হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নেই। আছে তার প্রতিষ্ঠিত দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। আছে দলীয় প্রতীক লাঙ্গল। কিন্তু তারপরও এরশাদের দুর্গখ্যাত রংপুরে এখন লাঙ্গল যেন অস্বস্তির প্রতীক। রংপুর-৩ আসনে উপ-নির্বাচনকে ঘিরে দিন দিন গৃহদাহে পোড়া এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টির প্রতি সাধারণ মানুষের আবেগ, ভালোবাসা ও আগ্রহ কমছে। এতে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখে দলটি।
দীর্ঘ ২৮ বছর রংপুরে একচেটিয়া জনসমর্থনে জাতীয় পার্টি ও এরশাদ সর্বোচ্চ মূল্যায়ন পেয়েছে। কিন্তু তার মৃত্যুতে শূন্য এ আসনে এবার ছাড় না দিতে নড়ে চড়ে বসেছেন অন্য দলের নেতারা। মনোনয়ন বঞ্চিত নিজ দলের তৃণমূলের নেতারাও বেশ চটে আছেন।
আর বরাবরের মতো এবারো কাউন্টার অ্যাটাক দিতে প্রস্তুত এরশাদের অভিমানী ভাতিজা সাবেক সংসদ সদস্য আসিফ শাহরিয়ার। এই পরিস্থিতিতে রওশনের ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদের কাঁধে লাঙ্গল তুলে দিয়ে বিপাকে আছেন জাপার কেন্দ্রীয় নেতারা। যদিও মহাজোটের উপর ভর করে অচেনা সাদের জয় নিশ্চিত করতে মরিয়া তারা।
এদিকে সাদ এরশাদের পক্ষে রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টি নীরব থাকলেও মাঠে সরব রয়েছে জেলা কমিটির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। মনোনয়নপত্র সংগ্রহ থেকে শুরু করে জমা দেয়া ও যাচাই-বাছাইয়ে হাতে গোনা নেতাদের দেখা গেছে। তাদের দাবি শেষ পর্যন্ত সাদের পক্ষে মাঠে নামবে সবাই। আর নৌকার প্রার্থী সরে দাঁড়ালে সাদ এরশাদের জয় নিশ্চিত।
অন্যদিকে জাপার অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সরানোর প্রচেষ্টায় লাভ খুঁজছে বিএনপি। তাই তাদের তৃণমূলেও চলছে এক হয়ে ভোটযুদ্ধে জয় ছিনিয়ে আনার পরিকল্পনা। এই তিন দলের প্রত্যাশা পূরণ না হলে হিসাব নিকাশ বদলে দিতে পারে আসিফ শাহরিয়ারের ভোট ব্যাংক। কারণ দিন যতই যাচ্ছে ততই লাঙ্গলে অস্বস্তি বাড়ছে সাধারণ ভোটারসহ সচেতন মহলে।
রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হাজী আব্দুর রাজ্জাক বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ‘দু-একদিনের মধ্যেই সব বিভেদ কেটে যাবে। সবাই একসঙ্গে সাদ এরশাদের পক্ষে লাঙ্গলের বিজয় নিশ্চিত করতে মাঠে থাকবে। অনেকেই তো মনোনয়ন চেয়েছেন, দলতো সবাইকে চূড়ান্ত করতে পারে না। সবকিছু বিবেচনা করেই দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব সাদ এরশাদকে মনোনয়ন দিয়েছেন।’
এদিকে মনোনয়ন বঞ্চিত রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব এসএম ইয়াসির বলেন, ‘আমাদের মহানগর কমিটির সভাপতি ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার দেয়া সিদ্ধান্তের সঙ্গে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সবাই আমরা সহমত দিয়েছি। এখানে স্থানীয় প্রার্থী ছাড়া বহিরাগত কারো পক্ষে কাজ করবে না দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা।’
সদর উপজেলা জাতীয় পার্টির এক নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ‘মানুষ তো এরশাদ স্যারকে ভালোবেসে ভোট দিতেন। তার প্রতি সব দলের মতের মানুষের আবেগ ভালোবাসা ছিল। সেই ভালোবাসাতো সাদ এরশাদের প্রতি নেই। তবে স্থানীয় কাউকে প্রার্থী করা হলে আমরা লাঙ্গলের হয়ে কাজ করতে স্বস্তি পেতাম। এখন লাঙ্গল আমাদের গলার কাটা। কারণ এই দলে তৃণমূলের নেতাদের কোনো মূল্যায়ন নেই।’
জাতীয় পার্টির এমন কাদা ছোড়াছুড়িতে আওয়ামী লীগ নতুবা বিএনপির প্রার্থী লাভবান হতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয় বিশ্লেষকরা। প্রবীণ রাজনীতিক নজরুল ইসলাম কালু বলেন, ‘পরনির্ভরশীল রাজনীতি ও তৃণমূল নেতাদের মূল্যায়নে পিছিয়ে পড়া জাতীয় পার্টির জন্য এই নির্বাচন বড় চ্যালেঞ্জের। সাদ এরশাদকে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিলেও ভোটাররা যদি কেন্দ্র বিমুখ হন, তবে এরশাদবিহীন জাপার নতুন ইতিহাস রচিত হবে। এতে লাভের বোঝা হয় বিএনপির ঘরে যাবে, নয়তো এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার জিতবে।’
উল্লেখ্য, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শূন্য ঘোষিত রংপুর-৩ আসনে উপ-নির্বাচনের জন্য গত ১ সেপ্টেম্বর তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, এই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া যাবে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, তা বাছাই হবে ১১ সেপ্টেম্বর, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর। তার ১৮ দিন পর ৫ অক্টোবর হবে ভোটগ্রহণ।
রংপুর সদর উপজেলা ও সিটি করপোরেশন নিয়ে গঠিত এ আসনের মোট ভোটার রয়েছে ৪ লাখ ৪২ হাজার ৭২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ২১ হাজার ৩১০ জন এবং ২ লাখ ২০ হাজার ৭৬২ জন নারী ভোটার। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটিতে ইভিএমে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
সেই ভোটে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯২৬ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী রিটা রহমান পেয়েছিলেন ৫৩ হাজার ৮৯ ভোট। এবারো ইভিএমে ভোট হবে। এবারো ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী হয়েছেন রিটা রহমান।