দেশব্যাপী বিনম্র শ্রদ্ধায় শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) পালিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ভোরে সূর্যোদয়ের পর থেকে বধ্যভূমি, শহীদ মিনার অথবা শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে বাঙালি জাতি। ঠিক সে সময় জীবিকার সন্ধানে ফুটপাতে টঙ দোকানের চা বিক্রি করছেন রাজশাহী শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক এমএ সাঈদের দ্বিতীয় ছেলে এসএম আলমগীর বাবলু।
রাজশাহী নগরীর শিরোইল বাস টার্মিনাল ফুটপাতে তাঁর ছোট্ট অস্থায়ী টঙ দোকান। সেখানে দিনভর চা বিক্রি করেন বাবলু। বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতা, শিক্ষক, শ্রমিক নেতারা বসছেন বাবলুর দোকানে। হাঁক ছাড়ছেন- ‘এই বাবলু, পাঁচটা চা ধর তো!’
দেরি হলে নেতাদের তোড়জোড়! আওয়াজ কড়া হয়, চলে ধমকা-ধমকি। নেতাকে যেতে হবে এবার আলোচনা সভায়! অথচ শহীদ বুদ্ধিজীবী সন্তান বাবলুকে দিনভর চা বেচে গভীর রাতে ফিরতে হবে ঘরে। যা আয় হবে তা দিয়ে চলে ১০ জনের সংসার।
আরও পড়ুন: শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ঠাঁই হৃদয়ে-শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায়
আলমগীর বাবলু জানালেন, আগে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। বয়স বেড়েছে, কমেছে শারীরিক শক্তি। ফলে রিকশা ছেড়ে কয়েক বছর যাবত ফুটপাতে চায়ের টঙ দোকান দিয়েছেন। চা বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। শারীরিক অসুস্থতা বা কোনো কারণে দোকান বন্ধ থাকলে, বন্ধ হয়ে যায় বাড়ির চুলাও। বাবার বদৌলতে রাষ্ট্রীয় যে ভাতা পান, তাও ভাগ হয়ে যায় ১৩ ভাইবোনের মধ্যে। ফলে পরিবার নিয়ে অসহায় জীবনযাপন করছেন বাবলু।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক এমএ সাঈদের ১৩ সন্তান। যার মধ্যে দ্বিতীয় এসএম আলমগীর বাবলু। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এমএ সাঈদ ছিলেন তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। রাজশাহীতে আর্ট কাউন্সিল বর্তমান ‘পদ্মামঞ্চ’ ও ‘রাজশাহী প্রেসক্লাব’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন তিনি। রাজশাহী বেতার প্রতিষ্ঠাকালে বাংলা খবর পাঠক ও অভিনেতা ছিলেন। তিনি শহীদ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারকে সাড়ে তিন হাজার টাকা এবং একটি সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। পরে সেই সার্টিফিকেটটি হারিয়ে ফেলে পরিবার।
তাঁর বাবাকে নিয়ে জানতে চাইলে বাবলু বলেন, ‘আব্বা কৃষি বিভাগে চাকরি করতেন। সাংবাদিকতা করতেন, নাটক করতেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ভুবনমোহন পার্কে স্বাধীনতার পক্ষে যেসব মিছিল-সমাবেশ হতো, উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দিতেন সেখানেও। ওই মিছিলে জাতীয় নেতা শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান হেনাসহ থাকতেন অনেকেই। তারা আমাদের বাসায়ও আসতেন। মায়ের গরুর মাংস রান্না পছন্দ করতেন খুব। ওনাদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আমাদের।’
পরক্ষণে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখ দুটো ভিজে ওঠে বাবলুর। বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জুন মাসের মাঝামাঝিতে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তখন ষষ্ঠীতলা এলাকার একটি বাড়িতে থাকতাম আমরা। খান সেনাদের একটি বড় গাড়ি এলো একদিন। তারা উর্দুতে বলল, ‘এই লাড়কা, সাঈদ রিপোর্টার ক্যা মাকান কিধার হ্যায়?’ আমাদের বাসা না দেখিয়ে তখন আমি ইউনিক টেইলারের মালিকের বাসা দেখিয়ে দিলাম। গাড়ি ওই দিকে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক পিস কমিটির সদস্য পড়ল সামনে। তাকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল, সাঈদ রিপোর্টার ক্যা মাকান কিধার হ্যায়?’
বাবলু বলতে থাকেন, ‘ভয়ে আমি মসজিদের পাশে লুকিয়ে গেলাম। দেখছি সবকিছু। আটজন খান সেনা বাড়ি ঢোকে আমাদের। আমার চোখের সামনেই গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় বাবাকে। বাড়িতে এসে দেখলাম মা কাঁদছেন। জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, খান সেনারা মোহনপার্কের মিছিলের ছবি দেখিয়ে বাবাকে বলল, এটা কার ছবি? তোর আব্বা উত্তর দিলো- এটা আমার ছবি। খান সেনারা বলল, আমাদের বিরুদ্ধে আপনারা কেন এসব করছেন? মেজর পারভেজ আপনাকে ডেকেছেন, সার্কিট হাউসে যেতে হবে- বলে নিয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাবার সহযোগী স্টার স্টুডিওর মালিক মোতাহার হোসেন, ঘড়ি ঘরের মালিক নাসির আহমেদ বাবাকে খুঁজতে বের হলেন তারপর। বিভিন্ন জায়গায় খুঁজলেন, পেলেন না কোথাও। কিছু দিন পর শাহ মখদুম ইনস্টিটিউটের পিয়ন কাদের মিয়া এসে আমাদের জানালেন- সাঈদ ভাইকে আর খুঁজবেন না। ওনাকেসহ ১৩ জনকে জোহা হলে খান সেনারা গুলি করেছে। সেখানে আমিও ছিলাম। গুলি লাগার আগেই আমি মাটিতে পড়ে যাই। মরার ভান করেছিলাম। খান সেনারা ভেবেছে আমিও মরে গেছি। তারপর সবাইকে গর্তে ফেলে দেয়। খান সেনারা চলে গেলে আমি লাশভর্তি গর্ত থেকে পালিয়ে আসি।’
তখন থেকে বাবলুরা জেনেছেন, তাদের বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলের বধ্যভূমিতে আছেন। সেখানকার শহীদদের নামের তালিকায় নাম রয়েছে তাদের বাবার।
বড় অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করছেন জানিয়ে বাবলু বলেন, ‘এই যে ফুটপাতে চায়ের দোকানটা চালাই, সিটি করপোরেশন থেকে মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে ভেঙে দেয়। আবার কিছুদিন পর দোকান বসাই। কি করব বলেন? এছাড়া যে উপায় নেই!’
তিনি বলেন, ‘শহীদ সাংবাদিকের ছেলে হলেও আমার কোনো নিজস্ব ঘরবাড়ি নেই। মালদা কলোনিতে দুটি রুম ভাড়া নিয়ে বসবাস করি। প্রতিমাসে ভাড়া লাগে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। স্টল চালিয়ে সংসারের খরচ জোগাড় হয় না। তাই টাকার অভাবে সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। তারাও এখন আমার সঙ্গে ফুটপাতে চা বিক্রি করে। তাদের চাকরি দরকার। কিন্তু কে দেবে?’