থানা সরেজমিন: সীমাবদ্ধতাকে সঙ্গী করে চলছে আদাবর থানা

  • আল-আমিন রাজু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

ডেটলাইন ২৯ সেপ্টেম্বর, বেলা ১১টা। আদাবর থানা। পরিবেশ অপেক্ষাকৃত শান্ত। এক কিশোরকে দেখা গেলো ডিউটি অফিসারের সামনের লকআপের ভেতর পায়চারি করছে। সকাল ১০টায় তাকে ছাড়ার কথা থাকলেও ছাড়া হয়নি। কারণ তার নামে মামলা হয়েছে। আদালতে পাঠানোর প্রস্তুতি চলেছে। কিশোরটি কিছুটা হৈচৈ করছে।

এক গাড়ি চালক এসেছেন চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় জীবননাশের হুমকি পেয়ে জিডি করতে। তিন তরুণ এসেছে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ নিয়ে। তারা গার্মেন্টস শ্রমিক বলে নিজেদের পরিচয় দেয়। এমনই কিছু ছোট ছোট কাজ নিয়ে থানার পুলিশ কর্মকর্তারা ব্যস্ত। অন্য সদস্যরা থানার বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে। কারো হাতে অস্ত্রসস্ত্র নেই। সকলেই ইউনিফর্মড। দুই-একজনকে সিভিল ড্রেসেও দেখা গেলো।

বিজ্ঞাপন

তবে সার্বিকভাবে নজরে পড়ে, গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর হামলা লুটপাটের শিকার এই থানাটি এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত নয়। বরং কথা বলে জানা গেলো লুট হয়ে যাওয়া অস্ত্র এখনো পুরোপুরি উদ্ধার না হওয়ায় নতুন করে হামলার আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।

গত জুলাইয়ে দেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন যখন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় তখন হাসিনা সরকার গদি রক্ষার স্বার্থে সামনে ঠেলে দেয় পুলিশকেই। আন্দোলন ঠেকানোর নামে জনগণের জানমালের রক্ষক পুলিশ সাধারণের ওপর চড়াও হয়, গুলি চালায় নির্বিচারে। এতে শত শত ছাত্র জনতার প্রাণ যায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পালিয়ে বেঁচেছেন শেখ হাসিনা। তখন ক্ষুব্ধ মানুষ চড়াও হয় পুলিশের উপর। তাদের ক্ষোভের আগুনে পুড়েছে থানা ও পুলিশ বাহিনীর নানা স্থাপনা। বাদ যায় নি পুলিশের সদর দফতরও। দ্রুত অবস্থার অবনতি হওয়ায় জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যায় পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ শুন্য থানায় ক্ষুব্ধ মানুষেরা লুটপাট চালায়। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় দেশের পাঁচ শতাধিক থানা আগুন ও লুটপাটের শিকার হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)’র ২২টি থানা পুড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত থানার মধ্যে রাজধানীর আদাবর থানাটিও ছিলো। সেদিন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে থানাটি রীতিমতো ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছিলো।


অন্তবর্তী সরকারের কার্যক্রম শুরুর সাত দিন পর কাজে ফিরতে শুরু করে পুলিশ। ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করে থানাগুলোও। আদাবরের রিং রোডে ভাড়ায় নেওয়া থানা ভবনটিতে পুলিশ সদস্যরাও ফেরেন। ফিরে দেখেন, তিনটি ফ্লোরে সব কিছুই পুড়ে ছাই হয়ে আছে। পরবর্তীতে ভবন সংস্কার করে থানার কার্যক্রম শুরু হয়। তবে এখনও পরিবহন, লোকবল ও অন্যান্য সরঞ্জামের সংকটে রয়ে গেছে থানাটি।

সরেজমিন গিয়ে সে দৃশ্যই চোখে পড়লো। তবে সরঞ্জাম সংকটের পাশাপাশি উপলব্দি করা যায় পুলিশের মানসিক দুর্বলতার দিকটিও। সারা দেশেই এখন শারীরিক উপস্থিতি থাকলেও পুলিশি কার্যক্রমে অনেকটাই স্থবিরতা স্পষ্ট। আদাবর থানাও তার ব্যতিক্রম নয়।

তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ প্রধানসহ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ সকল পদেই পরিবর্তন এসেছে। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের রদবদল চলমান। আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে থানার বেশির নিম্নপদস্থ সদস্যদের বদলি করা হয়েছে। বাহিনীর ঊর্ধ্বতনরা চাইছেন নতুন দিনে পুলিশ জনগণের বন্ধু হয়ে উঠবে।

