জিএম কাদের’র শেষ, সেখানেই শুরু রওশনের

জাতীয় পার্টি, রাজনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-31 01:39:34

সময় যত গড়াচ্ছে আগামী নির্বাচনের জোট প্রশ্নে জাতীয় পার্টির মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। যেখানে জিএম কাদের’র শেষ, সেখান থেকে আওয়ামী লীগের সখ্যতা শুরু করেছেন রওশন এরশাদ।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি। ওই নির্বাচনে সাবেক ফাস্ট লেডি রওশন এরশাদের দু’টি আসনেই উন্মুক্ত রাখা হয়। শেষ পর্যন্ত দু’টি আসনেই ধরাশায়ী হন রওশন এরশাদ। পরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছেড়ে দেওয়া রংপুর-৩ আসনের উপ-নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে ঠাই পান রওশন এরশাদ। অবস্থা দৃষ্টে মনে করা হতো কোন কারণে রওশনকে সাইড দিতে নারাজ ছিল আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনের পর সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে জাতীয় পার্টি থেকে মন্ত্রিসভায় স্থান পান জিএম কাদের।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে সর্বদলীয় সরকার গঠন করলে কপাল খুলে যায় রওশন এরশাদের। মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। চলতে থাকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া, মনোনয়ন দাখিল করার একদিন পর (৩ ডিসেম্বর ২০১৩) হঠাৎ বেঁকে বসেন এরশাদ। নির্বাচন থেকে সরে যাবার ঘোষণা দিয়ে তার দলের সদস্যের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করা নির্দেশ দেন, একইসঙ্গে সকল প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বলেন। এখানে বড় ভাইয়ের পক্ষে একাট্টা হয়ে জিএম কাদের মন্ত্রিপরিষদের সভায় যোগদান থেকে বিরত থাকেন।

কিন্তু বেঁকে বসেন রওশন এরশাদ, তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ না করার ঘোষণা দিয়ে সরকারের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। রওশন এরশাদ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে থেকে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তার ঘোষণায় ৮৭ জন প্রার্থী নির্বাচনের মাঠে থেকে যায়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দুই আসনের মধ্যে রংপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচিত হন । তবে নির্বাচনে পরাজিত হন জিএম কাদের।

নির্বাচনের পর সর্বদলকে সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয় আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি থেকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু ও মসিউর রহমান রাঙ্গা। বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসেন রওশন এরশাদ আর মন্ত্রী মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের আসন অলঙ্কৃত করেন এরশাদ। একইসঙ্গে সরকার ও বিরোধীদলে থাকা নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন জিএম কাদের। তৎকালীন মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর সঙ্গে এক সভায় তর্কে জড়ান জিএম কাদের। বছর তিনেক পরে এরশাদও ইনিয়ে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের পক্ষে কথা বলা শুরু করেন। কিন্তু রওশন তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অনড়, সংসদ সদস্যরাও রওশনের পেছনে ঐক্যবদ্ধ। এরশাদের ডাকা কোন অনুষ্ঠানেও তাদের দেখা যেতো না। এক অনুষ্ঠানে এরশাদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, আগামী নির্বাচনের আগে কিন্তু আমার কাছে আসতেই হবে। এরশাদের সেই হুমকিতেও খুব একটা কাজ হতে দেখা যায়নি। এরশাদ নিজে বিরোধীদলীয় নেতা হতে চাইলেও হালে পানি পাননি।

২০১৮ সালের নির্বাচনের ঘটনা সবার জানা, তখন এরশাদ ছিলেন গুরুতর অসুস্থ। এবারও পেছন থেকে কলকাঠি নাড়েন রওশন এরশাদ। এতে করে আওয়ামী লীগের আরও আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন রওশন। হুসেইন মুহুম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর টানাটানি শুরু হয় বিরোধীদলীয় নেতার আসন নিয়ে। সংসদীয় দলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা হতে চিঠি পাঠান জিএম কাদের। অন্যদিকে রওশনও পাল্টা চিঠি দিলে রওশনকেই বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসান সরকার। এতে জিএম কাদের ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। সরকারের সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়তে থাকে।

জিএম কাদের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আর কোন রকম সম্পর্ক রাখতে চান না জিএম কাদের। নেতাকর্মীদের কঠোর ভাষায় সরকারের সমালোচনা করার নির্দেশনা দিয়েছেন। জিএম কাদের একাধিক সভায় বলেছেন, আওয়ামী লীগের পক্ষে কেউ দালালি করলে তার পরিণতি করুণ হবে। জাপা আওয়ামী লীগের সঙ্গে নেই, ভবিষ্যতে কোন জোটে যোগ দেবে তা সময়েই বলে দেবে।

তবে বিএনপির অনেক এজেন্ডার সঙ্গে একমত হতে দেখা যাচ্ছে তাকে। সম্প্রতি বিএনপির সুরে ইভিএম’র বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছেন, পাশাপাশি এই সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন। ২০ মে এক বক্তৃতায় জিএম কাদের বলেছেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের সামনে প্রশাসন বা সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো অসহায় হয়ে পড়ে। তাই কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আছে।

জাপার গন্তব্য কি এ নিয়ে প্রকাশ্য কোন মন্তব্য না করলেও ভেতরে ভেতরে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। সম্প্রতি চিকিৎসার নামে সিঙ্গাপুর গেলেও বিষয়টি রাজনৈতিক ছিল বলে অনেকে দাবি করেছেন। সেখানে বিএনপির কয়েকজন শীর্ষনেতার সঙ্গে তার বৈঠক হয়। গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদে জিএম কাদের’র কার্যালয়ে (বিরোধীদলীয় উপনেতার) বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা ও হারুনুর রশীদের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছেন তার মেয়ের জামাইয়ের বড় ভাই মাহমুদুর রহমান। লক্ষ্মীপুর বিএনপির সাবেক এই নেতা এখন জিএম কাদের’র উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। ধারনা করা হয় তার মাধ্যমেই বিএনপির ঘনিষ্ট হয়ে উঠছেন জিএম কাদের। আরেকজন রয়েছেন বিএনপির সাবেক নেতা সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন মঞ্জু।

তৃণমূলের নেতারাও অনেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পক্ষে। তারা মনে করেন আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে যথাযথ মূল্যায়ন করেনি। তবে সিনিয়র নেতাদের বড় একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার পক্ষে। যে কারণে আগামী নির্বাচনে জিএম কাদের’র চাওয়া কতটা পুরণ হবে সে নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন খোদ এরশাদ রওশনের সঙ্গে কুলে উঠতে পারেন নি, সেখানে জিএম কাদের'র অবস্থান বেশ নড়বড়ে।

অনেকে মনে করছেন রওশন এরশাদ আগের মতোই অনেককে নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে যেতে পারেন। তেমন কিছু হলে অনেক নেতাই তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন। বিশেষ করে জিএম কাদের’র কিছু সিদ্ধান্তে নাখোশ হওয়া নেতারা। তেমনটি হলে জাতীয় পার্টি (রওশন), জাতীয় পার্টি (কাদের) নামের পৃথক দলের শঙ্কা দেখছেন দলের নেতাকর্মীরা। গত কাউন্সিলে রওশন এরশাদকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয়। কিন্তু তারপর থেকে রওশনকে আর পার্টির কোন কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যায়নি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর