মুঘল বাদশাহ জাফরের বয়স পঁয়ষট্টি আর মেয়েটির সতেরো। বাদশাহর অন্য বেগমের ছেলেরাই কেউ কেউ মেয়েটির থেকে বয়সে বড়। মেয়েটি লাল কেল্লায় নামল পালকি থেকে নববধূর বেশে। দেখছিল লালকেল্লার লাল পাথর, মুঘল ঐতিহ্য। তার নবযৌবনা চোখে স্বপ্ন। মুঘল হেরেমে এই নতুন সম্রাজ্ঞীর আনুষ্ঠানিক নাম হলো বেগম জীনাত মহল। অস্তগামী মুঘল উত্তরাধিকারে নারীশক্তি রূপে অচিরেই যে তাকে পালন করতে হবে ঐতিহাসিক দায়িত্ব, সে কথা নবাগত তরুণ রানি মোটেও অনুমান করতে পারেননি।
বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর শাসন ও রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে কবিতা চর্চা বেশি ভালোবাসতেন। রীতিমতো কবি ছিলেন তিনি। ছিলেন উচ্চমানের গীতিকার। উর্দু ও ফারসি ভাষায় ভাল দখল ছিল। গ্রন্থাগার ছিল নিজস্ব। তার আলফাজ বা কথামালা দিল্লির কবিতা-প্রেমীদের প্রিয় ছিল। বাদশাহ গান শুনতে এবং মঞ্চাভিনয় দেখতেও ভালোবাসতেন।
সমকালের অন্যতম প্রধান ও শ্রেষ্ঠ কবি মির্জা গালিব তখন দিল্লি-আগ্রার জনপথে নৈঃশব্দ্য খোঁজেন গভীর রাতে, নেশার ঘোরে মাঝে মাঝে গেয়ে ওঠেন স্বরচিত গজল। বাদশাহর তাকে সভায় আগলে রেখে দিলেন মুঘল দরবারে। ভূষিত করলেন একের পর এক উপাধিতে, দবির-উল-মুলক, নজম-উদ-দৌলা, মির্জা নোশা। সেই সময়ে নবাব, বাদশাহর বংশের না হলে কেউ নামের আগে 'মির্জা' বসাত না। আসাদুল্লাহ খান গালিবকে দেয়া হয় 'মিজা' ব্যবহারের সম্মান ও মর্যাদা।
গান, বাজনা, কবিতার প্রবাহের বাইরে দেশ তখন ক্রমে ক্রমে শত্রু কবলিত হচ্ছে। ১০০ বছর আগে পূর্বের বাংলা অঞ্চলে ইংরেজ কোম্পানি ব্যবসা করার সুযোগে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল। মাদ্রাজ, বোম্বাই, সুরাট প্রভৃতি দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকার সমুদ্রতটে কোম্পানির শক্তি আগে থেকেই বেশি। সমুদ্র পেরিয়ে আসা ইংরেজ কোম্পানী পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চল দখল করে উত্তর ও পশ্চিম দিকে এগিয়ে আসছে। ভারতের কেন্দ্রে সমাসীন সম্রাটকেও চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ইংরেজ বেনিয়ার দল।
নামমাত্র সম্রাট রেখে বাহাদুর শাহকে ইংরেজ কোম্পানি পেনশনে দিয়ে জীবন কাটানোর ব্যবস্থা করেছে। কোম্পানির সিভিল সার্জেন্টরা ঠিক করে দেয় প্রশাসনিক কর্তব্য। বাহাদুর শাহ শীলমোহর দেন, না দিলেও চলে। তিন বছর বাদশাহী জীবন কাটিয়ে ক্লান্ত বাহাদুর শাহ আবার নিকাহ করেন আর তখন জিনাতের আগমন ঘটে মুঘল হেরেমে।
জিনাত অল্পবয়সী মেয়ে। তবে চঞ্চল ও লাজুক নয়। মেয়েলি তেহজীবের আড়ষ্টতা নেই কথাবার্তায়। বৃদ্ধ বাদশাহের ভালো লেগে গেল ব্যতিক্রমী চরিত্রের 'অ-মেয়েলি' মেয়েটিকে। অতি সাধারণ পরিবারের মেয়েটি হল বাদশাহর চতুর্থ বেগম। বিগত যৌবনা অন্যান্য বেগমরা বিরক্তি নিয়ে দেখলেন, একটা ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ে পালকি থেকে নেমে বাদশাহের সঙ্গে মহলে প্রবেশ করছে। তার নয়া বেগম হয়ে আসা মেয়েটিই বেগম জীনাত মহল।
অল্প সময়ের মধ্যেই অন্দরমহলের অন্যান্য সহচরীদের এবং প্রজাদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন জীনাত মহল। বৃদ্ধ বাদশাহের যুবতী ভার্যা, তাই বাদশাহর ওপরেও প্রভাব ছিল যথেষ্ট। উনি যা আবদার করতেন, বৃদ্ধ তাই-ই মেনে নিতেন। উনি বাপের বাড়ি বা অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য পালকি নিয়ে রাজপথে এলে, যে পথ দিয়ে যেতেন সেই পথে ডঙ্কা বাজত। লোকমুখে নাম হয়ে গেছিল 'ডঙ্কা বেগম'। লাল কুঁয়াতে তার প্রাসাদোপম মহলের নামও হয়ে গেল জীনাত মহল। ১৮৪৬ সালে বাদশাহী খাজানার অনেকটাই খরচ করে নির্মাণ করা হয় প্রাসাদ জীনাত মহল। লাল কুঁয়ার সেই জিনাত মহল অযত্নে পড়ে আছে। যেমন অযত্নে পড়ে রয়েছে দিল্লির অনেক কিছুই।
অস্তগামী দিল্লির শাসনের মধ্যেও জিনাত মহল নিজের অবস্থান বাড়াতে থাকেন। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বাইশ জন সন্তানের মধ্যে নিজের সন্তানকে উত্তরাধিকারের প্রতিযোগিতায় সামনে নিয়ে আসেন জিনাত। মুঘল অভিজাতদের পাশাপাশি ইংরেজ প্রশাসকদেরকেও হাতে রাখেন তিনি। কিন্তু আচমকাই তখন এসে পড়ে সিপাহী বিদ্রোহ।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ একেবারে মোড় ঘুরিয়ে দিল সবার ভাগ্যের। কোম্পানির সাহেবরা জানতেন, অসুস্থ বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফর যা-ই ভাবুন বা করুন, বেগম জীনাত মহল ইংরেজদের বিপক্ষেই থাকবেন। হলও তাই, উনি লাল কেল্লার দরজা খুলে দিলেন মীরাটের বিদ্রোহী সিপাইদের জন্য। বাদশাহর যুবক শাহজাদারাও এক এক করে ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলে নেমে পড়ল বিদ্রোহের লড়াইয়ে। কিন্তু বেগম সুকৌশলে নিজের ছেলেকে সরিয়ে রাখলেন বিদ্রোহের আগুন থেকে, ওঁর তখনও স্বপ্ন, এইসব মিটে গেলে জওয়াঁ বখতকেই তখতে বসাতে হবে। নিজে সবরকম ভাবে বিদ্রোহে সক্রিয় হয়ে উঠলেন, ছেলেকে রেখে দিলেন আড়ালে। গায়ে আঁচ আসতে দিলেন না।
১২ই মে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ হঠাৎই দরবার ডাকলেন অনেক দিন পর। জিনাতের কথা মতোই মুঘল অভিজাত ও সিপাইদের প্রতিনিধিরা সম্রাটকে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার আর্জি জানাল। অথর্ব বৃদ্ধ, নেতৃত্ব দিতে অক্ষম, চিকের আড়ালে বসে থাকা বেগম জিনাতের দিকে তাকালেন ইশারায়। বেগম অপেক্ষা করার ইঙ্গিত দিলেন। সম্রাটও সবাইকে সবুর করতে বললেন।
এদিকে ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল বিপ্লব আর বিদ্রোহের আগুন। ১৬ই মে সিপাহীরা প্রায় পঞ্চাশজন ইংরেজকে একদিনে হত্যা করল। দিল্লির ইংরেজ আধিকারিক থেকে ইংরেজ বন্দি, যাকে পেল, তাকেই। হত্যা করা হল সিভিলিয়ান ইংরেজ পরিবারের মানুষজনকেও। শুরু হল লুঠ। লুঠ এবং অরাজকতায় অসহায় ছিলেন দিল্লির বৃদ্ধ বাদশাহ। কয়েক মাস দিশাহীন খণ্ড-যুদ্ধের পর, দিল্লিকে দ্রুত ঘিরে ফেলল কোম্পানির লাল ফৌজ। উপযুক্ত সেনাপতি এবং যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার মত ব্যক্তির অভাব ছিল। অভিজ্ঞতা ছিল না শাহজাদাদের। বাবরের বংশধররা ভারতীয় প্রজাদের নেতৃত্ব দিয়ে যুদ্ধ করতেই ভুলে গিয়েছিলেন চারশো বছর পর।
পরাস্ত হল অসম ক্ষমতার বিদ্রোহ, অন্য কোথাও থেকে সামরিক সাহায্যও এল না। বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফরের বয়স তখন বিরাশি। অসুস্থ শরীর নিয়ে আত্মগোপন করলেন সম্রাট হুমায়ূনের সমাধিসৌধে। বাদশাহর প্রধান উপদেষ্টা এবং উজির হাকিম আহসানউল্লাহ খাঁ পরামর্শ দিলেন, 'আত্মসমর্পণ করুন।’ সেই পরামর্শ মতো বৃদ্ধ আত্মসমর্পণ করলেন, তাতে যদি পরিবার বাঁচে। কিন্তু তা হল না। বিশ্বাসঘাতকতা করলেন আহসানউল্লাহ, ইংরেজদের পক্ষে চলে গিয়ে তাদের হাতে প্রমাণ তুলে দিলেন। জানালেন, বাদশাহ সপরিবার কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র করেছেন। ইংরেজ অপেক্ষায় ছিল মুঘল উত্তরাধিকারদের নিধনের জন্য।
সুযোগ পেয়েই শাহজাদা মির্জা মুঘল এবং মির্জা খিজির সুলতানকে দিল্লি গেটের সামনে গুলি করে হত্যা করল ইংরেজ মেজর উইলিয়াম হডসন। হত্যা করা হল বাদশাহর পৌত্র আবু বখতকেও। তারপর হুমায়ূনের সমাধিসৌধ থেকে বাদশাহকে বার করে নিয়ে যাওয়া হল লাল কুয়াঁর জিনাত মহলে। বন্দী হলেন বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর এবং জিনাত মহল। যথেষ্ট অপমান এবং বিদ্রূপের শিকার হলেন অসুস্থ এবং অথর্ব বৃদ্ধ বাদশাহ। ইংরেজ ঘোষণা করল, দিল্লির বিদ্রোহ দমন করা গেছে, দিল্লি আমাদের দখলে। ওদিকে তখন লাল কেল্লার সামনে কামনের মুখে বেঁধে তোপ দেগে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক বন্দি বিদ্রোহী-সিপাইকে। সপরিবারে দিল্লি-আগ্রা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে সিঁদুরে মেঘ দেখা প্রজারা। মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধদের আশ্রয়ে রাখতে ব্যর্থ প্রাচীন নগরী দিল্লি পরিণত হলো মৃত্যুপুরীতে।
সাজানো আয়োজনের মাধ্যমে ৪১ দিন ধরে একাধিক অপরাধের ধারায় বিচার চলল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর এবং জিনাত মহলের। ২১ জন সাক্ষী, ১৯টি শুনানি। তারপর সাজা ঘোষণা হল। যাকে এতদিন বলা হত 'অথর্ব বৃদ্ধ, নেতৃত্ব দিতে অক্ষম', তিনিই হয়ে গেলেন দিল্লি বিদ্রোহের প্রধান অভিযুক্ত। দণ্ডিত হলেন ভারতের শেষ মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর। পরিসমাপ্তি হলো মুঘল শাসনের। ভারত পুরোপুরি অধীনস্থ হলো ব্রিটিশের।
১৭ বছর বয়সে বেগম হয়ে লাল কেল্লায় পালকি থেকে নামা চঞ্চল মেয়েটি, ৩৪ বছর বয়সে তার বৃদ্ধ অসুস্থ বাদশাহের সঙ্গে নির্বাসনে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। বয়স এবং অসুস্থতার কারণে 'প্রধান অভিযুক্ত'র জেল বা মৃত্যুদণ্ড হল না, কিন্তু নির্বাসন হল একেবারে দেশের বাইরে রেঙ্গুনে। বাহাদুর শাহ জাফরের অমূল্য গ্রন্থাগারের সব পুঁথি বাজেয়াপ্ত করল কোম্পানি সরকার। বাজেয়াপ্ত করল অনেক বাদশাহী সম্পত্তি, অর্থ; পেনাল্টি অফ রিবেলিয়ন। তারপর বেশ কয়েকটি গোরুর গাড়িতে করে পরিবার এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে পূর্বপুরুষের দিল্লিকে চিরবিদায় জানিয়ে ভোর চারটের সময়ে শেষ রাতের অন্ধকারেই নির্বাসনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন প্রাক্তন-বাদশাহ, সঙ্গে রানি। তাদের ব্রিটিশ 9th Lancers প্রহরা দিয়ে চললো। দিনটি ছিল ১৭ই অক্টোবর, ১৮৫৮। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, পরিবারের কেউ রেঙ্গুন যেতে চাইলেন না বাদশাহর সঙ্গে। সঙ্গে গেলেন শুধু বেগম জিনাত মহল আর দুই শাহজাদা - জওয়াঁ বখত এবং শাহ আব্বাস।
জওয়াঁ বখতকে বাদশাহ দেখার খোয়াব অপূর্ণ রয়ে গেল জিনাতের। বাদশাহীও থাকল না। বিদ্রূপের জীবন আর ভূলুন্ঠিত সম্মান নিয়ে দিল্লিতেও থাকতে চাইলেন না ডঙ্কা বেগম। বরং, শত অভিযোগ থাকলেও সেই অসহায় অসুস্থ বৃদ্ধের নির্ভরযোগ্য সঙ্গিনী হয়ে চলে গেলেন রেঙ্গুন।
ভারতের প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রামে দেশের দুই প্রান্তে দুই ভূপতির বীরোচিত ভূমিকা ইতিহাসের অংশ। একজন লখনৌর ওয়াজিদ আলি শাহ এবং আরেকজন দিল্লওির বাহাদুর শাহ। দুজনেই কবি, সংস্কৃতিবান মানুষ, শাসক হিসাবে দুজনেই নির্বাসিত। একজন কলকাতার মেটিয়াবুরুজে আর অন্যজন বার্মার রেঙ্গুনে। দুজনেই তাজ হারালেন। দুজনেরই বেগম বিদ্রোহে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
পরাজয়, সাম্রাজ্য আর অপমানের স্মৃতি নিয়ে আরো চার বছর বেঁচে ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর। অন্তিম সময়ে খুব মানসিক কষ্ট পেয়েছিলেন, নিজের দেশের মাটি পেলেন না বলে। বাদশাহর ইন্তেকালের পর 'মুঘল বাদশাহ' উপাধি বরখাস্ত করল ইংরেজ সরকার। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শেষ, ভারতে ব্রিটিশ সরকারের শাসননজারি হয়েছে আর সম্রাটের জায়গায় বড়লাটের আসন কায়েম হয়েছে। বেগম জিনাত মহল জীবিত ছিলেন আরো চব্বিশ বছর। রেঙ্গুনেই থাকতেন, দেশে ফেরার ইচ্ছাও প্রকাশ করেননি। তার শেষ বয়সের একটি আলোকচিত্রে তার চোখে বেদনার মেঘ জমে আছে। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ১৮৮৬ সালে। বাদশাহর পাশেই সমাধিস্থ হলেন তিনি রেঙ্গুনে।