারে পরিবহন মালিকদের পক্ষ থেকে লাইনেন্স সহজরতর বিষয়টি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে জানানো হবেও বলেও জানান মাশহুদুল। তিনি বলেন, গত বছর সড়ক আইন হলেও এটি এখনও কার্যকর হয়নি। আমরা প্রয়োজনে শ্রমিকদের স্বার্থে অষ্টম পাশ কমিয়ে প্রাইমারি করে দেব। একদম পড়ালেখা না জানলে তিনি স্বাক্ষর এবং রাস্তার সাইনবোর্ড পড়তে পারবেন না।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআরটিএ চট্টগ্রাম জেলা সার্কেলের সহকারী পরিচালক শাহ আলম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিআরটিএ সার্কেল-২ এর সহকারী পরিচালক উসমান সরওয়ার আলম। হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মাসুমও বক্তব্য দেন।