১৯৭৯ সাল। উত্তর আয়ারল্যান্ড জুড়ে তখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিপক্ষে ব্রিটিশ ইউনিয়নের অনুগত মানুষের সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। প্রায় ৩০ বছর ধরে দুপক্ষের মধ্যে চলা টুকরো টুকরো সংঘর্ষ ‘দ্য ট্রাবলস’ নামে পরিচিত।
ঠিক সেই ঘোরতর সঙ্কুলকালের এক রাত্রে হঠাৎ পিটারের বাড়ির কলিং বেল বেজে ওঠে। তাঁর স্ত্রী এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন, কিন্তু তারপরেই আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজা পেরিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে রাইফেলধারী কয়েকজন মানুষ। আসলে তাঁরা ব্রিটিশ প্রশাসনের গোপন পুলিশ। তাঁদের কাছে খবর পৌঁছেছিল, জাতীয়তাবাদী আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন পিটার। অথচ দেশব্যাপী যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সবসময় দূরেই সরিয়ে রেখেছিলেন পিটার। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ অবশ্য তিনি পেলেন না। কোনোক্রমে তিন সন্তানকে গোপন পথে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।
পিটারের সন্তানদের কাছে সমস্ত ঘটনা শুনে দ্রুত এসে পৌঁছান আত্মীয়-স্বজন। পিটার নিজেও ততক্ষণে বডিব্যাগের মধ্যে শায়িত। তাঁর বডিব্যাগ মোড়া শরীর দেখে পিটারের বাবা ধরেই নিয়েছিলেন, পুত্রকে হারিয়েছেন তিনি। সেই মুহূর্তে মানসিক আঘাত সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু হল তাঁর। পিটার যদিও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া শরীরের স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে পড়েছে। সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে যান পিটার।
এই অবস্থায় এক বছর তিনি কাটালেন মাসগ্রেভ পার্ক হসপিটালে। পিটারের কথায়, এই এক বছর ধরে নিজেকে কফিনবন্দি মৃতদেহ মনে হত তাঁর। সমস্ত অনুভূতি আছে একইরকম। অথচ শরীরের কোনো অঙ্গ নড়াচড়া করতে পারছেন না। রাতে কপালে একবিন্দু ঘাম জমলে তা মুছতে পারতেন না। অস্বস্তি নিয়ে জেগে থাকতে হত সারা রাত।
ঠিক এই সময় তিনি চোখ মেলে দেখতেন সাদা পোশাকের এক নার্স ঝুঁকে পড়েছেন তাঁর মুখের উপর। পরম যত্নে মুছে দিচ্ছেন তাঁর কপালের ঘাম। পিটারের সেই মুহূর্তে মনে হয়, সাদা পোশাকে যেন কোনো দেবদূত দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর সামনে। এই সময় নার্সদের ব্যক্তিগত কথাবার্তার মধ্যেই জানতে পেরেছিলেন, সেই দেবদূতের নাম বেৎসি।
এক বছর ধরে বেৎসির সেবায় সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন পিটার। কিন্তু তারপর আর দুজনের দেখা হয়নি। বেৎসিকে সামান্য ধন্যবাদটুকুও জানিয়ে আসতে পারেননি পিটার। চারযুগ পর জীবন সায়াহ্নে এসে এই দুঃখটুকুই প্রবল হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন তাঁকে। শেষে পিটারের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে সাংবাদিকরা। কয়েকমাস চেষ্টার পর অবশেষে তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়। এই বয়সেও নিজেকে কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত রেখেছেন বেৎসি। ডাউনপেট্রিক অঞ্চলের একটি মানসিক হাসপাতালের নার্স তিনি। আর পিটারের বাড়ি থেকে তার দূরত্ব মাত্র ৬ মাইল।
শেষ পর্যন্ত দেখা হল দুজনের। বেৎসিও যেন এতদিন ধরে খুঁজছিলেন পিটারকে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনে যাঁকে নতুন জীবন দিয়েছেন তিনি, আদৌ কি সুখী হয়েছেন সেই মানুষটি? ৪২ বছর পর দেখায় পিটারের মুখের হাসি সংক্রমিত হয় বেৎসির মুখেও। ঠিক রূপকথার মতোই একটি মিলনাত্মক গল্পের জন্ম হল বাস্তবেই। পূর্ণ হল পিটারের জীবনের শেষ ইচ্ছা। দেখা পাওয়া গেলো এক গৌরবময় স্বাস্থ্যকর্মীর।
উভয়ের বয়স সত্তরের কোঠা পেরিয়েছে। তার মধ্যে চারিদিকে মহামারি পরিস্থিতিতে জীবনের সমস্ত আশা একপ্রকার লুপ্ত। করোনায় লক্ষ লক্ষ মানুষের মতো পিটার ও বেৎসি মারা যেতে পারতেন। কিন্তু জীবন অনেক চমকপ্রদ। এমন করোনাকালের সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেও ৪২ বছর পর আবারও মুখোমুখি হলেন পিটার এবং বেৎসি। পিটার যেন নার্স বেৎসির মধ্যো আবারও খুঁজে পেলেন বিপন্নতার বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার নবতর অভিজ্ঞান।