নির্বাচনের পথেই এগুচ্ছে জাতীয় পার্টি!

জাতীয় পার্টি, রাজনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-11-16 22:59:50

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও নির্বাচন প্রশ্নে এখনও কোন সিদ্ধান্ত জানায় নি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তবে একাধিক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাওয়ার পথেই এগুচ্ছে, চলছে আসন নিয়ে দর-কষাকষি। 

ওই নেতারা জানিয়েছেন, আসন ভাগাভাগি চুড়ান্ত হলেই নির্বাচনের যাওয়ার বিষয়ে ঘোষণা দেবে। বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) রাতের মধ্যেই চূড়ান্ত হতে পারে। এ জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রির সব আয়োজন গুছিয়ে রাখা হয়েছে। মনোনয়ন ফরম বিক্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বনানী চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে স্টাফদের আগামীকাল শুক্রবারের (১৬ নভেম্বর) সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করে অফিসে থাকতে বলা হয়েছে।

পার্টি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে চাপ রয়েছে। আবার দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা অনেকেই চান নির্বাচন করতে। আওয়ামী লীগের কাছে কমপক্ষে ৬০টি আসন চাওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) বিকেল পর্যন্ত ৩৬টি আসন ছেড়ে দিতে চেয়েছে। দুই ধরনের পরিকল্পনা রাখা হয়েছে, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে এক রকম আর নিলে আরেক রকম। বিএনপি নির্বাচনে না এলে জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। তবে নির্দিষ্ট কিছু আসনের বিষয়ে গোপন সমঝোতা থাকবে। যেভাবে ২০১৮ সালের নির্বাচন হয়েছিল।

অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকারের পাশাপাশি রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের মধ্যেও কিছু আসনের মতবিরোধ রয়েছে। বিশেষ করে রংপুর-৩ (সদর), রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া), ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, নারায়নগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁও) আসন নিয়ে তাদের পৃথক পছন্দ রয়েছে। জাতীয় পার্টির দুর্গখ্যাত রংপুর-৩ আসন থেকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এরশাদের মৃত্যুর পর আসনটি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন রওশন পুত্র রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ। আসনটিতে নির্বাচনের বিষয়ে পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও খুবই আগ্রহী। অন্যদিকে রওশন এরশাদও তার পুত্রকে রাখতে বদ্ধপরিকর। উপনির্বাচনের সময়ও বিষয়টি নিয়ে রশি টানাটানি হয়।

রংপুর-১ আসনে বিগত দুই সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা। রওশন পন্থী বলে পরিচিত রাঙ্গাকে পার্টির সকল পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার চিফ হুইপ পদ কেড়ে নেওয়ার জন্য জিএম কাদের’র চেষ্টা বিফলে যায়। ওই আসনে এক সময় জাপার টিকেটে সংসদ সদস্য ছিলেন ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার। জিএম কাদের আসনটি মসিউর রহমান রাঙ্গাকে ছাড়তে নারাজ।

নারায়নগঞ্জ-৩ আসন নিয়েও জটিলতা রয়েছে। আসনটি বিগত কয়েকটি সংসদে জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এখানে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা বিগত দুই সংসদ সদস্য হিসেবে রয়েছেন। একই আসনের বাসিন্দা রওশন এরশাদের বিশ্বস্ত সহচর সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ্।

জিএম কাদেরের পাশাপাশি রওশন এরশাদের পক্ষ থেকেও দর-কষাকষি চলছে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাত করেন রওশন এরশাদ। সরকারের আস্থাভাজন রওশন ২০১৪ সালের নির্বাচনের আসন ধরে ৩৫টি আসন চেয়েছেন। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় ২০ জন ও পরে ১৪ জন নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসেন। রওশন এরশাদ একটি তালিকাও দিয়ে এসেছেন বলে জানা গেছে।

জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রথম নির্বাচনী জোট গঠন করে ২০০৮ সালের নির্বাচনে। তখন জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ৪৯ আসনের দাবী ছিল। এর মধ্যে ৩২টি আসন দেওয়া হয় আর ১৭টি আসন উন্মুক্ত রাখা হয়। এতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা নিজ নিজ দলের প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৭টি আসনে বিজয়ী হন। আর গত নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ, সব মিলিয়ে ২৭৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দিতা করে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। এর মধ্যে জোটগতভাবে ২১টি আর উন্মুক্ত থেকে একটি আসনে বিজয়ী হয় জাতীয় পার্টির প্রার্থী।

নির্বাচন প্রশ্নে ভেবে চিন্তে পা ফেলতে চায় জাতীয় পার্টি। সময়ক্ষেপণ করে দেখতে চান অন্যকিছু ঘটে কিনা। বিশেষ করে আমেরিকার দৌড়ঝাপের দিকেও নজর রাখছে দলটি। অনেকেই ২০১৪ সালের নির্বাচনের আলামত দেখতে পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। ২০১৪ সালে নির্বাচনে মনোনয়ন দাখিল করার পর হঠাৎ করেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। কিন্তু সেই নির্দেশ অমান্য করে রওশনের নেতৃত্বে ৮৭ জন প্রার্থী নির্বাচনে থেকে যান। 

একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন বিশাল ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি নেতাদের নির্বাচনে যাওয়া ঠেকাতে পারেন নি, জিএম কাদের সে তুলনায় কিছুই না। অনেক নেতাই চান যে কোনভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে।

১৪ নভেম্বর জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় জিএম কাদের বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাবে কি না তা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে নানাভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে। যখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যাই, তখনই পিছুটান আসে। কিন্তু সরকার দল ভাঙতে পারছে না। আমার অনুরোধ, যে সিদ্ধান্ত নেব, সবাই সে সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন। হয়তো সবার মতামতের প্রতিফলন নাও হতে পারে। রাজনীতিতে আবেগের মূল্য দিলে পথভ্রষ্ট হতে হবে, বাস্তবতাকে মূল্য দিতে হবে।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা এখন পর্যন্ত নির্বাচন প্রশ্নে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি নি। আরও তিন-চার দিন পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নিতে চাই। আমরা মনে করছি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর