সজীবের আত্মহত্যা এবং অনেক প্রশ্নের কাঠগড়ায় বিসিবি

ক্রিকেট, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পোর্টস এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 20:39:08

মানুষের জীবনের সবকিছুই আসলে গল্পের মোড়কে। সেই জন্ম থেকে মৃত্যু; পুরোটা জুড়েই কখনো টুকরো টাকরা স্বপ্নের গল্প। কখনো হতাশার। কখনো সমস্যার। কখনো সমাধানের।

জীবদ্দশায় সেই সমস্যার সমাধান হলে তো গল্পের মধুর সমাপ্তি। আর সঙ্কটে পড়ে জীবন শেষ হয়ে গেলে রয়ে যায় অনেক কঠিন প্রশ্ন। 

উদীয়মান ক্রিকেটার সজিবুল ইসলাম সজীবের আত্মহত্যা তেমনই অনেক প্রশ্নের ধারালো সূঁচ! আর ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা হিসেবে নিশ্চিতভাবে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায়ভার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কাঁধে।

সবার আগে ক্রিকেটার সজীবের সবুজ স্বপ্নের গল্পটা শুনি। 

মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ’র সাফল্যের পথ ধরেই স্বপ্ন বুঁনেছিলেন সজিবুল ইসলাম সজীব। একদিন তার ব্যাটেই বাংলাদেশ ম্যাচ জিতবে, তাকে ঘিরেই আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠবে পুরো দেশ! এমন সুন্দর রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ক্রিকেট ব্যাটকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিদিন ঘুমাতে যেতেন কিশোর সজীব। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে যোগ দিয়ে নিজের সেই স্বপ্ন সিঁড়ির সোপান শুরু তার। 

স্বপ্ন দেখতেন একদিন তার ক্রিকেট ব্যাটেই পরিবারের সব আর্থিক কষ্ট দূর হবে। রাজশাহীর ‘বাংলা ক্যাট’ ক্রিকেট একাডেমির নিয়মিত ছাত্র সজীব। মেজাজ মর্জিতে ভীষণ নরম। খেলোয়াড় হিসেবেও ভাল। নিজেকে সেই ভাল থেকে অসাধারণমানে পরিণত করার চোয়াল দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তার। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ২০১৭ সালে তিনটি ইয়ুথ ওডিআই খেলা হলো। পরের বছর অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে নিউজিল্যান্ডে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নটা খুব কাছে এসেও দুরেই রয়ে গেল। সেই বিশ্বকাপে সজীব দলের স্ট্যান্ডবাইয়ের তালিকায় থাকলেন। শেষপর্যন্ত বিশ্বকাপে তার যাওয়া হলো না। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যস্ত থাকলেন এই তরুণ ক্রিকেটার। প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে শাইনপুকুরের হয়ে খেললেন। খুব বেশি সাফল্য পেলেন না। কিন্তু হতাশ হলেন না। নিজেকে ক্রিকেটে রাখতে এক ধাপ নিচে নেমে প্রথম বিভাগ ক্রিকেটেও নাম লেখালেন। প্রথম বিভাগে উত্তরা স্পোর্টিং ক্লাবে ব্যাটিং ওপেন করলেন। পারফরমেন্স মন্দ নয়। সেই ক্লাবের হয়ে টি-টোয়েন্টি লিগে সজীবের পারফরমেন্স তার স্বপ্নকে আরো বড় করে। আয় রোজগারও খারাপ নয়। বিভিন্ন জেলায় খ্যাপ ক্রিকেট খেলা এই তরুণ ক্রিকেটার ক্রমশ সচ্ছ্বল জীবনে পৌঁছানোর ছবিটাকে আরো বড় করছিলেন।

-আমিও একদিন মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে খেলবো, সাকিব ভাই, মুশফিক ভাইদের সঙ্গে!

কিন্তু সজীবের এই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল!

করোনাভাইরাস অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। অনেক সুন্দর স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। সজীবের ক্রিকেট স্বপ্নও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলো যেন। করোনার তোড়ে পুরো দেশে ক্রিকেট বন্ধ সেই মার্চ থেকেই। খেলা নেই তাই টাকাও নেই। এক টাকাও আয় নেই। মাঠে খেলা নেই। অনুশীলন নেই। ঘরে আর্থিক ক্লিষ্টতায় বাবার চেহারায় হাসি নেই। ঠিক কবে এই দুঃসময় থেকে মুক্তি মিলবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ক্রমশ আনন্দহীন জীবনযাপন। প্রতিটা ভোর শুরু হয় না পাওয়ার বেদনা নিয়ে। সন্ধ্যা নামে সেই হতাশার আগুন যন্ত্রণায়। এভাবে যায় দিনের পর দিন। সপ্তাহের পর সপ্তাহ। মাসের পর মাস-কিন্তু সমস্যার সমাধান নেই!

১৫ নভেম্বর রাতে দুর্গাপুরের বাসার কড়িকাঠে ঝুলে পড়ার আগ পর্যন্ত নিজের ক্রিকেটীয় সমস্যার সমাধান পাননি সজীব। পরদিন পুলিশ তার ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করে। সজীবের নাম ও ঠিকানার পাশে দূর্গাপুর থানার রেজিষ্ট্রারে লেখা-অপমৃত্যু!

আর এই তরুণের আত্মঘাত বিসিবি’র জন্য রেখে গেল অনেক বড় দায়ভারের বোঝা। করোনাভাইরাস মহামারির এই সময়টায় বিসিবি অনেক ক্রিকেটারের আর্থিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে; কিন্তু সেই অনেকের ভিড়ে যে সজিবুল ইসলাম সজীবরা ছিলেন অনেক দুরের!

বিসিবির চিন্তা চেতনার সিংহভাগ জুড়েই যে শুধু জাতীয় দল। ৩০ থেকে ৪০ জন ক্রিকেটারকে নিয়েই বেশিরভাগ সময়ে নাড়াচাড়া। বেতন চুক্তিতে থাকা ৯১ জন ক্রিকেটার বাদে পুরো দেশে আরো হাজার হাজার ক্রিকেটার আছে সেটা প্রায়স ভুলে যায় ক্রিকেট বোর্ড। এই মহামারির সময় ক্রিকেট বোর্ড জাতীয় দল, অনূর্ধ্ব-১৯ দল, নারী ক্রিকেটার এবং প্রিমিয়ারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রিকেট ক্লাবকে অর্থায়ন করেছে। তবে এককালিন সেই থোক বরাদ্ধ থেকে সজীবের মতো ক্রিকেটাররা কি আদৌ কোন উপকার পেয়েছেন? 

বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি লিগে খেলছে দেশের ১২২ জন ক্রিকেটার। 

তাহলে বাকিরা কি করবেন? জেলা পর্যায়ের যেসব ক্রিকেটার পেছনের ৯ মাস জুড়ে কোন ধরনের ক্রিকেট খেলতেই পারেননি তারা কিভাবে জীবন কাটাবেন? বিসিবি তাদের সমস্যার সমাধান খোঁজার কোন চেষ্টা কি করেছে? করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা রাজধানী ঢাকায়। অথচ সেখানেই শুধু ক্রিকেট ফেরানোর চেষ্টায় কাতর বিসিবি। যেসব জেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যাধিক্য কম, প্রশ্ন হলো, কেন সেখানে বিসিবি জেলা পর্যায়ের ক্রিকেট লীগ শুরু করেনি? অন্তত সেখানে লিগ চালু হলেও তো জেলা ক্রিকেটাররা চাল-ডাল কেনার উপায় পেতেন।

এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই!

জাতীয় দলের সাবেক এক অধিনায়ক হতাশা ভরা গলায় বললেন-ভাইরে, বিসিবির নাম বদলে দিয়ে এখন রাখা উচিত, ঢাকা ক্রিকেট বোর্ড! ঢাকার বাইরেও যে ক্রিকেট আছে, ক্রিকেটার আছে-সেটা বোধকরি বিসিবি ভুলে গেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন কমপক্ষে ৪ হাজার ক্রিকেটারের একটা ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু বিসিবির নেকনজর যে শুধুমাত্র ৪০ জন ক্রিকেটের দিকে। তাদের বাঁচাতেই শুধু ঘি আর মাখন ঢালা। বাকিরা বাঁচুক শুধু কলসের পানিতে!

আঞ্চলিক ক্রিকেটের রূপকথার গল্প বিসিবি সেই ৮ বছর আগে থেকেই শুনিয়ে আসছে। আজ পর্যন্ত সেই সংস্থার ইট-কাঠই আনা হলো না। বিসিবির বড় কর্তারা দিনরাত শুধু জাতীয় দলের মধ্যেই চিন্তা চেতনা আটকে রেখেছেন। কখনো কি তারা রাজশাহীর ক্রিকেট, চট্টগ্রামের ক্রিকেট বা যশোরের ক্রিকেট নিয়ে বাস্তবিক বা স্বস্তিদায়ক কোন পরিকল্পনা দিয়েছেন? আছে কোন অ্যাকশন প্ল্যান? 

সজীবের অপমৃত্যু আরেকবার জানিয়ে গেল দেশের ক্রিকেট এবং ক্রিকেটারে এখনো উপর নিচ ভেদাভেদ স্পষ্ট!

আরও পড়ুন-

অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটার সজীবের আত্মহত্যা

এ সম্পর্কিত আরও খবর