কেমন অগ্রগতি হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায়? সেটাই দেখতে এই প্রতিবেদক যান আদাবর থানায়।

প্রধান সড়ক লাগোয়া থানা ভবনের সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলা ডিউটি অফিসারের রুমে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে থানা এসেছেন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী। ডিউটি অফিসের পেছনেই থানার গারদের ভেতর এক কিশোরকে দেখা যায়। ডিউটি অফিসারের কাছে কিশোরটি জানতে চাইছিলো, সকাল ১০টায় তাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা, অথচ ১১টা বেজে গেলেও তাকে কেনো ছাড়া হচ্ছেনা।


ছেলেটি বলছিলো, সকাল থেকে তাকে কিছুই খেতে দেওয়া হয় নি। পুলিশের কেউ অবশ্য তার কথার কোনো উত্তর দিচ্ছিলেন না।

ডিউটি অফিসারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিশোরটির বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। তাকে আদালতে পাঠানো হবে। তারই প্রস্তুতি চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি প্রিজন ভ্যানে তুলে তাকে থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তবে এর আগেই এক পুলিশ সদস্য নিজের পকেটের টাকায় কিশোরটিকে রুটি কলা কিনে খাওয়ান।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ থেকে উত্তরা আব্দুল্লাহপুর রুটে চলাচল করা ভূঁইয়া পরিবহনের একজন বাসচালক এসেছেন চাঁদাবাজি ও প্রাণনাশের হুমকির বিষয়ে অভিযোগ জানাতে। নূরুল ইসলাম নামের এই চালক জানালেন, প্রতিদিন আয়ের একটি অংশে চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদার প্রতিবাদ করায় জীবন শঙ্কায় আছেন। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে গত ২১ অক্টোবর আদাবর থানায় সাধরণ ডায়েরি করেছেন। কিন্তু এরপরেও মেরে ফেলার হুমকি পাচ্ছেন। তাই বিষয়টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জানাতে এসেছেন।

থানার কর্মকর্তা অভিযোগ শুনে সমাধানের আশ্বাস দিলেন। কিন্তু তাতে কতটা আশ্বস্ত হতে পারলেন নুরুল? তিনি বলেন, চাঁদাবাজরা এখন আমাকে গাড়ি চালাতে দিচ্ছে না। আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার নিয়ে বিপদে আছি। পুলিশকে জানিয়েছি। কিন্তু কোনো ফল পাচ্ছি না।

তিন তরুণকে দেখা গেলো থানায় এসেছেন ছিনতাইয়ের অভিযোগ জানাতে। তবে তারা মামলা করতে চান না। ডিউটি অফিসার জানালেন, সাধারণ ডায়েরি (জিডি)তে ছিনতাই কথা লেখার সুযোগ নেই। জিডি করতে হলে লিখতে হবে হারিয়ে গেছে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা শেষে সাধারণ ডায়েরি করেন ভুক্তভোগী দুজন। কথা বলে জানা গেলো, তারা গার্মেন্টস কর্মী। সকাল বেলা অফিসে যাওয়ার পথে আদাবর ১০ নম্বর এলাকায় অস্ত্রের মুখে তাদের দুইজনের মোবাইল ও টাকা পয়সা ছিনতাই করে নিয়ে যায় কয়েকজন অস্ত্রধারী ছিনতাইকারী।

এলাকায় অপরাধ তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে কেমন ব্যবস্থা নেওয়া গেছে? এমন প্রশ্নে এই থানার তরফ থেকে জানানো হয়, মাঠ পর্যায়ে তাদের সক্রিয় অবস্থান এরই মধ্যে অনেকাংশেই নিশ্চিত করা হয়েছে। লোকবল নিয়ে আর প্রশ্ন নেই। তবে লজিস্টিক পুরোপুরি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি বলে, কিছু কিছু কাজ ব্যহত হচ্ছে। আদাবর থানায় বর্তমানে কর্মরত আছেন ২৩ জন উপ-পরিদর্শক (এসআই), ২৭ জন সহকারি উপ-পরিদর্শকসহ (এএসআই) ১০৬ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন।


ডিউটি অফিসার জানালেন, জনবলের সংকট না থাকলেও থানার পরিবহন ও আসবাবপত্রের সংকট রয়েছে। থানার অন্তত পাঁচটি গাড়ি থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে তিনটি গাড়ি দিয়ে চলছে পুলিশি কার্যক্রম। এরমধ্যে একটি গাড়ি নষ্ট।

থানার কার্যক্রম শুরুর পর থেকে বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, চাঁদাবাজি, মারামারি ও মাদক সংশ্লিষ্ট ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসময়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক অভিযোগ, হুমকি ও বিভিন্ন কিছু হারিয়ে যাওয়া অভিযোগে ৭৯২টি সাধারণ ডায়রি (জিডি) জমা পড়েছে এ থানায়।

গত পাঁচ আগস্ট আদাবর থানার অস্ত্রগার ও মালগার থেকে সব কিছুই লুট করে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। চায়না রাইফেল, চায়না এসএমজি ও এলএমজি, ১২ বোর শর্টগান, বন্দুক, রিভলভার, পিস্তলসহ (চায়না/তরাশ/সিজেড) ১৭০টি অস্ত্র লুট হয়ে যায়। এছাড়াও ২৩ টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং শর্ট ও লংরেঞ্জের ১২৪টি টিআরসেল লুট হয়। এসময় বিভিন্ন অস্ত্রের দুই হাজার ৯৯৫ রাউন্ড গুলি লুট হয়। এছাড়াও বিভিন্ন মামলায় থানায় জব্দকৃত মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, ট্রাক ও সিএনজিসহ ৫৫টি যানবাহন এবং থানার ব্যবহৃত ১২টি গাড়ি আগুন ধরিয়ে দেওয়া এবং লুট করা হয়। পুলিশের ব্যবহৃত হ্যান্ডকাফ, বেস্ট, ওয়াকিটকি এবং কম্পিউটার, প্রিন্টার, সিসি ক্যামেরা, ডিবিআর, এসি, দরজা-জানালাসহ প্রায় চার কোটি টাকার সমমূল্যের মালামাল লুট হয়েছে বলে থানা সূত্রে জানা যায়।

পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন তারা জনতার মব ও যেকোনো ধরণের অপ্রিতিকর ঘটনা মোকাবিলা ও আসামি ধরার ক্ষেত্রে সতর্কভাবে কাজ করছেন। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া চেয়ে নিজেদের নিরাপত্তাই আগে দেখছেন মাঠে কাজ করতে যাওয়া পুলিশ সদস্যরা।

নাম প্রকাশে না করা শর্তে একজন উপ-পরিদর্শক জানান, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এখনও নানাভাবে ভয়-ভীতি কাজ করছে। ৫ আগস্ট কেন্দ্র করে থানা থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাট হয়েছে। যা বেশিরভাগই এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে যেকোনো সময় আবারও পুলিশের ওপর হামলার আতঙ্ক রয়েছে। আর সে হামলায় ব্যবহৃত পারে পুলিশেরই লুট হয়ে যাওয়া অস্ত্র।

এলাকায় মাদক ও চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে এমনটা স্বীকার করে নিয়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমরা চেষ্টা করছি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার। তবে এখনও আমাদের অনেক কিছুরই সংকট রয়েছে।

এই প্রতিবেদকের কথা হয় আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজ ইমতিয়াজ ভূঁইয়ার সঙ্গে। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, যানবাহন ও আসবাবপত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনী সামগ্রীর সংকট রয়েছে। বিশেষ করে ডিজিটাল পদ্ধতি এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ হাতে লিখতে হচ্ছে, এমনটা জানিয়ে ওসি মাহফুজ বলেন, আমরা এখন হাতে লেখা অভিযোগ গ্রহণ করছি। পরবর্তীতে সেটিকেই সার্ভারে দেওয়া হচ্ছে। ডিউটি অফিসারের রুমে কম্পিউটার দেওয়া সম্ভব হয় নি। তবে আমাদের ডিসি স্যারের সহযোগিতায় সদর দফতর থেকে রিকুজিশন দিয়ে বিভিন্ন ইক্যুইপমেন্ট আনা হচ্ছে।

লুটপাট ও আগুনের কারণে ফোর্স মেস ধ্বংস হয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, থানার ফোর্সরা এখন ফ্লোরিং করে থাকছেন। তাদের জন্য খাটের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। আশা করি দ্রুতই হয়ে যাবে।

ওসি আরও বলেন, পুলিশ জনগণের বন্ধু। এটা কথায় নয়, আমরা সত্যিকারে বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করছি। পুলিশের সঙ্গে জনগণের সুসম্পর্ক স্থাপনের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। এছাড়াও জনসাধারণের মধ্যে পুলিশের প্রতি ক্ষোভ দূরীকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে।