করোনাকালে সামাজিক দূরত্ব, তবু খুশির ঈদ

, জাতীয়

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-28 01:00:55

কাজী নজরুল ইসলামের বহুল জনপ্রিয় গান ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’— এর মতো উৎসবমুখর ও উষ্ণ পরিবেশ নেই পৃথিবীর কোথাও। এ বছর (২০২০) এক ধূসর, নিঃসঙ্গ ও সঙ্গরোধের একাকীত্বে ‘করোনা-আক্রান্ত-শীতল-বিশ্বে’ এসেছে সম্ভাষণ, আলিঙ্গন/কোলাকুলি/করমর্দনহীন অতি শীতল ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ।

শুধু বাংলাদেশ বা মুসলিম দুনিয়াতেই নয়, সারা বিশ্বব্যাপী এসেছে সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধে আকীর্ণ ঈদ। চিরায়ত ঐতিহ্য ও নিয়মের বাইরে সাবধানে, সীমিত ও অচিন্তনীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে ঈদের ধর্মীয় আচার ও অনুষ্ঠান এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক আচরণগত দিকগুলো। এমনকি বর্জন বা স্থগিত করা হয়েছে ঈদের অনেক প্রচলিত কার্যক্রম।

মাসব্যাপী উপবাস, কৃচ্ছসাধন ও সংযমের রোজা পালন শেষে ঈদ হলো জান্নাতের সৌরভময় আসমানি পয়গাম নিয়ে আসা এক আনন্দধ্বনি। চারদিকে যত ভীতি, বিপদ, রোগভয়, সঙ্গরোধ, গৃহবন্দিত্ব, সামাজিক দূরত্ব হোক, তবু ঈদ প্রতিটি রোজাদার, মুমিন, মুসলমানের জন্য খুশির, আনন্দের।

কারণ চন্দ্রভিত্তিক আরবি পঞ্জিকা অনুযায়ী, রমজানে এক মাস রোজা পালন শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদুল ফিতর উদযাপন করেন বিশ্বের মুসলমানরা। এটাই মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এদিনটি রোজাদারদের কষ্টের বিনিময় স্বরূপ সুসংবাদ ও পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি জানানো হয়। ঈদগাহে সমবেত রোজাদারগণ হন পাপমুক্ত ও কল্যাণপ্রাপ্ত।

কিন্তু এ বছর পৃথিবীতে ঈদ এসেছে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে একইসঙ্গে নিয়ে এসেছে সুপার সাইক্লোন আম্পানে আঘাতের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়-ক্ষতি ও মৃত্যুর বিভীষিকা। ফলে আনন্দের এই ঈদে মিশেছে কষ্ট, ভীতি ও বিষাদের ছায়া। একইসঙ্গে সংক্রমণ এড়াতে নানা কড়াকড়িও থাকছে বিশ্বব্যাপী অনেক দেশে চলমান কমবেশি লকডাউনের কারণে।

বিদ্যমান করোনাভাইরাসের প্রকোপের প্রেক্ষাপটে ঈদের মধ্যে লোক সমাগমে ভাইরাসের বিস্তার যাতে বাড়তে না পারে, সেজন্য শুক্রবার বিকেল ৫টা থেকে বুধবার পর্যন্ত পুরো দেশে কারফিউ জারি করেছে সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সৌদি গেজেট জানিয়েছে, দেশটির কোনো মসজিদে ঈদের জামাতের আয়োজন না করতে ইমামদের প্রতি নির্দেশনা জারি করেছে সৌদি ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

একই সতর্কতাজনক পরিস্থিতি অনেক দেশেই গৃহীত হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে সীমিত ও সীমাবদ্ধ ভাবে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। বড় বড় ময়দান ও ঈদগাহের জামাত স্থগিত করে দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এসবই করা হচ্ছে বিপুল জনসমাবেশ থেকে যাতে করোনাভাইরাস ছাড়াতে না পারে, সেজন্য।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাস অতিমাত্রায় সংক্রামক হওয়ার ফলে অনেক দেশেই সব ধরনের অফিস-আদালত ও গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে। সবাইকে বাসায় থাকার, জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হলে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ার ওপর দেওয়া কড়াকড়ি বিধি সম্প্রতি তুলে নেওয়া হলেও এবার রোজার ঈদের দিন ঈদগাহ বা খোলা জায়গার বদলে বাড়ির কাছে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে বলেছে নানা দেশের সরকার।

সেইসঙ্গে মসজিদে ঈদ জামাত আয়োজনের ক্ষেত্রে সুরক্ষার ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বেশ কিছু শর্ত দিয়ে বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় বলেছে, এসব নির্দেশনা না মানলে ‘আইনগত ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে।

তবে ঈদের প্রাক্কালে অনেক কিছুই মানা হয়নি। বিশেষ করে আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে ট্রেন, লঞ্চ, বাসে গাদাগাদি করে বিপজ্জনকভাবে বাড়ির পথে ঈদযাত্রা করেছেন হাজার হাজার মানুষ। এতে দুর্ঘটনার ভয় যেমন আছে, তেমনি আছে রোগ বিস্তারের আশঙ্কা। ফলে এই বিরূপ চিত্র, হটকারিতা ও দুঃখজনক অভিজ্ঞতার আলোকে ঈদের দিনও ভিড় করার বিষয়ে ব্যক্তিগত আবেগকে সংযত করার ওপর প্রশাসনিক বিশেষ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

ঈদের আবশ্যিক অঙ্গ জামাত শেষে আলিঙ্গন/কোলাকুলি ও করমর্দন, আড্ডা বা আনন্দ মিছিল, পাড়ায় বা বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে কুশল বিনিময় ও দাওয়াত খাওয়া এ বছর অকল্পনীয়।

বরং যেভাবে ঘরে ঘরে অবস্থান করে ধর্মপ্রাণ মানুষ দিনে রোজা আর রাতে নামাজে লিপ্ত হয়েছেন, জিকির ও কোরআন তেলাওয়াতে মশগুল হয়েছেন, তেমনিভাবে ঈদের দিনও পরিবার-পরিজন নিয়ে গৃহকোণে থাকা জরুরি। অন্তরের আলোকিত দীপ্তিতে উদ্ভাসিত করা হলে নিঃসঙ্গ ও সঙ্গরোধের ঈদও উষ্ণ ও আনন্দময় হয়ে খুশিতে ভরতে পারে।

২০২০ সালে করোনার দাপটে তেমনি ব্যক্তিগত ঈদ উদযাপন প্রতিটি মানুষকে ঋদ্ধ, সমৃদ্ধ ও পূর্ণ করুক নিজের একান্ত অঙ্গনে। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা, ঈদ মোবারক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর