উত্তর সিটি করপোরেশনের উত্তর-পশ্চিম সীমানায় অবস্থিত দুয়ারিপাড়া ঝিলপাড় বস্তি। আধুনিক সুযোগ সুবিধা পৌঁছালেও সচেতনতার আলো সামান্যই ভেদ করতে পেরেছে, বিশেষ করে পরিকল্পিত পরিবারের গুরুত্ব তাদের কাছে নিছক একটি প্রচারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
দু’সন্তানের পরিবারের সংখ্যা তালাশ করে বের করতে হয়। বেশিরভাগ পরিবারে তিনের অধিক সন্তান রয়েছে। কথাবার্তায় স্পষ্ট তারা কিছুটা অসচেতন আবার কেউ কেউ কুসংস্কারের আছন্ন। ৬ সন্তানের জননী শাজেদা বেগম। স্বামী বজলু মিয়া পেশায় রিকশা চালক। ভোলার চরফ্যাশন এলাকার বাসিন্দা দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকার এই বস্তিতে অবস্থান করছেন। শাজেদা বেগম বাসাবাড়িতে ধোয়া মোছার কাজ করেন। করোনার কারণে এখন পুরোপুরি বেকার।
তার কাছে প্রশ্ন ছিল আপনারা কি পরিবার পরিকল্পনার কথা শুনেছেন, এর গুনাগুণ সম্পর্কে জানেন। মুখে যেনো উত্তর রেডিই করা ছিল, ঝটপট জবাব দিলেন, আল্লাহ দিলে আমরা কী করবো, জীব হত্যা মহাপাপ। তার সেই কথায় মাথা নাড়িয়ে আরও অনেকেই সায় দিলেন।
পাশের ঘরেই থাকেই হাসিনা খাতুন। স্বামী ইব্রাহিম মিয়া রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করেন। হাসিনা খাতুনও বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। তাদের সংসারে দুই ছেলে এক মেয়ের রয়েছে। ৮ মাস আগে জন্ম দিয়েছেন আরেক সন্তান আব্দুল্যাহকে।
তার কাছেও প্রশ্ন ছিল পরিবার পরিকল্পনা ও সুখী পরিবারের বিষয়ে। হেসে উড়িয়ে দিলেন বিষয়টি। বললেন আল্লাহ মুখ দিয়েছেন তিনি সব দেখবেন। হাসিনা খাতুনের তিন ঘরে পরে থাকেন বিবি হাসিনা। তিনিও বুয়ার কাজ করেন। তার ঘরের আলো ছড়াচ্ছে চার সন্তান। ভ্যান চালক শাহজাহান মিয়ার স্ত্রী জুলেখা বেগমের ঘরেও আলোকিত করছে লামিয়া, জিসান ও ইহসান নামে তিন সন্তান। রিকশা চালক জাকির হোসেনের স্ত্রী কুলসুম বেগমের ঘরেও তিন সন্তান।
দুয়ারিপাড়া (পল্লবী ঝিড়পাড়) পাকার মাথায় ৫ নম্বর রোডে অবস্থিত এই বস্তিতে প্রায় সকলেই ভোলার চরফ্যাশন এলাকার বাসিন্দা। পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে উদাসীনতার পাশাপাশি আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। তা হচ্ছে, বাল্য বিয়ের যথেষ্ট প্রচলন রয়েছে এখানে। মেয়েদের বয়স চৌদ্দ-পনের হলেই বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কঠোর বিধি নিষেধ থাকায় অনেকটা রাখ ঢাক করেই চলছে বাল্য বিয়ে।
প্রিন্টিং প্রেস কর্মী আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে ফাতেমা খাতুনের। করোনা কালেই তারা সন্তানের মুখ দেখতে যাচ্ছেন। চোখ মুখ দেখলেই যে কেউ অনুমান করতে পারবে তার বয়স। অন্তত বিয়ের বয়স যে হয়নি তা অনুমান করবার জন্য বোদ্ধা হতে হবে না। তার কাছে প্রশ্ন ছিল বয়স কতো হয়েছে আপনার। মুচকি হাসি দিয়ে প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলেন। পরে আবার প্রশ্ন করায় উত্তর দিলেন আঠারো হবে হয়তো। বাল্য বিয়ের ক্ষেত্রে সচরাচর যা শিখিয়ে দেওয়া হয়। তেমনটি বলে গেলের ফাতেমা খাতুন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিভিন্ন এনজিও থেকে দীর্ঘদিন ধরেই ক্যাম্পেইন করা হয়েছে। জনপ্রিয় একটি শ্লোগান রয়েছে, কুড়িতে বুড়ি নয় বিশের আগে বিয়ে নয়। বলা হচ্ছে, অল্প বয়সে বিয়ে এবং গর্ভধারণ মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আরফিনা খাতুনেরও বিয়ে হয়েছে পনের পুরণ না হতেই। বছর না ঘুরতেই গর্ভধারণ করেছেন। যে কিনা এখনও নিজেই অনেকটা শিশুর মতো। সেই আরফিনা আর ৪ মাস পর নিজেই মা হতে চলেছেন।
ঢাকা শহরের বস্তিগুলোর চিত্র কমবেশি একই। এসব এলাকায় কিছু এনজিও কাজ করলেও খুব একটা কার্যকর কিছু হচ্ছে বলে মনে করেন না সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করছেন, বস্তিবাসীদের সচেতন করার জন্য কার্যকর কর্মসূচি প্রয়োজন। না হলে বাল্য বিয়ে, বহু বিয়ে এবং পরিকল্পিত পরিবার সুখী পরিবার বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। যদিও সমাজের বড় একটি অংশ এ বিষযে বেশ সচেতন। কিন্তু উল্লেখ করার মতো অংশকে বাইরে রেখে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছা কঠিন। তবে সেই কাজটি শুধু সরকারি দফতর কিংবা এনজিও ওয়ালাদের একার পক্ষে সম্ভব না। এগিয়ে আসতে হবে সবাইকেই।