মাছ খেতে গেলে গলায় অনেক সময় কাঁটা ফোঁটে। একদলা ভাত, কলা বা একটুখানি লেবুর রসে সে কাঁটা নেমে যায়। তবে কখনও কখনও গলায় ফুঁটে থাকা কাঁটা ভোগায় বহুদিন। সমাজে নারীর চিত্রটা এখন কী? উত্তরে গড়গড়িয়ে বেশিরভাগই বলে উঠবেন- হ্যাঁ, এখন তো বলতে গেলে কোনো মেয়েই বসে নেই। গ্রাজুয়েশন শেষ করেই যে যার মতো ক্যারিয়ার শুরু করছে। সংসার আর সন্তান লালন পালনই নয়, সমানে কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে নারী। কিন্তু একথাও এখন গৎবাঁধা লাগে। নারী কতটা ঘর থেকে বের হলো সেকথাই বলা হয় কিন্তু ওই কর্মক্ষেত্র সামলে নারী যখন ঘরে ফেরে তখনকার কথা বলতে চাচ্ছি। একেবারেই ঘরের কথা। যেখান থেকেই বন্ধনের শুরু ও শেষ। একটা উদাহরণ দিয়েই বলি-
মোহাম্মদ নাসীর উদ্দীনের (ছদ্মনাম) মেয়ে নিপা পারভীনের (ছদ্মনাম) বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছিল যে কারণে তা এসময়ে ভাবলে খুবই ঠুনকো লাগে। সময়টা ২০০৯ সাল। ফেসবুক অতটা শোরগোল ফেলেনি। ভার্সিটির এক ছোটভাইকে বাঁচাতে নিপা ও তার কয়েক বন্ধু মিলে রক্ত ও টাকা জোগাড় করছিল। দুঃখজনভাবে নিপাকে কাজটি পরিবারের কাছে লুকিয়েই করতে হচ্ছিল। দারুণ রক্ষণশীল ও কথিত ভদ্র পরিবারের মেয়েরা রাস্তায় রাস্তায় বাক্স নিয়ে টাকা তুলতে যায় না। বরং চুপচাপ ক্লাস করে রিকশায় উঠে বাসায় ফেরত আসাই নিয়ম। যাই হোক, ওসব টাকা তোলা, রক্ত জোগাড় হলো কিনা, ডোনার ম্যানেজ এসব কারণেই সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে হতো নিপাকে। মূল দায়িত্বটা ছিল তূর্যস নামের এক বন্ধুর। ফলে তার সঙ্গে বাকিরা যোগাযোগ রাখতো। নিপার পরিবার তার এ পরোপোকার ধর্মের কথা না জানলেও স্বামী আজীজ নূর বিষয়টা জানতেন এবং ভীষণ রকম অসুন্তষ্ট ছিলেন। নিপার রাতদিন একধিক পরপুরুষের (বন্ধু, ডোনার ইত্যাদি) সঙ্গে কথা বলা ও রাস্তায় ভিক্ষা (একজন মানুষকে বাঁচাতে অর্থ জোগান) করা তার পছন্দ ছিল না। একবার রাগ তুঙ্গে ওঠায় নিপার বাবাকে জানালেন। উল্লেখ্য, নিপা ও আজীজের কাবিন হয়ে ছিল কিন্তু তখনও তুলে নেয়নি। ফলে নিপা বাবার বাড়িতেই থাকত। নিপার বাবা কান থেকে আজীজের ফোন নামিয়েই অকথ্য ভাষায় মেয়েকে গালাগাল করলেন। কেন স্বামীকে ঠকিয়ে পরপুরুষদের সঙ্গে সে ফোনালাপে লিপ্ত সে প্রসঙ্গে অপবাদ দিলেন। নিপার মতো পিতৃভীরু শান্ত মেয়ে কোনোভাবেই সমর্থ্য হলো না তার প্রকৃত কর্মের কথা বাবাকে বোঝাতে। বন্ধুরা মিলে যে একটি ভালো কাজ তারা করার চেষ্টা করছে সেটা তার পক্ষে বোঝানো সম্ভব হলো না। প্রসঙ্গক্রমে আরও অনেক ঘটনা ঘটে। কিন্তু এখানে তার উল্লেখের প্রয়োজন নেই। এক পর্যায়ে খুব দ্রুতই তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়।
এবার আসি মোহাম্মদ নাসীর উদ্দীনের ছোট মেয়ে ও নিপারই ছোট বোন দীপার (ছদ্মনাম) কথায়। দীপার স্বামী দীপন পেশায় একজন অভিনেতা। পাশাপাশি তিনি ব্যবসা করেন। দীপাও কর্মজীবী, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। দুজনেই ভীষণ রকম অসাম্প্রদায়িক ও শিল্পপ্রেমী বলে সংসারে সাধারণ গোঁড়ামি নেই বলে বলা যায় তারা সুখী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দীপন অভিনয় করে। সেহেতু খুব স্বাভাবিকভাবেই তাকে অন্যান্য নারী মডেল বা অভিনেত্রীদের সঙ্গে হরহামেশাই সময় কাটাতে হয়, যোগাযোগ রাখতে হয়। বিয়ের পর একসঙ্গে থাকার ক্ষেত্রে কিছু অলিখিত নিয়মকানুন যেন এমনিতেই বর্তে যায়। যেমন- কর্মজীবী হলেও দুজনকেই একটা নির্দিষ্ট সময় বাড়ি ফেরা, খাওয়া-ঘুমানোর একটা নির্দিষ্ট রুটিন, দুজন দুজনকে সময় দেয়া, যে যেমন পেশাতেই থাকুক না কেন বৈবাহিক সম্পর্ক রক্ষায় একটা নির্দিষ্ট বাউন্ডারি তৈরি করা ইত্যাদি।
বিয়ের পর যেহেতু একসঙ্গে থাকছে সেহেতু দীপনের ছোটখাট অনেক ঘটনাই চোখে পড়ছে দীপার। যা আশপাশের সবাই ও দীপার পরিবারের কাছে সমর্থনযোগ্য হলেও কখনও দীপার পক্ষে গ্রহণ করা ঢেঁকি গেলার মতো কঠিন হয়ে পড়ছে বৈকি। যেমন- গভীর রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীপনের ফোনে কথা বলা। মাঝে মাঝে মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে দীপা দীপনকে বিছানায় পায় না। তখন পাশের ঘরে ফোনালাপে ব্যস্ত থাকে সে, দীপা প্রবেশ মাত্রই ফোন কেটে দেয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন অভিনেত্রীকে করা নানান মেসেজ, কমেন্ট দেখে দীপা ভেঙে পড়ে বা মুশড়ে পড়ে না তা নয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে দীপন বিরক্ত হয়, কখনও জবাব দেয় না বা অনেক সময়ই অশান্তি হয়। দীপনের পরিবারের কাছে দীপনের অসময়ে ফোনে কথা বলা বা অভিনিত্রেীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রফেশনের অংশ, দীপার পরিবারও তাই মনে করে। অপরদিকে দীপনের এসব কর্মকাণ্ডে দীপার অসম্মতিতে আপত্তি প্রকাশ করে দীপার পরিবার ও আশপাশের মানুষজনও। এবার প্রশ্ন হলো, বাবা মোহাম্মদ নাসীর উদ্দীনের বক্তব্য কী এ বিষয়ে? তার বক্তব্য- দীপন অভিনেতা। রাত করে বাড়ি ফিরতেই পারে। একাধিক সেলিব্রেটি ও নারীর সঙ্গে দীপনের সখ্য, সময় কাটনো ও ফোনালাপ থাকতেই পারে। এটা তার প্রয়োজন। কঠিন করে দেখার কিছু নেই। দীপা তো বিয়ের আগেই জানতো দীপন পেশায় একজন অভিনেতা। তাহলে কেন তার সঙ্গে অন্য অভিনেত্রীদের নিয়ে বিরক্ত দীপা? এটা দীপার সংকীর্ণতা নয় কী! দীপা এসব পাগলামী করলে সংসারে অশান্তি বৈ কিছু আসবে না।
এবার আসামি দীপার প্রসঙ্গে বলি- দীপা একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। কর্মক্ষেত্রে সে প্রশংসিত ও গুরুত্বপূর্ণ। অফিসের পরও সহকর্মীদের ফোন তাকেও তুলতে হয়। সেরে নিতে হয় প্রয়োজনীয় কথা। কিন্তু তা রাত ৩-৪টা বাজে নয়! কারণ দীপা আদতেই প্রফেশনাল। ফলে ব্যক্তিগত জীবন ও কর্মজীবন সে আলাদা করতে পারে। যার কারণে তার অ্যাসাইনমেন্ট টাইম কখনোই রাত ১২টার পর বা মধ্যরাতে হতে পারে না।
এখন দীপন ও দীপার বিষয়টা একটু উল্টে-পালে্ট বলি, দীপার বাবা মোহাম্মদ নাসীর উদ্দীন বা স্বামী দীপন কি কখনো মেনে নেবে আজ দীপা যদি অফিস আওয়ারের পর কোনো পুরুষ সহকর্মীকে নিয়ে একা ডিনারে যায়, তার প্রস্তাবে বাইকে চড়ে লং ড্রাইভে যায়, মধ্যরাতে দীপনকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে পাশের ঘরে বসে পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে ফিসফিস করে ফোনালাপ করে।
তখন কি বাবা নাসীর উদ্দিন ও উদারনৈতিক স্বামী অভিনেতা দীপন কি বলবে- দীপনের ন্যায় দীপাও তার প্রফেশনে ব্যস্ত! তার এসব বিষয় নিয়ে অসম্মতি প্রকাশ করা যাবে না। এসব কাজ তার প্রফেশনের অন্তর্ভুক্ত! তখন কি নিপার মতোই তার গায়ে লেপে দেয়া হবে না চরিত্রহীনার ট্যাগ? আদর্শ স্ত্রী হতে না পারার লেবেল? যদি তাই হয় তাহলে কেন প্রফেশনের আঁচল দিয়ে পুরুষের অনৈতিক আচরণকে ঢেকে রাখতে যায়, পুষে রাখতে চায় আমাদের পরিবার, সমাজ, সকলে? এখনও স্বাভাবিক নিয়মে সম্মান বজায় রেখে কাজ করতে নারীকে অনেকটাই হিমশিম খেতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘরে না ফিরতে পারলে নিজের পরিবারই নারীকে নানান কটুক্তি করে। যে কাজ করলে রাতে বাড়ি ফিরতে হয় সে কাজ ছেড়ে দাও এমন কথা আজও কোনো নারী শোনে না নিজের পরিবার বা স্বামীর কাছ থেকে তা কিন্তু নয়।
সুতরাং কোন কাজটি প্রফেশনের অন্তর্গত ও কোনটি নয় তা নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবারই বোধগম্য হওয়া উচিৎ। নারীর একার সংযম, বৈধতাজ্ঞান ও সম্মানে সমাজ টিকবে কি?