'চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়, চুনরি কে নিচে কেয়া হ্যায়...'
নীনা গুপ্তা, এতদিনে আমরা জানলাম কি ছিল| আপনার ক্ষতবিক্ষত হৃদয়| একজন নারীর আহত, অপমানিত হৃদয়....
মাধুরী দীক্ষিত আর সঞ্জয় দত্তের খলনায়কের সেই বহু আলোচিত গান থেকে ২০১৮ সালে চমকে দেওয়া 'বাধাই হো', নীনা গুপ্তা, আপনার জীবনের এই দীর্ঘ যাত্রাপথ তো আসলেই এক নারীর পতন আর উত্থানের আশ্চর্য আখ্যান| সেই জন্যেই তো এই সপ্তাহে যেই আপনার আত্মজীবনী 'সাচ কহু তো' প্রকাশ পেল, চারপাশে এত তুমুল আলোড়ন, এত উত্তেজনা।
নীনা, নিজের জীবনের সত্যির ঝাঁপিটা যেহেতু আপনি আত্মজীবনীতে উজাড় করে দিয়েছেন, সেহেতু ভেবে বিস্মিত হতে হয়, এই একটা জীবনে আপনি কত কিছুই করেছেন| ক্যারিবিয়ান তারকা ব্যাটসম্যান ভিভ রিচার্ডস-এর বান্ধবী হিসেবে বিয়ে না করেও কন্যা সন্তানের মা হওয়া থেকে শুরু করে সেই কন্যা মাসাবা গুপ্তাকে ভারতের সেরা ডিজাইনার বানানো, আবার ৬০ বছর বয়সে এসে 'বাধাই হো'-এর চমকপ্রদ কমেডি সিনেমাতে অভিনয়| যেখানে প্রবীণ এক দম্পতির সন্তান হওয়ার অভিজ্ঞতা, টেনশন এবং সমাজ, এমনকি নিজেদের সাবালক পুত্ররাও এই ঘটনাকে কিভাবে দেখছে, পর্দায় তার দুরন্ত চিত্রায়ণ আমরা দেখেছি|
ভিভ রিচার্ডসের দুই সহ-খেলোয়াড়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের তারকা ওপেনিং জুটি গর্ডন গ্রিনিজ আর ডেসমন্ড হেনেস যখন বিপক্ষ বোলিংকে চূর্ণ করে দিচ্ছেন, তখন তাঁদের নিয়ে এক ক্রীড়া সাপ্তাহিক প্রচ্ছদ কাহিনী করেছিল। শিরোনাম ছিল, 'লাইফ বিগিনস অ্যাট ফর্টি' আর আপনাকে নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনী করলে তো হেডলাইন হবে, 'লাইফ বিগিনস অ্যাট সিক্সটি'!
এই উপমহাদেশের হাফ সেঞ্চুরি পার করে দেওয়া মানুষদের কাছে আপনি রোল মডেল, অতিমারির কালে আপনার জীবনের গল্প টাটকা বাতাস| কন্যা মাসাবাকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি হওয়া ওয়েব সিরিজ, যা হয়তো মা এবং মেয়ের জন্য অনেকটাই আত্মজৈবনিক, আপনি নীনা গুপ্তা বারেবারেই বলেছেন একজন অভিনেত্রী হিসেবে আপনাকে কতটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে| কাজের খোঁজে কতটা হন্যে হতে হয়েছে| কিন্তু আপনার অভিনয়ের চিরদিনের অনুরাগী বলে ভাবছিলাম, কি সব সিনেমা বা সিরিয়াল আপনার ঝাঁপিতে| ফারুক শেখ আর দীপ্তি নাভালের কালজয়ী রোম্যান্টিক মুভি 'সাথ সাথ'-এও আপনি আছেন, আবার শ্যাম বেনেগালের 'মান্ডি' ছবিতে মীর তাকি মীরের সেই স্মরণীয় গজলের সঙ্গে আপনার নাচ কি ভোলা যায়! 'মান্ডি'র নাম আলাদা করে উল্লেখ করলাম কারণ স্মিতা পাটিল, শাবানা আজমী, নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরী এবং সৈয়দ জাফরির মতো অভিনেতারা থাকলেও ওই ছবিতে আপনার অভিনয় ভোলা সত্যিই মুশকিল।
যেহেতু সম্পর্ক, সন্তান ইত্যাদি নিয়ে আপনি অনেক সময়ই শিরোনামে থেকেছেন, তাই আপনার সিরিয়াল বললেই লোকে 'সাঁস' কিংবা 'দর্দ'-এর নাম করে, কারণ সেখানেও নারী-পুরুষের রসায়নই মূল উপজীব্য| নীনা গুপ্তা, আমরা আসলেই ভুলেই যাই গুলজার যখন নাসিরুদ্দিন শাহকে নিয়ে মির্জা গালিবের মতো সিরিয়াল বানিয়েছেন, তখনও সেখানে এই কিংবদন্তী কবির প্রেয়সীর চরিত্রে আপনিই| আসলেই আপনি বারেবারে নিজের অভিনয় প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন, আবার কোনো কারণে পিছু হটে গিয়েছেন, আবার হাঁচড়পাঁচড় করে পাহাড়ের গা বেয়ে শীর্ষে পৌঁছেছেন| সাফল্যের প্রতিটি মুহূর্তে আপনি জেনেছেন, পরের দিন খাদে থাকতে পারেন| আবার লড়াই করেই নিজের জায়গা ফিরে পেতে হবে|
নীনা গুপ্তার প্রথম আত্মজৈবনিক ওয়েব সিরিজ 'মাসাবা'। তারপরে এই আত্মজীবনী 'সাচ কহু তো', দুটোই বলে দেয় আপনার জীবনের পুরুষরা ভারি অদ্ভুত| এবং তখন পুরুষ হিসেবে নিজের ভারি লজ্জা হয়, সত্যিই তো আমরা এই রকমই| ভিভ রিচার্ডসের কথাই ধরুন| ক্যারিবিয়ান তারকা ঠিক করলেন, আপনাকে এবং শিশু কন্যাকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন| এদিকে একই সময়ে মুম্বইতে মেয়ের স্কুলে ভর্তির ইন্টারভিউ পড়ে গেল| আত্মজীবনীতে আপনি লিখেছেন, মাসাবার স্কুলে ইন্টারভিউয়ের জন্য সকন্যা বেড়াতে যাওয়া হবে না জেনে ভিভ রিচার্ডস সেই যে ফোন রেখেছিলেন পরের পাঁচ বছর আর ফোন করেননি| ক্যারিবিয়ান পিতার আশ্চর্য দায়িত্বজ্ঞানের কথা ভাবতে ভাবতেই একটা পুরনো দৃশ্য মাথায় এলো| মদন লালের বল মিডউইকেটের উপর দিয়ে উড়িয়ে দিতে গিয়ে কপিল দেবের হাতে ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচ, চ্যুইংগাম চিবোতে চিবোতে ক্যারিবিয়ান তারকা প্যাভিলিয়নের পথে আর আমরা জেনে যাচ্ছি ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপটা আমরাই জিতছি| ভাগ্যিস ভিভ রিচার্ডস এই রকমই, তাই কপিল দেবের হাতে কাপ ওঠে, মাসাবা গুপ্ত পড়াশোনা শেষ করে ফ্যাশন ডিজাইনার হন!
যদিও 'চোলি কে পিছে'র জন্যই নীনা আপনাকে সবাই বেশি মনে রেখেছে, কিন্তু বলিউডকে তো কম হিট আইটেম সং আপনি দেননি| এমনকি সালমান খানের 'বীর' ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গেও নেচেছেন। আত্মজীবনীতে প্রথমবার বলেছেন আপনার প্রথম স্বামী, 'আইআইটি'র বাঙালি বিজ্ঞানীর কথাও। কিন্তু অনুরাগী হিসেবে বলব, আপনার জীবনের সঙ্গে, জীবন দর্শনের সঙ্গে বোধহয় বেশি করে যায় ১৯৯৩ সালে মহেশ ভাটের পারভীন ববির জীবন নিয়ে বানানো 'ফির তেরি কাহানি ইয়াদ আয়ি'র গানটা: 'শায়রানা সি জিন্দেগি কি ফজা ,আপ জিন্দেগি কা মজা লিজিয়ে...।'
নীনা গুপ্তা, এই বৃষ্টিবহুল জুন মাসের ৪ তারিখে ১৯৫৯ সালে দিল্লিতে জন্মগ্রহণকারী এই আপনিই ৬২ বছর বয়সে সবুজাভ বৃক্ষের সতেজতায় দাঁড়িয়ে প্রতিদিন আমাদের শেখাচ্ছেন জীবনে আনন্দময় বেঁচে থাকার অভিজ্ঞান।
লেখক: সুমন ভট্টাচার্য, কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক। কবি, কথাশিল্পী ও টিভি ব্যাক্তিত্ব।