নিজের চলচ্চিত্রের শিরোনামেই তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত ‘মাই ফেয়ার লেডি’ নামে। হলিউডের সর্বকালের সেরা সুন্দরী নায়িকার অন্যতম একজনও তিনি। ২৮ বছর পেরিয়ে গেছে তার মৃত্যুর। বেঁচে থাকলে আজকের দিনে (৪ মে) ৯২ বছর স্পর্শ করতেন বয়সের কাছে অপরাজিত এই চিরযৌবনা, মোহিনী, রূপসী, কিংবদন্তীতুল্য নায়িকা এবং মানবতার দূত অড্রে হেপবার্ন (১৯২৯-১৯৯৩)।
ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে ১৯৮৯ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকায় এসেছিলেন অড্রে হেপবার্ন। এক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে ইউনিসেফের বিভিন্ন দাতব্য কর্মকাণ্ড ঘুরে দেখেন। বাংলাদেশে তার ভ্রমণ শেষ হয় ২৪ অক্টোবর। মুখর প্রজাপতির মতো কর্মচঞ্চল অড্রে হেপবার্ন তখন তার শেষজীবনের প্রান্তে। অথচ হোটেল শেরাটনের জনাকীর্ণ সাংবাদিক সন্মেলনে এক ঝলক দেখে বিশ্বাসই হয়নি তার বয়সের ভার। আলো হয়ে প্রস্ফুটিত ছিলেন তিনি সবার মধ্যে।
বাংলাদেশে অসম্ভব সুন্দর সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন তিনি। লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসে প্রদত্ত এক পুরনো সাক্ষাৎকারে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘পাশ্চাত্যে বসে আমরা জানি যে বাংলাদেশ বন্যা আর দুর্যোগের দেশ। কিন্তু আমার কাছে বাংলাদেশ মানে কবিতা আর সৌন্দর্যের দেশ।’
আমৃত্যু ইউনিসেফ-এর শুভেচ্ছা দূত অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন মন জয় করে নিয়েছিলেন পুরো বাংলাদেশের। জীবনের শেষদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিশুদের নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। হেপবার্নের কাজের প্রতি সম্মান জানাতে ইউনিসেফ-এর সদর দপ্তরে তার একটি প্রতিমূর্তি স্থাপন করেছে জাতিসংঘ।
অড্রে হেপবার্ন প্রমাণ করেছেন যে, একজন শিল্পীর অবসর বা কাজের শেষ বলে কোনও কথা নেই। তারা ক্যামেরার আড়ালে থেকেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের জন্য কাজ করে যেতে পারেন। তার পুরোটা জীবনই ছিল মানুষ ও মানবতার জন্য নানামুখী কাজে নিবেদিত। একদিকে তিনি যেমনভাবে জাদুকরী অভিনয়শৈলী আর সুন্দর মুখশ্রী দিয়ে জয় করেছেন কোটি মানুষের হৃদয়, তেমনি বিপন্ন মানুষের জন্য অবিরাম ছুটেছেন পৃথিবীব্যাপী।
অড্রে হেপবার্ন, ২০ শতকের হলিউডের বিশুদ্ধ প্রতিমা রূপে গণ্য। তার অভিনয় কলায় স্মরণীয় হয়ে আছে বহু কালজয়ী চলচ্চিত্র, যার মধ্যে রয়েছে, 'রোমান হলিডে', ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিস’, 'শ্যারেড’, 'দ্য চিলড্রেন্স আওয়ার’, 'প্যারিস হোয়েন ইট সিজলস’, 'দ্য নানস স্টোরি’, 'ফানি ফেস’, 'হাউ টু স্টিল আ মিলিয়ন’, 'মাই ফেয়ার লেডি’র মতো সাড়া জাগানো ছবি। এক ‘রোমান হলিডে’র জন্যই আলাদা করে মনে রাখতে হবে তাকে, যেমন মনে থাকবে ‘মাই ফেয়ার লেডি’র জন্যেও।
৪ মে ১৯২৯ সালে, বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের একটি জেলায় জন্মগ্রহণকারী হেপবার্ন শৈশবের অধিকাংশ সময় কাটান বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ড তথা ইউরোপের এই তিন দেশে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের দখলে থাকা নেদারল্যান্ডের আর্নহেম শহরেও তিনি অবস্থান করেছিলেন।
আমস্টারডামে থাকাকালীন, তিনি সোনিয়া গাস্কেলের সাথে ব্যালে নিয়ে পড়াশোনা করতেন। ১৯৪৮ সালে তিনি লন্ডনে চলে আসেন ম্যারি রেমবার্টের সাথে ব্যালে প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখেতে এবং সমবেত সঙ্গীতদলের একজন হিসেবে ওয়েস্ট এন্ড মিউজিকাল প্রোডাকশনে কাজ করার সুযোগ পেতে। যেখান থেকে তিনি ক্রমশ অভিনয় জগতে নিয়ে যান নিজেকে।
অভিনয় জীবনের প্রথমদিকে কয়েকটি ব্রিটিশ চলচ্চিত্রে উপস্থিতির পর ১৯৫১ সালে ব্রডওয়ে নাটক 'জিজি'তে অভিনয় করেন তিনি। তারপর, হেপবার্ন 'রোমান হলিডে' (১৯৫৩) চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন, যার জন্য তিনি প্রথম অভিনেত্রী হিসেবে একই সাথে একটি 'অ্যাকাডেমি পুরস্কার', একটি 'গোল্ডেন গ্লোব' এবং একক কৃতিত্বের জন্য 'বাফটা পুরস্কার' অর্জন করেন। একই বছর, তিনি 'অনডিন' নাটকে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে 'টনি পুরস্কার' অর্জন করেন।
পরবর্তীকালে অড্রে হেপবার্ন বেশ-কয়েকটি সফল ও আলোচিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, যার মধ্যে রয়েছে সাবরিনা (১৯৫৪), দ্য নানস স্টোরি (১৯৫৯), ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফিনিস (১৯৬১), চ্যারেড (১৯৬৩), মাই ফেয়ার লেডি (১৯৬৪) এবং ওয়েট আনটিল ডার্ক (১৯৬৭)। শেষোক্ত চলচ্চিত্রের জন্য তিনি দ্বিতীয়বারের মত অ্যাকাডেমি পুরস্কার এবং গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার ও বাফটা মনোনয়ন পান। অড্রে হেপবার্ন স্বল্পসংখ্যক-বিরল গুণসম্পন্ন অভিনেত্রীদের মধ্যে একজন, যিনি একই সঙ্গে অ্যাকাডেমি, এমি, গ্র্যামি ও টনি পুরস্কার পেয়েছেন। হলিউড ও বিশ্ব চলচ্চিত্রাঙ্গন ছাড়াও তিনি শ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ অভিনেত্রী হিসেবে তিনবার বাফটা পুরস্কার অর্জনের রেকর্ড করেন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাথে তিনি অভিনয় জগৎ থেকে দূরে সরে আসেন এবং ইউনিসেফ-এর হয়ে জনহিতৈষী কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। যদিও এই উন্নয়ন-সম্পৃক্ত সংগঠনের সাথে তিনি ১৯৫৪ সাল থেকেই যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে তিনি আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়ার দরিদ্র সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করেছিলেন।
ইউনিসেফ-এর শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে তাকে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পদকে ভূষিত করা হয়। এর এক মাস পর, এপেন্ডিক্স ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সুইজারল্যান্ডে নিজ বাসায় ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। দিনটি ছিল ১৯৯৩ সালের ২০ জানুয়ারি। বিরল তলপেটের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ঘুমের মধ্যে মারা যান তিনি৷ সুইজারল্যান্ডের ঐ ছোট্ট শহরে তাকে সমাহিত করা হয়। ঐ শহরেই জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন এ মহানায়িকা।
ঘটনাবহুল ও চরম নাটকীয়তায় ভরপুর ছিল অড্রে হেপবার্নের ব্যক্তিগত জীবন। তার বাবা জোসেফ ভিক্টর অ্যান্থনি রাস্টন (১৮৮৯-১৯৮০) ছিলেন একজন ব্রিটিশ এবং অস্ট্রিয়ান বংশদ্ভুত। তার মা ব্যারন এলা ভন হিমস্ট্রা (১৯০০–১৯৮৪), ছিলেন একজন ডাচ অভিজাত শ্রেণির সদস্য। মায়ের ডাচ পরিবারের কারণে এবং তার বাবার ব্রিটিশ পটভূমি ও ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানে কর্মসূত্রে, এই পরিবার ইউরোপের একাধিক দেশের মধ্যে প্রায়ই ভ্রমণ করতেন। তার বহুজাতিক পটভূমির কারণে অড্রে হেপবার্ন শৈশব থেকেই পাঁচটি আন্তর্জাতিক ভাষায় কথা পারতেন; অভিবাসী ইংরেজি এবং ওলন্দাজের পাশাপাশি তিনি ফরাসি, স্প্যানিশ এবং ইতালিয় জানতেন। জার্মানভাষী হিসেবেও তাকে গণ্য করা হয়। হেপবার্ন মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ব্যালে নৃত্যে পারদর্শিতা অর্জন করেন।
২য় বিশ্বযুদ্ধ অড্রে হেপবার্নের পরিবারে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। এবং সম্ভ্রান্ত-অভিজাত হওয়া সত্ত্বেও হেপবার্নের মা তাদেরকে সহায়তার জন্যে সামান্য কাজ করতে বাধ্য হন। তদুপরি হেপবার্নের কর্মসংস্থান খোঁজার প্রয়োজন পড়ে। চলচ্চিত্রে সাফল্য লাভের পূর্ব-পর্যন্ত তাকে আর্থিক কষ্টের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম করতে হয়।
১৯৫২ সালে হেপবার্নের সাথে তরুণ জেমস হ্যানসনের বাগদান সম্পন্ন হয়। হ্যানসনের সাথে তার লন্ডনে নাচ প্রশিক্ষনের সময় থেকে পরিচয় ছিল। তিনি এটাকে বলেন, 'প্রথম দেখায় ভালোবাসা'। অবশ্য, তার বিয়ের পোশাক তৈরি এবং অনুষ্ঠানের দিন ধার্য হবার পর, তিনি সুনির্দিষ্ট করেন যে, এই বিয়ে টিকবে না। কারণ তাদের জীবনায়নের চাহিদাগুলো বেশিরভাগ সময়ই তাদেরকে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে রাখে। তিনি তার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে একটি বিবরণ প্রকাশ করে বলেন, 'যখন আমি বিবাহিত হব, আমি সত্যিকার অর্থেই বিবাহিত হতে চাই।' তবে, তেমন অন্তরঙ্গ বৈবাহিক জীবনের দেখা তিনি পাননি। ১৯৫০ সালের দিকে প্রযোজক মাইকেল বাটলারের সঙ্গে তিনি অভিসারে যেতেন মর্মে জনশ্রুতি ছিল।
অড্রে হেপবার্ন নিজের গৌরবময় অভিনেত্রীর পরিচিতিকে অতিক্রম করে মানবতার দূতে পরিণত হয়েছিলেন। হলিউডের স্বর্ণযুগের অন্যতম প্রধান নায়িকা হয়েও তিনি রূপালি পর্দার দূরতর জগত ছেড়ে মানুষ ও মানবতার কল্যাণের বাস্তব ক্ষেত্রে অবতরণ করে বিশ্বের পথে-প্রান্তরে ঘুরেছেন। বিশ্ব চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানসমূহ ও বোদ্ধাদের দৃষ্টিতে সর্বকালের অন্যতম 'প্রকৃতিগতভাবে সুন্দর নারী' রূপে স্বীকৃত অড্রে হেপবার্ন তার মানবিক কল্যাণকর্মের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত এবং স্মরণীয়।