দুটো ছোট্ট উদাহরণ দিয়েই শুরু করছি- পৃথা ও তার স্বামী ইমনের মধ্যকার দাম্পত্য কলহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আর নিজেদের মধ্যে থাকে না। যে বিষয় নিয়েই ঝগড়া হোক না কেন, একটা পর্যায়ে ইমন পৃথার বাবাকে ফোন দিয়ে বলে- আপনার মেয়েকে এসে নিয়ে যান। তাকে আর সামলাতে পারছি না। এ ঘটনা ঘটাতে মানে বাবাকে ফোন দিতে রাত দেড়টা বা দুটো বাজলেও দ্বিধা করে না পৃথার স্বামী।
অন্য আরেকটি উদাহরণ টানছি- শম্পার চেয়ে বয়সে ১৩ বছরের বড় তার স্বামী। এক প্রকার শম্পার অসম্মতিতেই এই ভদ্রলোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল তার বাবা। একে তো মানসিক যোগাযোগ নেই, দ্বিতীয়ত, শারীরিক সম্পর্কটা এমন যে- ক্ষুধা মিটিয়ে ছুঁড়ে ফেললাম খাবারের প্যাকেট। শ্বাশুড়ির সঙ্গেও সমঝোতা নেই শম্পার। বিয়ের পর বহু কষ্টে ঘর-বাড়ি সামলে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ব্যাচেলর ফাইনাল দিয়েছে। ছোটখাট এটা সেটা নিয়ে সারাক্ষণ মানসিক নির্যাতন চলে তার শ্বশুরবাড়িতে। বেশ কয়েকবার রাগ হয়ে বাবার বাড়ি চলে এসেছিল শম্পা, চেয়েছিল ডিভোর্স নিতে। কিন্তু প্রথা অনুযায়ী, বাবা-মা শম্পার স্বামীকে ডেকে ক্ষমা চেয়ে মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে, মানসম্মানের দোহাই দিয়ে তুলে দিয়েছে তার হাতে।
উপরের দুটো ঘটনাই হলো ‘সিদ্ধান্ত’ জারি। প্রথমটি স্বামী সিদ্ধান্ত দিচ্ছে- পারছি না, আপনার মেয়েকে এসে নিয়ে যান। দ্বিতীয়টি বাবা-মা সিদ্ধান্ত দিচ্ছে- বিয়ের পর মেয়ের আসল ঘর হচ্ছে শ্বশুরবাড়ি। ডিভোর্স ভালো মেয়েরা দেয় না। মেয়ের জামাইকে ডেকে তুলে দিলো তারা। এবার আসল প্রশ্ন- মেয়েটির কী অবস্থা, সে কোথায় থাকতে চায়, তার বক্তব্য কী বা সেই বক্তব্য জরুরি কিনা, কেউ জানতে চায় কিনা। এই নিয়ে যান আর তুলে দেয়ার ঘনঘটায় তার অস্তিত্ব চাপা দিয়ে পিষ্ট করার চল আধুনিক শিক্ষিত পরিবারেও বিরাজমান।
ব্যাপারটা যেন অনেকটা এমন- সুপারশপ থেকে কোনো পণ্য কিনে বাড়ি ফেরার পর অনেক সময়ই দেখা যায় ক্রয়কৃত পণ্যটি ভালো লাগছে না। অথবা মনে হচ্ছে, পণ্যের তুলনায় দামটা বেশি কিংবা সেটা আপনার জন্য ভালো হবে কিনা সন্দেহ জাগছে। এমন অবস্থায়, নাহ্ পোষালো না ভেবে ফেরত দিয়ে আসেন বা পণ্যটি বদলে অন্য কিছু ক্রয় করে আনেন। অন্য কোথাও কি হয় বিশদ না বলে বরং এদেশের অধিকাংশ পরিবারগুলোয়ও ঠিক এই পণ্য কেনা ও ফেরত দেয়ার মতো ঘটনা ঘটতে দেখা যায় বিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে। তা সেই মেয়ে কর্মজীবী, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, গৃহিনী, সন্তানের মা যেমনই হোন না কেন। সে কী চায়, সে বাবার বাড়ি ফিরে যাবে নাকি তার স্বামীর সঙ্গে থাকবে না একা বাসা ভাড়া করে বা হোস্টেলে থাকবে সেই সিদ্ধান্ত কি তার নয়? আর যদি না হয় তাহলে প্রশ্ন আছে এখানেও। ওই নারী, মানে যাকে পাঠানোর এবং ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে স্বামী বা পরিবার সেই নারীকে আসলে কী ভাবা হচ্ছে? নিশ্চয়ই মানুষ নয়। কারণই মানুষই যদি ভাবা হয় তাহলে, সেই মানুষের ভাবনা, সুবিধা-অসুবিধা, চাওয়া, সম্মানবোধ ও সিদ্ধান্তকে তো গুরুত্ব দেওয়ার কথা।
আমাদের মগজে কি দিনের পর দিন একটা বিষয় স্থায়ী হয়ে যায়নি যে- কন্যা সন্তানকে বিয়ে দেয়ার পর তার বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত তার স্বামী নেবে, তার কোনো বক্তব্য থাকবে না। আবার স্বামী তাকে পাঠিয়ে দিলে তাকে বাবার বাড়িই থাকতে হবে ওই আশ্রিতের মতোই। আর দুইপক্ষের ফেরত দেয়া নেয়ার খেলায় কোনো আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন নারী যদি প্রতিবাদ করে, যদি বেছে নিতে চায় নিজের মতো থাকার জায়গা সেখানেও কিন্তু আঁচড় দেয় নিজের লোকেরাই। মন চাইলে নেব আবার মন চাইলে ফেরত দেব এই কলুষিত চর্চার চেয়ে যার যার জায়গা থেকে নিজের সিদ্ধান্ত নেয়াটা জরুরি। বাবা বা স্বামী যদি কন্যা বা স্ত্রীকে সঙ্গে রাখবেন কিনা সিদ্ধান্ত জারি করতে পারেন তাহলে সেই কন্যা বা স্ত্রী বাবার বাড়ি যাবে নাকি স্বামীর সঙ্গে থাকবে না নিজের থাকার জায়গা খুঁজে সেটাও তার সিদ্ধান্ত। কারণ নারী তো ফেরতযোগ্য বা পণ্য কোনোটাই নয়! সে তো মানুষ, সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ও রাষ্ট্রের নাগরিক।