তার সাথে কয়েক প্রজন্মের সখ্যতা ও সম্পর্ককে বলা যায়, নিবিড় ও রোমান্টিক। স্কুল পালানোর প্ররোচনা ছিল তার মধ্যে। আর ছিল তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার জন্যে রূপালি পর্দায় মিষ্টি ও নান্দনিক অভিনয়ের মোহাবিষ্ট আমন্ত্রণ। রংবাজ, সুজন সখী, সারেং বৌ হয়ে তার সাথে মিশে আছে লক্ষ-কোটি মানুষের কৈশোর-যৌবনের ভালোলাগা ও ভালেবাসা।
কয়েক দশক নায়িকার অমলিন উপস্থিতি শেষে ৭০ বছরের গ্ল্যামার-জীবনের অবসানে পরলোক গমন করেছেন কবরী (জন্ম-১৯ জুলাই ১৯৫০, মৃত্যু-১৭ এপ্রিল ২০২১)। চট্টগ্রাম শহরের উপান্তে কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট ব্রিজ পেরুলেই দক্ষিণের জনপদ বোয়ালখালী উপজেলায় কবরীর জন্মভিটা। চট্টগ্রাম শাবানা, অঞ্জু ঘোষ এবং আরও অনেক চলচ্চিত্র তারকার জন্মস্থানও। তথাপি চট্টগ্রামের এক অখ্যাত মিনা পাল হুট করে ট্রেনে চেপে ঢাকায় এসে শুধু রূপের জৌলুস দেখিয়েই কবরী হয়ে যাননি।
মিনা পালকে কবরী করে তুলেছে নিজের কাজের প্রতি তার নিষ্ঠা এবং পড়াশোনার আগ্রহ, চলচ্চিত্রের প্রতি কমিটমেন্ট এবং মানুষ ও সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। ষাট দশকের শেষে শুরু করে তিনি যেভাবে নিজস্ব ঘরানা ও শৈলী বা স্টাইলের নির্মাণ করেছেন, তা বাংলা চলচ্চিত্রে বিরল। একাধিক নায়কের সঙ্গে বিচিত্র-বিভিন্ন পটভূমিতে অভিনয় করলেও কবরী নিজের স্বাতন্ত্রিক অবয়বে ছিলেন উজ্জ্বল। কারো প্রযত্নে বা কোনও নায়কের প্রসঙ্গ ধরে তিনি আলোচিত হননি, হয়েছেন নিজের ব্যক্তিত্বের সাফল্য ও কৃতিত্বে। ফলে তার মৃত্যুতে 'কবরী যুগ'-এর অবসান হলো। সত্যিকার অর্থেই, কাজের মধ্য দিয়ে তিনি ছিলেন 'যুগ নির্মাতা'।
ফলে, জাগতিক মৃত্যুতেই তার অবসান হবে না। তার চলচ্চিত্রসমূহ তাকে স্মরণের আঙিনায় সজিব রাখবে বহু বছর। এবং বাংলাদেশের নিম্ন ও মধ্য মেধার সাংস্কৃতিক জগতে প্রকৃত নায়িকা এবং নেতৃস্থানীয়, পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের কাঠামোতে তাকে দেখতে পাওয়া যাবে। কারণ, সম্ভবত তিনিই বাংলাদেশের বিরলতম নায়িকাদের একজন, যিনি 'স্মৃতিটুকু থাক' শিরোনামে আত্মজীবনী রচনা করেছেন, যা ২০১৭ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়।
উল্লেখ্য, কবরীর আত্মজীবনী কেউ অনুলিখন করেনি, তিনি নিজেই লিখেছিলেন। আত্মজীবনীটি তার সাহিত্যবোধ, শিল্পচেতনা ও জীবনবোধ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা দেয় এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে নিটোল স্মৃতি ও মূল্যায়ন উপস্থাপন করে।
কবরীর লেখনী তাকে উপমহাদেশ তথা বিশ্বচলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভাবানদের কাতারে শামিল করবে, যারা আত্মচরিতের মাধ্যমে সতত জীবন্ত থাকবেন বা আছেন। তিনি হলেন সেইসব সফল তারকাদের একজন, যিনি রূপালি পর্দার ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে সার্বজনীন রাজনীতির নায়িকায় পরিণত হয়েছিলেন। বাংলাদেশে এতোগুলো সাফল্য আর কোনও নায়িকা বা তারকার নেই। এগুলো সবই তার অধ্যবসায়ের ফলে একান্ত নিজস্ব অর্জন, যা তাকে সকলের চেয়ে আলাদা ও দ্যুতিমান করেছে।
অভিনয় থেকে রাজনীতি, সর্বত্র তিনি প্রবল প্রতিকূলতা ও বিরোধিতার মধ্য দিয়ে সাফল্যের দেখা পেয়েছেন। লড়ছেন সব সময়। পরাজয় মেনে আত্মসমর্পণ করেন নি। আত্মসম্মানের সাথে নিজের অবস্থান ও নীতিতে থেকেছেন অটল ও অবিচল। বাংলাদেশের মতো পেশী ও সন্ত্রাস কবলিত রাজনীতিতে তিনি হয়তো মৌলিক বা গুণগত কোনও পরিবর্তন আনতে পারননি। কিন্তু তিনি প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছেন গডফাদারদের।
করোনা কবলিত হয়ে পবিত্র রমজানের এক রাতে মিনা পাল থেকে সারাহ বেগমে রূপান্তরিত কবরী যখন চিরবিদায়ের পথে, তখন তার সাথে কোটি মানুষের ভালোবাসা, প্রীতি, শুভেচ্ছা ও সম্মান। এক জীবনে একজন মানুষের যত চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে, কবরী তার সবই অর্জন করেছেন স্বোপার্জিত সাফল্যে।
এবং নিজের জন্য এমন একটি পবিত্র ও ঐতিহাসিক নাম ধারণের সৌভাগ্যও অর্জন করেছেন তিনি, যে নাম পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত, মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূণ্যবতী স্ত্রী সারাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইসলামী ঐতিহ্যের মধ্যে, সারাহ নবী হযরত ইবরাহিমের স্ত্রী, যিনি হযরত ইসহাক বা আইজাক-এর জন্মদাত্রী। আর ইসহাক বা আইজাক হলেন রেবেকার স্বামী, ইয়াকুব বা যাকোবের পিতা এবং ইসরায়েলের বারোটি গোত্রের পিতামহ। এই ইয়াকুব থেকেই ইসরায়েল বংশের নামকরণ করা হয়েছে।