মেজাজ গেল বিগড়ে মাঝ রাতে ফোন দিলাম এরশাদকে

জাতীয় পার্টি, রাজনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 19:24:22

 

পরদিন সকাল ১০টায় সাতক্ষীরার শ্যামনগরে জাতীয় পার্টির জনসভা, প্রধান অতিথি সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। টানা ১৫ ঘণ্টার জার্নি শেষে রাত সাড়ে ১১টায় শ্যামনগর হোটেলের রুম দেখে রক্ত মাথায় ওঠার জোগাড়।

হোটেল বুকিং দিয়েছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য এইচএম গোলাম রেজা। তাকে ফোন দিয়ে অস্বস্তির কথা জানানো হলো, তিনি খানিকটা বিরক্ত হলেন মনে হলো। বললেন, এখানে এর চেয়ে ভালো হোটেল নেই, ওই একটি মাত্র হোটেল রয়েছে। একটি রাতের বিষয়তো কষ্ট করে থাকতে হবে। আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলেন। এবার মেজাজ গেল আরও বিগড়ে। অথচ সন্ধ্যায় যখন সাতক্ষীরা শহর অতিক্রম করি, তখন গোলাম রেজাই ফোনে বলেছিলেন, আপনারা চাইলে সাতক্ষীরা শহর কিংবা শ্যামনগর যেখানে ইচ্ছা থাকতে পারেন, ভালো ব্যবস্থা রয়েছে।

আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, রাতেই পথটা এগিয়ে রাখতে, যেহেতু এরশাদ সকাল ১০টায় আসবেন শ্যামনগরে। সকালে একটু সময় নিয়ে বিছানা ছাড়তে যারা চান তাদের ইচ্ছাটা খানিক বেশিই ছিল। সংসদ সদস্যের আচরণে টিমের সকলেই মহাবিরক্তি প্রকাশ করলেন। এবার বাধ্য হয়ে ফোন দিলাম জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে। টানা দুই বার কল করলেও রিসিভ করলেন না।

সাত-পাঁচ কিছু না ভেবেই ফোন দিয়ে বসলাম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে। দ্বিতীয়বার রিং বেজে উঠবার আগেই রিসিভ করলেন। সিরাজ কোন সমস্যা, এতো রাতে ফোন দিয়েছো যে! তাকে জানালাম, স্যার আপনিতো জানেন আমরা কয়েকজন সাংবাদিক শ্যামনগরে এসেছি আপনার সাতক্ষীরা সফর কভারেজ দেওয়ার জন্য। এখানে যে হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে দম বন্ধ হয়ে আসার মতো অবস্থা। এখানে কেউ কোন দিন থেকেছে বলে মনে হয় না। জবাবে এরশাদ বললেন, তোমরা রেজাকে জানাওনি সমস্যার কথা? জানিয়েছিলাম রাতটুকু কষ্ট করে থাকার পরামর্শ দিয়েছে। আমি দেখছি, তোমরা চিন্তা করো না বলে ফোন কেটে দিলেন।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে এলো জাপার সংসদ সদস্য গোলাম রেজা। প্রথমেই সরি দিয়ে বাক্য শুরু করলেন। বললেন, সুন্দরবন ঘেষা মুন্সীগঞ্জে সুশীলন রিসোর্টে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। পথে যাতে কোন সমস্যা না হয় তার জন্য কতগুলো মোটরবাইক স্কর্ট দিতে পাঠালেন। কারণ রাস্তাটি ছিল ডাকাতি প্রবণ। ভাঙা রাস্তা ঘণ্টা দেড়েক লাগলো সুশীলনে পৌঁছতে। সেখানে গিয়ে দেখি সব ভিভিআইপি কক্ষগুলো রেডি করে রাখা হয়েছে। ডগমগে চাঁদনি রাতে সুশীলন থেকে সুন্দরবন দৃশ্যমান। মাঝে শুধু একটি নৌচ্যানেল, নিরাপত্তা প্রহরীরা জানালেন চ্যানেল পেরিয়ে এদিকটায় বাঘের আসার অনেক রেকর্ড রয়েছে।

যথারীতি পরদিন হেলিকপ্টার যোগে শ্যামনগরে নামলেন এরশাদ। ৫ দিনের সফরের প্রথমদিনে ২টি জনসভা ও কয়েকটি পথসভায় অংশ নিলেন। এরশাদের সাতক্ষীরা সার্কিট হাউসে রাত্রীযাপনের ব্যবস্থা ছিল। পরদিন ছিল তালা ও কলারোয়া উপজেলায় জনসভা।

সকালে নাস্তার পর রুমে এসে বেরুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছি, এরশাদের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আব্দুর রহিম এসে জানালেন, স্যার আপনাকে ডেকেছেন। ট্যুরে গেলে তিনি সবসময় কথা বলেন, আমি মনে করেছিলেন তেমন কিছু হবে হয়তো। রুমে ঢুকে দেখি মুখ গম্ভীর করে সোফায় বসে আছেন এরশাদ। আর পাশের লম্বা সোফায় মুখ কালো করে বসে আছেন গোলাম রেজা, তারপাশে বসা এরশাদের ব্যক্তিগত সহকারী মেজর (অব.) খালেদ আখতারের আতঙ্কিত চেহারা। কিছু একটা হয়েছে আঁচ করলাম, কিন্তু তখনও বিস্ময়ের খানিকটা বাকি। আমাদেরকে উল্টো দিকের সোফায় বসতে বলে, পাশের রুমে থাকা রুহুল আমিন হাওলাদারকে ডাকতে বললেন। রুমের মধ্যে পিনপতন নিরবতা। হাওলাদার রুমে ঢুকতেই কথা শুরু করলেন এরশাদ। প্রথমে গোলাম রেজাকে ঝাড়লেন ছোটলোক, অসামাজিক অনেক বিশেষণ যোগ করলেন। বললেন, আমি ওদের (সাংবাদিকদের) পাঠিয়েছি, ব্যবস্থা ঠিকমতো হলো না কেনো। তুমি দায়িত্ব নিতে পারবানা তাহলে আগে জানালে কেনো। আমাকে ফোন দিতে হলো কেনো? তোমার মতো ছোট লোকের দরকার নেই আমরা পার্টিতে, তুমি রিজাইন দিয়ে দাও। আরও অনেক আক্ষেপ ঝাড়লেন, গোলাম রেজা হাত জোড় করে হাঁটুর মধ্যে গুজে মাথা নিচু করে থাকলেন পুরো সময়।

এরপর শুরু ধরলেন পার্টির মহাসচিব হাওলাদারকে। তাকে প্রথমেই প্রশ্ন করলেন তুমি ওদেরকে (সাংবাদিক) পাঠিয়ে দায় সারলে। ওদের খোঁজ নিয়েছিলে কি? ওরা ঠিকমতো পৌঁছাল কিনা। তাদের কোন সমস্যা আছে কিনা! মহাসচিবের নিরবতা দেখে, অগ্নিমূর্তি এরশাদ বললেন, তুমি পার্টি চালাতে না পারলে রিজাইন দাও। তোমার মতো মহাসচিবের দরকার নেই আমার। এরপর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারির হাতে ১ লাখ টাকার একটি বান্ডিল ধরিয়ে দিয়ে বললেন, রহিম তুমি এই ছোটলোকদের আশায় থাকবা না। ওরা (সাংবাদিকরা) যখন যা খেতে চায় খাওয়াবা। কোন যেনো সমস্যা না হয়, টাকা শেষ হলে আবার নিবা।

আরেকটি ঘটনা ২০১৩ সালের দিককার হবে মনে হয়। মুন্সীগঞ্জ জেলায় বিশাল জনসভা, আয়োজক জাতীয় পার্টির ডোনার খ্যাত যমুনা গ্রুপের অন্যতম কর্নধার সালমা ইসলাম। দুপুর দেড়টায় জনসভায়, সিডিউল ছিল সার্কিট হাউসে খেয়ে জনসভায় যোগ দেবেন এরশাদ। জ্যামের কারণে পৌঁছাতে বেলা ৩টা গড়িয়ে যায়। সার্কিট হাউস গিয়ে খাবার সারেন এরশাদ। নিজের খাওয়া শেষে ডাইনিং টেবিলে বসেই জানতে চাইলেন সাংবাদিকরা খেয়েছে কিনা। ৩ জন সাংবাদিকের খাওয়া হয়নি জানতে পেরে, ডাইনিং টেবিলে তার ডান পাশ বসা কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্যকে তুলে দিয়ে সেই চেয়ারগুলোতে বসতে বললেন। খাবার দিতে দেরি হচ্ছে দেখে আবার তাগাদা দিলেন। খাবার পরিবেশনকারী বয়টি বললেন, স্যার খাবারতো শেষ হয়ে গেছে, দ্বিগুণ লোক খাইয়েছি আমরা। ওই সময়ে সালমা ইসলাম এসে এরশাদকে অনুরোধ করলেন, স্যার এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, লোকজন চলে যাচ্ছে। ওনারা (সাংবাদিকরা) খেয়ে আসুক আপনি সভামঞ্চে উঠুন। এবার এরশাদ বলে উঠলেন, তাহলে সভা বাতিল করে দাও। ওরা খাবে তারপর উঠবো আমি। আমরা ভীষণ লজ্জার মধ্যে পড়ে গেলাম, অনুরোধ করেও তার সিদ্ধান্ত থেকে টলানো গেলো না। হোটেল থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট এনে খাইয়ে তারপর ডাইনিং টেবিল থেকে উঠলেন এরশাদ।

সভাশেষে ঢাকায় ফেরার সময় বললেন, তোমরা সবসময় আমার গাড়িকে ফলো করবা। আমার পিছে পিছে চলে আসো। ঢাকা ফিরে সোজা সোনারগাঁও হোটেলে গিয়ে ঢুকে পড়লেন। টেবিলে গিয়ে বললেন, আমি দুঃখিত দুপুরে তোমাদের খাবারটা ঠিকমতো হয়নি। এখানে শান্তি করে খেয়ে নাও।

আমার সাংবাদিকতা জীবনে এরশাদ ছাড়া অনেক রাজনীতিবিদ, অনেক বড় বড় আমলা ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেশ বিদেশ সফর করেছি। জাতীয় পার্টির পাশাপাশি বিএনপির চাঁপাই লংমার্চসহ একাধিক বড় বড় কর্মসূচি কভারেজ দিয়েছি। এরশাদ ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। আমার দৃষ্টিতে সাংবাদিকদের খাতির যত্নে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তাকে ডিঙানো থাক তো দূরের কথা সমকক্ষ কাউকে দেখিনি। খোঁজ করলে হয়তো তারও ভুঁড়ি ভুঁড়ি দোষ পাওয়া যাবে। আমরা না হয় তার ভালো গুণগুলোকেই ধারণ করবো।

এ সম্পর্কিত আরও খবর