বাংলাদেশের উন্নয়ন-সম্পৃক্ত ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত সবার প্রিয় মানুষ এবং সত্যিকারের মানবাধিকার নেত্রী নাসরীন আপা ( নাসরীন পারভীন হক) ২০০৬ সালের এই দিনে (২৪ এপ্রিল ২০০৬) ঢাকায় নিজ বাসভবনের সামনে এক মর্মান্তিক গাড়ি দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি নারী সহ সমাজের অপরাপর সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার ও ক্ষমতায়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে অসামান্য কাজ করে গেছেন। নতুন প্রজন্মের তরুণ বন্ধুদের কাছে এমন একটা দিনে তার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়ার তাগিদ অনুভব করছি।
নাসরীন হক ১৯৫৮ সালের ১৮ নভেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মোহাম্মদ রফিকুল হক প্রকৌশলী ও মা জাহেদা খানম কবি হিসেবে পরিচিত। নাসরীন হকের ডাকনাম হ্যাপি। তিনি ঢাকার হলিক্রস স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এর পরপরই ১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ডালাসের হোকাডে স্কুলে পড়ার পর বেইলর কলেজ অফ মেডিসিনে ইন্টার্নশিপ করেন। স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্ক থেকে পুষ্টিবিজ্ঞানে স্নাতক করেন। সবশেষে সান ফ্রান্সিসকোর ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ বার্কলি থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
১৯৯৩ সালে হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার হিসেবে যোগ দেন। এখানে এসিডদগ্ধ নারীদের নিয়ে কাজ করেন। এ উদ্যোগের সূত্রে গঠিত হয় এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন। তিনিই প্রথম এসিড সন্ত্রাসের শিকার নারীদের জনসমক্ষে নিয়ে আসেন ও তাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়ে যান। এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রথম স্বতন্ত্র আইন প্রণীত হয় ২০০১ সালে। এর পেছনে তার অবদান ছিল প্রধান।
অক্টোবর মাসে গোলাপী ফিতা বেঁধে স্তন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণার উদ্যোগও এ দেশে তিনি প্রথম নেন। নিজে নিজে কীভাবে স্তন পরীক্ষা করা যায় তাও মহড়ার মাধ্যমে শিখিয়ে দেওয়া ছিল এ অভিযানের অংশ। স্তন ক্যান্সারের জন্য স্বল্পমূল্যে ওষুধ তৈরির অ্যাডভোকেসির অংশ হিসেবে ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সভা করেছেন। দরিদ্র স্তন ক্যান্সার রোগীকে আর্থিক সহযোগিতাও ছিল এ উদ্যোগের অংশ।
এ ছাড়া প্রতিবন্ধী নারীর সুরক্ষা, তামাকবিরোধী আন্দোলন, টানবাজার থেকে যৌন কর্মীদের উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন, নারী ও শিশু পাচার নিয়ে সংসদীয় পর্যায়ে কাজ, নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ, এইচআইভি পজিটিভ নারীদের অধিকার, আদিবাসী, দলিত সম্প্রদায়ভূক্ত ও অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার, নারী কারাবন্দিদের অধিকার, কর্মজীবী নারীদের শিশু রক্ষণাবেক্ষণ এবং দত্তক ও নাগরিকত্ব আইন সংস্কারের উদ্যোগে তার অসামান্য ভূমিকা রয়েছে। সরকারের নরপ্ল্যান্ট নামক জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বিরূদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। ‘শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার’- এ ছিল তার কথা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকারবঞ্চিত মানুষদের কথা শুনতেন ও তাদের পাশে এসে দাঁড়াতেন। সর্বোপরি, নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের প্রতি ছিল অবিচল একাগ্রতা।
২০০৩ থেকে ২০০৬ সালের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০০৭ সাল থেকে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ‘নাসরীন স্মৃতি পদক’ দিয়ে আসছে। এ পর্যন্ত তৃণমুলের প্রায় অর্ধ শতাধিক নারী এ পদক পেয়েছেন।
শনিবার (২৪ এপ্রিল) তার ১৫ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে এই মহিয়সী নারীর প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। আপা, আপনি শান্তিতে ঘুমান, বেহেশতবাসী হোন - মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করছি।