বিএনপির জনবিচ্ছিন্নতার ৯ কারণ

বিএনপি, রাজনীতি

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-24 04:26:18

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গড়া দল বিএনপি এখন ভগ্ন অবস্থায়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ছায়াতলে নির্বাচনে অংশ নিয়েও এক বুক হতাশা নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়েছে দলটিকে। ভুল সিদ্ধান্ত আর জনবিচ্ছিন্নতায় দলটি আজ ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছেছে।

দলটির নেতা, কর্মী আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে বিএনপি’র এই জনবিচ্ছিন্নতার ৯ টি কারণ উল্লেখ করা হলো:

১. জিয়া পরিবার কেন্দ্রিকতা

২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জিয়া পরিবার হয়ে ওঠে বিএনপির নীতি নির্ধারক। জিয়া পরিবারের দুই সন্তান তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান গড়ে তোলেন দুর্নীতির এক পাহাড়সম দূর্গ। এছাড়াও খালেদা জিয়ার এই দুই সন্তানের একচ্ছত্র আধিপত্য রাজনীতির মাঠে এখনো দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই আতঙ্ক হয়ে আছে। দলটির রাজনীতিও মাঠে গড়িয়েছে শুধুমাত্র খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন ঘিরে এবং লন্ডনে বসবাসরত তারেক জিয়ার নির্দেশে।

২. জনবিচ্ছিন্নতা

২০০১ সাল থেকে দলটি ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ওঠে। তৎকালীন সময়ে দেশে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকটের সময় জনগণের পাশে না দাঁড়িয়ে বরং শোষনের পথ বেছে নেয় দলটি। যা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এছাড়াও ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় বারবার সংসদ বর্জন এবং জনবান্ধব কর্মসূচী না দেয়ায় জনগণ থেকে দূরে সরে পড়ে দলটি। এছাড়াও গত ৫ বছরে জনগণের প্রয়োজনে নয় বরং জিয়া পরিবার নিয়ে আন্দোলন করে বিএনপি। যা তাকে মানুষের মনন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

৩. যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গ

যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ধসে যায় ৪ দলীয় ঐক্যজোট। তবে এরপরও আন্দোলন, কর্মসূচীতে জামায়াতে ইসলামের সরব উপস্থিতি দলটিকে তরুণ সমাজের কাছে ঘৃণিত করে তোলে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জামায়াতে ইসলামের ২২ সদস্যের নির্বাচনও দলটিকে জনবিমুখ করে তোলে।

৪. ব্যবসায়ীদের মুখ ফিরিয়ে নেয়া

দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকায় দলটিতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। দলটির নেতাদের পকেট এখনো ভারি থাকলেও নির্বাচনে কেউই নিজস্ব অর্থ বিনিয়োগ করেনি। বরং ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তবে সেটি হয়নি। বরং ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিনের বিনিয়োগকে নিরাপদ করতে আওয়ামী লীগ সরকারকেই বেছে নিয়েছেন। পোস্টার লাগাতে দেয়নি বলে সরকারপক্ষের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, এর বাইরেও সত্য হচ্ছে পোস্টার ছাপায়ওনি দলটি। কারণ নির্বাচনী প্রচারের জন্যে যে বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন, দলটি তা পায়নি।

৫. গণমাধ্যম বিমূখতা

গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগে দলটি পিছিয়ে ছিল। শুধু বিএনপি বিটের সাংবাদিক ছাড়া অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন। তাই বিভিন্ন খাতে সরকারের অনিয়মগুলো তুলে ধরতেও হয়েছে ব্যর্থ। গণমাধ্যমে বারবার জামায়াতকে নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে দলটিকে। তাই এক পর্যায়ে নিজেদের গণমাধ্যম থেকেও গুটিয়ে নেয় দলটি। এছাড়াও গণমাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি নিয়ে পরিকল্পনার অভাবও চোখে পড়েছে।

৬. তথ্যের অভাব

দলটিতে কোনো গবেষণা বা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ দল না থাকায় ভেতরটা অন্তঃসার শূন্য হয়ে পড়ে। জনগণের চাহিদা বা জাতীয় রাজনীতি নিয়ে দলটির কোন গবেষণা হয়নি। দলের কাঠামোর সমস্যাগুলো যেমন নিরুপণ করতে পারেনি তেমনি মাঠ পর্যায়ের শূন্যস্থানগুলোও পূরণ হয়নি। দলের নেতাদের বক্তব্য এবং দলের কর্মসূচির মধ্যেও গবেষণা এবং তথ্যের অভাব ছিল অস্পষ্ট। তাই অন্ধের মতোই পদক্ষেপ নিয়েছে দলটি।

৭. সিনিয়র নেতাদের অবমূল্যায়ন

দলে এহসানুল হক মিলনের মতো সিনিয়র নেতারা মূল্যায়ন পাননি। ২০০১ সাল থেকে দল থেকে অনেক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মেজর মান্নান, কর্ণেল অলি বা নাজমুল হুদার মতো নেতারা শুধু দূরেই সরেছেন। কাছে আসেননি। শেষ প্রান্তে এসে শমসের মবিন চৌধুরী এবং এনাম আহমেদ চৌধুরীর আওয়ামী লীগে যোগদান ছিল দলটির শেষ বাঁশি বাজিয়ে দেয়ার মতোই। এই নেতাদের একটি অংশকে যেমন তারেক রহমান অবমূল্যায়ন করেছেন অন্য অংশকে অবমূল্যায়ন করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও রিজভীরা।

৮. তরুণদের বঞ্চিত করা

তরুণরা বঞ্চিত হয়েছেন আশঙ্কাজনকভাবে। ছাত্রদলের দায়িত্ব এখনো রয়েছে অছাত্রদের হাতে। তাই দলটিতে নিজেদের কোনো ভবিষ্যৎ খুঁজে পায়নি বর্তমান ছাত্ররা। সেখানে এখনো ৩৫-৪০ বছর বয়সীরা নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। আর ৫০ এর অধিক বয়সীরা রয়েছেন যুবদলে। তরুণদের এই বঞ্চনা দলটিকে মধ্য ভাগ থেকে যেমন ভেঙে দিয়েছে, তেমনি করে তুলেছে অসহায়। ধীরে ধীরে শিবিরের উপর ঝুঁকে পড়ে দলটি।

৯. আন্দোলনে না থাকা

পূর্বের আন্দোলন নয় শুধু, নির্বাচনের মাঠেও ছিল না দলটির নেতারা। ফলে তরুণরা জ্যেষ্ঠ নেতাদের মাঠে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। এছাড়াও জাতীয় ইস্যুতে যে আন্দোলনগুলো হয়েছে, সেগুলোতে জনগণের পাশে দাঁড়াতে পারেনি দলটি। তাই সরকারের শোষণে আরো কোনঠাসা হয়ে পড়ে দলটি। কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি দমন নিপীড়নের বিরুদ্ধে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর