স্বপ্নের মতো এক ম্যাচ। যেন নিজ হাতেই পাণ্ডুলিপি লিখলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। বীরের মতোই মাথা উঁচু করে বিদায় নিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সফলতম অধিনায়ক। নেতৃত্বের শেষ ম্যাচে তাকে দারুণ এক জয় উপহার দিলেন সতীর্থরা।
সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে বাংলাদেশ পেলো বৃষ্টি আইনে ১২৩ রানের বিশাল জয়।
এই জয়ে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজে জিম্বাবুয়েকে ৩-০তে হোয়াইটওয়াশ করলো টাইগাররা। এনিয়ে জিম্বাবুয়েকে টানা চার সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করল বাংলাদেশ দল।
অধিনায়ক মাশরাফি হাসি মুখেই শেষ করলেন তার নেতৃত্ব। এটি তার অধিনায়কত্বে টাইগারদের ৫০তম জয়।
ম্যাচ টস হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ ৪৩ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে তুলে ৩২২ রান। বৃষ্টি আইনে জিম্বাবুয়ের টার্গেট দাঁড়ায় ৩৪২ রান। কিন্তু সফরকারীরা মিশন ইমপসিবলের সামনে দাঁড়িয়ে ৩৭.৩ ওভারে অলআউট ২১৮ রানে!
শুক্রবার (৬ মার্চ) গার্ড অব অনারে রাজকীয় বিদায়টাই হলো ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মর্তুজার।
জিম্বাবুয়ের ইনিংসে প্রথম ভাঙনটা কিন্তু ধরিয়েছিলেন অধিনায়কই। এরপর তাকে অনুসরণ করেন অন্য বোলাররা। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে দেননি প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের।
সিলেটে ছুটির দিনে দিবা-রাত্রির ম্যাচে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা তার বিদায়ী ম্যাচটাতে শুরুতে অবশ্য ব্যাটসম্যানদের কাব্য লেখা হয়েছে। আরেকটু সরাসরি বলা যায়। দুই ওপেনার লিটন দাস ও তামিম ইকবালের রেকর্ড গড়া জুটিতেই বড় পুঁজি পায় বাংলাদেশ। তারপর বোলাররা সেই ধারাবাহিকতাটাই ধরে রেখেছেন।
মাশরাফি নিজের প্রথম ওভারের চতুর্থ বলে ফেরান ওপেনার তিনাশে কামুনহুকামউইকে। অধিনায়কের আউট সুইঙ্গারে কাঁবু কামুনহুকামউই। লিটন দাসকে সহজ ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি। অধিনায়ক হিসেবে নিজের সবশেষ ম্যাচে মাশরাফি সাফল্য পেলেন প্রথম ওভারেই।
এরপর ব্রেন্ডন টেলরকে সাজঘরের পথ দেখিয়ে দেন সাইফউদ্দিন। লেংথ বল মিড উইকেট দিয়ে খেলতে চেয়ে ব্যর্থ টেলর। ১৫ বলে তিন চারে ১৪ রান তুলে বিদায়। এরপর অভিষিক্ত স্পিনার আফিফ হোসেন ধ্রুবর চমক। নিজের দ্বিতীয় বলেই শন উইলিয়ামসকে বোল্ড করেন তিনি। তার ডেলিভারি মিডল-অফে পড়ে স্পিন করে ভেঙে দেয় অফ স্টাম্প। ৩৬ বলে পাঁচ চারে ৩০ রানে ফিরেন উইলিয়ামস।
তারপর রেজিস চাকাভাকে ফেরান তাইজুল। ৪৫ বলে এক চারে ৩৪ রান করেন চাকাভা। ওয়েসলি মাধেভেরেকে ফিফটির সাজঘরের পথ দেখান সাইফউদ্দিন। তুলে নেন নিজের দ্বিতীয় উইকেট। ৪২ বলে তিন চার ও এক ছক্কায় ৪২ রান করেন মাধেভেরে। দল পড়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ে।
এরপর যা একটু লড়াই করলেন সিকান্দার রাজা। অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান শুধুই হারের ব্যবধানটা কমিয়েছেন। তার ব্যাটে ৫০ বলে ৬১ রান। সাইফউদ্দিন আরও একবার চেনালেন নিজেকে। তুলে নেন ৪ উইকেট।
এর আগে ব্যাট করতে নেমে অধিনায়ককের জন্য জয়ের মঞ্চ তৈরি করে দিলেন লিটন দাস ও তামিম ইকবাল। দুই ওপেনারের শতরানে জিম্বাবুয়েকে কঠিন চ্যালেঞ্জ দিয়েছে বাংলাদেশ। মাশরাফি বিন মর্তুজার অধিনায়কত্বের শেষ ম্যাচে রান পাহাড় গড়ে স্বাগতিকরা। বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলেন লিটন দাস।
সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে টস হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। স্বাগতিক দল বৃষ্টির কারণে নির্ধারিত ৪৩ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে তুলে ৩২২ রান। তবে এই ম্যাচে জিততে বৃষ্টি আইনের কারণে জিততে প্রয়োজন পড়ে ৩৪২ রান।
মাশরাফির নেতৃত্বের বিদায়ের ম্যাচে ইতিহাসের অংশ হয়েছেন লিটন-তামিম। লিটনের পর সেঞ্চুরি পেয়েছেন তামিমও। দেশের ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক ম্যাচে এবারই এক ম্যাচে সেঞ্চুরি পেলেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার।
একই ছন্দ ধরে রেখে খেললেন তামিম। আগের ম্যাচে পেয়েছিলেন শতরান। এবারও সেঞ্চুরির দেখা পেলেন এই ওপেনার। টানা দ্বিতীয় ও ওয়ানডেতে এটি বাঁহাতি ওপেনারের তের নম্বর সেঞ্চুরি। ৯৮ বলে তিন অঙ্কে পৌঁছান তামিম। তখন তার ব্যাটে ছিল চারটি ছক্কা ও পাঁচটি চার।
শুক্রবার তামিমকেও ছাড়িয়ে যান লিটন। আগের রেকর্ডটি ছিল ১১ বছর আগের। যা দুই দিন আগেই ভাঙেন খোদ তামিম। এবার তার ১৫৮ ছাড়িয়ে গেলেন লিটন। শেষ অব্দি তার ব্যাট থেকে এসেছে ১৭৬ রান। আর দেশসেরা ওপেনার তামিম শেষ করেন ১০৯ বলে ১২৮ রানে রানে।
আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় খেলা বন্ধ থাকায় ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমেছে ৭ ওভার। ম্যাচের দৈর্ঘ্য ৪৩ ওভার। গোটা ম্যাচেই পাত্তা পেলেন না জিম্বাবুয়ের বোলাররা। নতুন করে খেলা শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ ৯ ওভার ৪ বলে করে ১৪০ রান।
এর আগে তামিম ইকবাল-লিটন দাস গড়েন নতুন ইতিহাস। দু'জন মিলে ভাঙেন প্রায় ২১ বছর আগের এক রেকর্ড। ওয়ানডেতে নিজেদের সর্বোচ্চ রানের উদ্বোধনী জুটির দেখা পেলো বাংলাদেশ। আগের রেকর্ডও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। সেই ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মেহরাব হোসেন ও শাহরিয়ার হোসেন উদ্বোধনী জুটিতে তুলেন ১৭০ রান।
এই জুটির রেকর্ড গড়ার ওভারেই লিটন তুলে নেন সেঞ্চুরি। এই সিরিজে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ওপেনার তুলে নিয়েছেন তার দ্বিতীয় শতক। ক্যারিয়ারের তৃতীয় সেঞ্চুরির দেখা পেলেন লিটন। ১১৪ বলে তিন অঙ্কের ম্যাজিকেল স্কোরে পা রাখেন লিটন। এই ওপেনার সেঞ্চুরিতে পৌঁছতে হাঁকান ১৩ চার।
তামিমের ব্যাট থেকেও এসেছে শতরান। ওয়ানডেতে এটি এই ওপেনারের ১৩ নম্বর ওয়ানডে সেঞ্চুরি। দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি তারই। ৩০ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে পেলেন দ্বিতীয় শতরান। ৯৮ বলে পা রাখেন তিন অঙ্কের স্কোরে।
এই জুটিতে গড়া হয়েছে ইতিহাস। ওয়ানডেতে দেশের সেরা জুটির রেকর্ড গড়েন তামিম ও লিটন দাস। টপকে গেলেন সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহর ২২৪ রানের জুটিকে। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পঞ্চম উইকেটে রেকর্ডজুটি গড়েন সাকিব-মাহমুদউল্লাহ। তাদের পেছনে ফেলে শুক্রবার সিলেটে লিটন-তামিম করলেন ২৯২ রান।
সব মিলিয়ে নেতা মাশরাফিকে জয়ে বিদায় দিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ দল। অধিনায়ক হিসেবে ৫০তম ওয়ানডে ম্যাচ জয়ের পথে তৃপ্তি নিয়েই মাঠ ছাড়লেন নড়াইল এক্সপ্রেস। রঙিন এক বিদায় রঙিন এক ক্রিকেটারের!
সংক্ষিপ্ত স্কোর-
বাংলাদেশ: ৪৩ ওভারে ৩২২/৩ (তামিম ১২৮*, লিটন ১৭৬, মাহমুদউল্লাহ ৩, আফিফ ৭; মুম্বা ৩/৬৯)।
জিম্বাবুয়ে: (৪৩ ওভারে লক্ষ্য ৩৪২) ৩৭.৩ ওভারে ২১৮/১০ (কামুনহুকামউই ৪, চাকাভা ৩৪, টেইলর ১৪, উইলিয়ামস ৩০, মাধেভেরে ৪২, রাজা ৬১, মুতুমবামি ০, মাটোমবোদজি ৭, টিরিপানো ১৫, মুম্বা ৪* সুমা ০; মাশরাফি ১/৪৭, সাইফ ৪/৪১, মুস্তাফিজ ১/৩২, আফিফ ১/১২, তাইজুল ১/৩৮)।
ফল: ডাকওয়ার্থ ও লুইস পদ্ধতিতে ১২৩ রানে জয়ী বাংলাদেশ।
সিরিজ: ৩ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশ ৩-০ তে জয়ী।
ম্যাচসেরা: লিটন দাস।
সিরিজ সেরা: তামিম ইকবাল ও লিটন দাস।