সরকারের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণাকে অনেকেই রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি মনে করেছিলেন। সাধারণ জনগণ দূরের কথা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও ২০০৮ সালে এ কথা বিশ্বাস করতে চাননি। জনগণের মতো বিশেষজ্ঞরাও অনেকে মন্তব্য করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের সময় কত প্রতিশ্রুতি দেয়, বাস্তবায়ন তো সামান্যই হয়ে থাকে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণাকেও তেমনি একটি স্ট্যান্ডবাজি অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন অনেকে।
কিন্তু মাত্র এক দশকের ব্যবধানে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর মাত্র ৭ মাসের মধ্যেই (জুন ২০২০) সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এমন তথ্যই জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
২০১৬ সালের আগস্টে প্রথম ৬টি উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করা হয়। এর পরবর্তী দুই ধাপে যথাক্রমে ২০৫ ও ২১১ উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন উদ্বোধন করা হয়। ১৪২ উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সময় পেলেই আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। অর্থাৎ চার বছরের কম সময়ের মধ্যে ৩৫৩ উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে।
অবশিষ্ট ১০৮ উপজেলায় বিদ্যুতায়নের জন্য দুটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মাধ্যমে ৪৮ হাজার কিলোমিটার লাইনের মাধ্যমে ২২ লাখ গ্রাহককে সংযোগ দেওয়া হবে। এরমধ্যে দুর্গম চরাঞ্চলেও নির্মাণাধীন রয়েছে ১৯ হাজার কিলোমিটার, এসব অঞ্চলের বাসিন্দারা এক সময় কল্পনাও করতে পারেননি তাদের ঘরও বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হবে।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ১ হাজার ৬৯টি বিচ্ছিন্ন গ্রাম চিহ্নিত করেছে। এসব গ্রামে গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুতায়ন করা জটিল এবং ব্যয়বহুল। এগুলোকে অফগ্রিড গ্রাম চিহ্নিত করে বিদ্যুতায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৬২০টি গ্রামে জুনের মধ্যে গ্রিড নির্মাণ করে বিদ্যুতায়ন করা সম্ভব হবে। অবশিষ্ট থাকবে ৪৪৯ গ্রাম। এসব গ্রামে স্রেডা (টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুতায়ন করবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ অফগ্রিড এলাকায় ২১টি সোলার মিনিগ্রিড স্থাপন করেছে। সৌর বিদ্যুৎ চালিত সেচ পাম্পে সংযোগ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৩৭৪টি, ৫৮ লাখ বাড়িতে সোলার হোমস সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে আলোকিত করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন পাহাড়ে অবস্থিত একটি দুটি বাড়িতেও বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতেও সচেষ্ট সরকার। এ জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ১টি প্রকল্পের মধ্যমে ৩০ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন করেছে। অবশিষ্ট এলাকায় বিদ্যুতায়নের জন্য ২১৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৪০ হাজার সোলার হোমস সিস্টেম স্থাপন করা সম্ভব হবে।
হাওরাঞ্চলেও লোকজন এক সময় ভাবতে পারেননি তারা কখনও বৈদ্যুতিক বাতির মুখ দেখতে পাবেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, হাওর অঞ্চলে যখন বিদ্যুতায়নের কথা বলা হলো তখন লোকজন বলেছিল- এটা ভোট পাওয়ার জন্য মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছেন, কথার কথা বলছেন। এক সময় লোকজন বিদ্যুতের কথা চিন্তা করতে পারতো না। এখন সেসব দুর্গম অঞ্চলেও বিদ্যুতের আলো জ্বল জ্বল করছে।
শুধু ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েই থেমে নেই বিদ্যুৎ বিভাগ। এক সময় বিদ্যুৎ খাতে ‘খাম্বা’ বেশ আলোচিত ছিল। মনে করা হতো ঘরে ঘরে খাম্বার সঙ্গে লাইন যাবে কিন্তু বিদ্যুৎ মিলবে না। বর্তমান সরকার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি উৎপাদনেও তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এখন সমালোচনা উঠেছে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে। আরও অনেকগুলো বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। নতুন নতুন চুক্তি হয়েছে বেশ কয়েকটি।
বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেছেন, আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড করেছি। এ জন্য ধন্যবাদ পাওয়ার কথা। উল্টো সমালোচনা করা হচ্ছে। আমি বলতে চাই, আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা সুযোগ সৃষ্টি করেছি এখন দেখবেন চাহিদা তৈরি হবে। বিনিয়োগকারীরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সম্ভাবনা দেখে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন।
বিদ্যুতের উৎপাদন পরিকল্পনা নিয়েও কম হাসাহাসি হয়নি। অনেকে বলেছিলেন এত বিনিয়োগ পাবে কোথায়? পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব না। বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের ঝুঁড়ি প্রায় পূর্ণ। আরও অনেকে চাচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করতে। ২০১৫ সালে ছিল ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ। এখন ২৩ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।
তবে হ্যাঁ, এখনও অনেক এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য হচ্ছে, উৎপাদনের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে যেতে পারেনি সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা। যে কারণে সংকট হচ্ছে কিছু কিছু জায়গায়। সঞ্চালন ও বিতরণেও অনেক প্রকল্প চলমান রয়েছে। শিগগিরই এ সংকট দূর হয়ে যাবে, মানসম্মত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাবে জনগণ।
বিদ্যুৎ খাত এখন স্মার্ট গ্রিডের দিকে ঝুঁকছে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) তার সমস্ত লাইন মাটির নিচ দিয়ে নেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। হাতিরপুল এলাকায় ধানমন্ডি পাওয়ার হাউসে (স্ক্যাডা কমপ্লেক্স) টুইন টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। এতে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা অটোমেশনের আওতায় আসবে।
এর মাধ্যমে সমস্যা নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করা যাবে। ধানমন্ডি ও হাতিরঝিল এলাকার বিদ্যুতের টাওয়ার ও ঝুলন্ত লাইন সরিয়ে মাটির নিচ দিয়ে নেওয়া হবে। প্রতিটি উপকেন্দ্রে ডুয়েল সোর্স নিশ্চিত করা হবে। যাতে একটি সোর্সে ত্রুটি দেখা দিলে বিকল্প সোর্সের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যায়। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা।
২০০৮ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতের গ্রাহক ছিল ৭৪ লাখ। এখন ৩ কোটি ৫১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে গ্রাহক সংখ্যা। ৯৪ শতাংশ পরিবারে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। ২০০৮ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি, এখন বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৬টি।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইস্তেহারে বাংলাদেশকে একটি ঝাঁকুনি দিয়েছে। স্বপ্নহীন মরার মতো পড়ে থাকা লোকজনকে জেগে ওঠার স্বপ্ন দেখিয়েছে। এটি দারুণভাবে কাজে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।