আইন প্রয়োগের দুর্বলতায় বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতন

ঢাকা, জাতীয়

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-24 01:41:46

নারী ও শিশু নির্যাতন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত দেশের কোথাও না কোথাও শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন নারী ও শিশু। তার মধ্যে দুই-একটি ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে। তবে, লোকলজ্জার ভয়ে অধিকাংশই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন রয়েছে। কিন্তু সেই আইনে কতজনকে সাজা দেওয়া সম্ভব হয়েছে তা বলা মুশকিল। কেননা, মামলার শেষ অবধি সাক্ষী, মামলা চালিয়ে যাওয়ার ধৈর্য্য সব হারিয়ে ফেলেন ভুক্তভোগীরা। নারী নির্যাতন দমন আইনে কী আছে, কেনই বা দমন করা যাচ্ছে না- বার্তা২৪.কমের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব বিষয়ে বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ।

সোমবার (২০ মে) বার্তা২৪.কম কার্যালয়ে একান্ত আলাপচারিতায় তুরিন আফরোজ বলেন, আমাদের যথেষ্ট শক্ত আইন রয়েছে। কিন্তু সেই আইনের প্রয়োগ দুর্বলতায় অপরাধীরা বার বার ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। বিস্তারিত আলাপচারিতা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

বার্তা২৪.কম: প্রতিনিয়ত নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলছে। এর কারণ কী?

তুরিন আফরোজ: নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ সব সময়ই ছিল, আছে। নির্যাতন কি আগে হতো না? হতো, কিন্তু তখন এত মিডিয়া ছিল না, এত প্রচারের মাধ্যম ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়া সেই অর্থে দেখতে পেতাম না। এখন নির্যাতনের ঘটনাগুলো নিয়ে অনেক রিপোর্ট হচ্ছে। এখন প্রচার বেশি হওয়ায় মনে হয় যেন নির্যাতন বেড়ে গেছে। তাছাড়া এখন সমাজ পাল্টে গেছে। আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে পরিবার থেকে বড়রা চুপ থাকতে, চেপে যেতে বলত। সামাজিক নিরবতা কাজ করত। কারো ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে বলা হতো, এটা বললে সমাজ থাকবে না, মুখ চেপে সহ্য করে যাও। বিষয়টি এমনভাবে দেখা হত যেন যে ভুক্তভোগী সেই অপরাধটা করেছে। বললেই সবাই তাকে খারাপ মেয়ে ভাববে। ফলে মানুষ জানতে পারত না। সেই ধারণা এখন বদলে গেছে, নারীরা এখন অনেক বেশি প্রতিবাদী। কারো ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে এখন সামনে এসে কথা বলছেন, প্রতিবাদ করছেন। ফলে আমরা জানতে পারছি।

বার্তা২৪.কম কার্যালয়ে তুরিন আফরোজ, ছবি: সৈয়দ মেহেদী 

 

বার্তা২৪.কম: দেশের বিদ্যমান আইনে কি কোনো দুর্বলতা আছে?

তুরিন আফরোজ: আমাদের যথেষ্ট শক্ত আইন আছে। আরো কঠোর আইন করা যেতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে, আইনের প্রয়োগ যদি ঠিকমত না হয়, তাহলে সেই আইন থেকে সমাজ কী উপকার পাবে? আমরা দেখি, আইন প্রয়োগে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যত্য়য় ঘটছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্ষণ মামলা নিচ থেকেই এত দুর্বল হয়ে উপরে পাঠানো হয় যে শেষ পর্যন্ত অপরাধী জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। যে কারণে অপরাধীর শাস্তি হচ্ছে না। যথাযথভাবে আইন প্রয়োগ করা গেলে অপরাধ কমে যাবে। এজন্য খেয়াল রাখতে হবে, ধর্ষণ মামলার তদন্ত প্রতিটি ধাপে যেন কোনো রকম উল্টাপাল্টা করার সুযোগ না পান অপরাধী। এটা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে শাস্তির জায়গাটা কঠোর রয়েছে। এসিড নিক্ষেপের ক্ষেত্রেও অনেক কঠোর আইন রয়েছে, সেখানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়ার বিধান রয়েছে। ভারতে ধর্ষণের মামলায় বড় শাস্তি যাবজ্জীবন, আমাদের এখানে সবার ওপরে- মৃত্যুদণ্ড। কাজেই আইনের দুর্বলতা নেই।

বার্তা২৪.কম: দেশে যত নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তার কতগুলোর বিচার হচ্ছে?

তুরিন আফরোজ: এ ধরনের ঘটনাগুলোতে সাক্ষী পাওয়া খুব কষ্টকর। এটা এমন না যে বড় কোনো বোমা ছুড়ে ফেলা হয়েছে, সবাই দেখেছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন পাবলিক প্লেসে হচ্ছে, গণ পরিবহনে হচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে হচ্ছে। ওই ঘটনার কেউ সাক্ষী হতে চান না। সাক্ষী উপস্থিত করার সীমাবদ্ধতা আছে। যে কারণে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিতের বিষয়টি সেভাবে চোখে পড়ে না।

বার্তা২৪.কম: অনেক জায়গায় কর্মক্ষেত্রে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, এ বিষয়ে আইনে কী আছে?

তুরিন আফরোজ: এ বিষয়ে হাইকোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, কর্মক্ষেত্রে নারী নির্যাতন বিরোধী কমিটি থাকতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীরা কোনো নির্যাতনের শিকার হলে কমিটি রিপোর্ট করবে। সেটা আসলে ঠিকভাবে তদরকি করা হচ্ছে না। এজন্য একদিকে, আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে, সিস্টেম ডেভলপ করতে হবে। এমন ব্যবস্থা চালু করতে হবে যাতে যখন ঘটনা ঘটবে, সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই আটকানো যাবে। পাশাপাশি সামাজিক ও মানসিক মূল্যবোধে পরিবর্তন আনতে হবে। নারী মানেই ভোগ্যপণ্য, শিশু মানেই দুর্বল, তার ওপর নির্যাতন করলে আমরা পার পেয়ে যাব- এমন ধারণা বদলাতে হবে।

বার্তা২৪.কম: নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধের উপায় কী?

তুরিন আফরোজ: আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নারী নির্যাতনের ঘটনা শুনলেই বলতে দেখি, এত মেয়ে থাকতে তাকে কেন নির্যাতন করা হলো? তাকে কেনো ধর্ষণ করা হলো? নিশ্চিয়ই মেয়েটাই খারাপ- এমন ধারণা প্রসূত মানুষের অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। সুতরাং, সব দিক থেকে আমাদের কঠোর মনোভাব দেখাতে হবে। কথা বলতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। প্রতিবাদের ভাষা অত্যন্ত জোরালো হতে হবে।

বার্তা২৪.কম: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে মাদরাসায় কেন বার বার এই ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন?

তুরিন আফরোজ: শুধু মাদরাসাতেই যে ঘটছে তা না। নৈতিক স্খলন হওয়ায় বড় বড় নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এ ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছেন। এটা যে শুধু বাংলাদেশেই হচ্ছে তা না। উন্নত দেশেও দেখা যাচ্ছে, ২০-২৫ বছর পরে কেউ বলছেন যে তিনি এক সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।

বার্তা২৪.কম: নির্যাতিত নারী কোথায় আইনি সহায়তা পাবেন?

তুরিন আফরোজ: প্রথমত, যখন কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হবেন, তখন পাশের থানায় যাবেন। কথা হচ্ছে, কেউ এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হলে আলামত নষ্ট করে দেন। যা বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে কোনো অবস্থাতেই আলামত নষ্ট করা যাবে না। ভুক্তভোগী নিজেকে নির্দোশ প্রমাণের চেষ্টা করে আলামত নষ্ট করে দেন। তাই আইনি সহায়তা পেতে হলে নিজেকেই সজাগ থাকতে হবে।

বার্তা২৪.কম কার্যালয়ে তুরিন আফরোজ, ছবি: সৈয়দ মেহেদী 

 

বার্তা২৪.কম: অপরাধীর কেন সাজা হচ্ছে না?

তুরিন আফরোজ: এখানে দুর্নীতির সুযোগ রয়েছে। দুর্নীতিবাজরা তো রয়েছেনই। তাছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতা, পেশিশক্তি সেখানে কাজ করে। যখন কেউ একজন সরাসরি অপরাধ করছেন, তাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য একটা চক্র প্রস্তুত থাকে। সব কিছু মিলিয়ে দেখা যায়, মামলাগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন কারণে কোথাও না কোথাও চার্জশিটে নাম আসছে না। কাজেই সব মহলকেই সজাগ থাকতে হবে যেন কোথাও দুর্নীতি না হয়। অপরাধীর যেন উপযুক্ত শাস্তি হয়। সবার আগে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, সোচ্চার হতে হবে।

বার্তা২৪.কম: আমাদের দীর্ঘ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

তুরিন আফরোজ: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর