ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শোষণ আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাক্ষী রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা সংগ্রাম ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সরগরম ছিল এই লাইব্রেরি। বহু বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, কবি-সাহিত্যিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সংগঠক মনা মানুষের ওঠা-বসা ছিল এখানে। বই-পত্রিকার সমারোহে ছিল হাজার হাজার পাঠকও।
প্রতিষ্ঠার ১৬৫ বছর পর এখন কিছুই নেই ঐতিহাসিক রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে। দীর্ঘদিন ধরে অযত্ন, অবহেলা আর অব্যবস্থাপনায় এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। স্বাধীনতা পরবর্তী জেলায় জেলায় সরকারি গণগ্রন্থাগার হওয়াতে কমে গেছে এ লাইব্রেরির কদর। বই, লাইব্রেরিয়ান, জনবল, সংস্কার, বরাদ্দ সংকটে তেলহীন বাতির মতো জ্বলছে এই জ্ঞানগৃহ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এক সময়ের চার কক্ষ বিশিষ্ট লাইব্রেরি এখন অস্তিত্ব সংকটে। একটা অন্ধকার কক্ষে মাকড়সার জালে আলমারিতে আটকে আছে বহু নামীদামি লেখকের বই। ২০টি আলমারির আটটি নষ্ট। বই-পত্রিকা সংরক্ষণে নেই পর্যাপ্ত আলমারি। মেঝেতে, চেয়ারে আর কিছু আলমারির উপরে বস্তাবন্দী বই-পত্রিকার স্তূপ। নতুনত্ব না থাকায় পুরাতন এসব বই-পত্রিকার স্তূপ কাছে টানছে না পাঠকদের।
আরও পড়ুন: বই নেই শুধু পত্রিকা দিয়ে চলছে লাইব্রেরি!
লাইব্রেরির গায়ে ফাটল ধরেছে। দেয়ালে জমেছে শেওলা। পাঁচ বছর ধরে নেই কোনো শৌচাগার। চারটি কক্ষের একটা নির্মাণাধীন বিভাগীয় শিল্পকলা একাডেমির পেটে চলে গেছে। বাকি তিনটির মধ্যে একটি পরিত্যক্ত। লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহৃত কক্ষে পাঠকের বসার জন্য রয়েছে ১৫-২০টি প্লাস্টিক চেয়ার। আছে বহু পুরাতন একটি টেবিল।
দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করায় আছে আলো স্বল্পতা। আগের মতো পত্রিকাও নেই। অর্থ সংকটে সাতটি পত্রিকার তালিকার এখন পাঠকের খোরাক মাত্র চারটি। এই লাইব্রেরির প্রতিদিন নতুন সংযোজন বলতে শুধু চারটি পত্রিকাই। আর তেমন কিছুই নেই এখানে।
কম্পিউটার, ইন্টারনেট, তথ্য-প্রযুক্তির সেবা তো দূরের কথা লাইব্রেরির সেবার জন্য কেউ নেই। একজন বৃদ্ধ কেয়ারটেকার আর এক পরিচ্ছন্নতা কর্মীই এখানকার সব। পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক এর অভিভাবক হলেও মাথা ব্যথা নেই তার। এ কারণে লাইফ সাপোর্টে বেঁচে থাকা রোগীর মতো ধুকে ধুকে চলছে দেড়শ বছরের পুরনো এই লাইব্রেরিটি।
এখনকার কেয়ারটেকার আজিজুল ইসলাম সানু। দীর্ঘ এক যুগ ধরে এখানে চাকরি করছেন। বেতন ভাতা হিসেবে তার প্রতিদিনের হাজিরা ১০০ টাকারও কম। মাস শেষে জোটে মাত্র ২ হাজার ৫০০ টাকা। বার্তা২৪.কম-কে সানু বলেন, ‘লাইব্রেরি পরিচালনার জন্য কোন বরাদ্দ নেই। এর কোনো দাতা নেই। ২০১৫ সালে জেলা প্রশাসক লাইব্রেরির সংস্কারের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হলেও কোনো ব্যবস্থা হয়নি। একজন লাইব্রেরিয়ান ছিল, বেতন ঠিক মতো না পাওয়া তিনিও চাকরি ছেড়েছেন। এখন জনবল নেই। পড়ার মতো বই নেই। চারটি পত্রিকা ছাড়া এখানে নতুন বলতে কিছুই নেই। যারা পাঠক তারাও পুরাতন। বই না থাকায় নতুন পাঠক সৃষ্টি হচ্ছে না।’
আরও পড়ুন: রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি: জ্ঞানের ঘরে অন্ধকার
ছয় বছর পূর্বে একুশ সদস্যের একটি কমিটি হয়েছিল। ওই কমিটির অনেকে এখন বেঁচে নেই। কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়াতে এখন কেউ খোঁজখবরও নেন না। লাইব্রেরিকে বাঁচিয়ে রাখতে এর অবকাঠামো ঠিক রেখে নতুন করে সংস্কার করা জরুরি বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত হোসেন।
তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘পাবলিক লাইব্রেরি অনেক পুরোনো পাঠাগার। এখানে কত বছর ধরে নতুন বই নেই, কেউ বলতে পারবে না। এ লাইব্রেরি পরিচালনার জন্য লোকজন নেই। এখানে নির্বাচন নেই। এর গ্রাহক বা দাতা নেই। এখন কোনোরকম খোঁড়ায় খোঁড়ায় চলছে।’
এই লাইব্রেরির এক সময়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য ও সাবেক পৌর চেয়ারম্যান কাজী জুননুন বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিকে নতুন প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। এর সঙ্গে অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। এটাকে এভাবে অবহেলিত রাখতে দেওয়া ঠিক হবে না। আধুনিক পাঠাগার করে রংপুরের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে লাইব্রেরি মুখি করার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।’