কাজী নজরুল ইসলামের ঐতিহাসিক সৃষ্টি 'বিদ্রোহী' কবিতা আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে রচিত হয়েছিল। শতবর্ষে এ কবিতা উজ্জীবিত করে বৃহত্তর বাঙালিকে। মাত্র ২২ বছর বয়সে নজরুল প্রায় দেড় শ পঙক্তির ভুবনবিজয়ী কবিতায় বাঙালির শৌর্য, দ্রোহ, সংক্ষোভ ও স্বাধীনতার স্পৃহাকে মূর্ত করেছেন।
নজরুল চর্চায় নিবেদিত 'ছায়ানট কলকাতা' এই ইতিহাসস্পর্শী কবিতার শতবর্ষে আয়োজন করেছে বর্ণাঢ্য আলোচনা ও সঙ্গীতের। 'ছায়ানট কলকাতা'র সভাপতি, বিশিষ্ট শিল্পী ও নজরুল গবেষক সোমঋতা মল্লিক বার্তা২৪.কম'কে বলেন, 'সারা বছরই আমরা নজরুল বিষয়ক নানা আয়োজন করলেও শতবর্ষে বিদ্রোহী আমাদের কাছে গভীর তাৎপর্যবাহী। আমরা কলকাতায় নজরুলের অবস্থানের জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করছি এবং তাঁর গান ও অন্যান্য রচনার চর্চা ও বিকাশে ব্যাপৃত রয়েছি।'
সোমঋতা মল্লিক বলেন, '১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে মধ্য কলকাতার ৩/৪সি তালতলা লেনের একটি বাড়িতে বসে কাঠ পেন্সিলে কবিতাটি লিখেন তিনি। কবিতা লেখার পরের দিন সকালে প্রথম পড়ে শুনিয়েছিলেন ওই বাড়িতে তার সঙ্গে থাকা বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমেদকে। আমরা সেই ঐতিহাসিক বাড়িকে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি এই স্মরণীয় দিনকে উপলক্ষ্য করে।'
'মানবমুক্তির মহান সাধক নজরুল নারীশক্তিরও বিকাশ কামনা করেছেন। নারীর সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে নজরুলের কাব্যিক অবদান অগ্রণী' উল্লেখ করে সোমঋতা বলেন, 'নজরুলের নারী শিরোনামের কবিতাটিও যুগান্তকারী সৃষ্টি, যা আজো প্রাসঙ্গিক। নারী কবিতায় নজরুল বলেছেন, সাম্যের গান গাই-/আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!/বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর/বিশ্বে যা কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি,/অর্ধেক তার আনিয়াছে নর অর্ধেক তার নারী/নরক কুন্ড বলিয়া তোমা’ করে নারী হেয় জ্ঞান?/তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর শয়তান।/অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে,/ক্লীব সে, তাই নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।/এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল/নারী দিল তাহে রূপ-রস-সূধা-গন্ধ সুনির্মল।'
সোমঋতা মল্লিক বলেন, মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান সমান। সভ্যতার অগ্রগতির মূলে রয়েছে নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে নারী ও পুরুষের হাত ধরেই পৃথিবী সভ্যতার পথে এগিয়ে চলেছে। সভ্যতার এ অগ্রযাত্রায় মানবজাতির উভয় অংশের অবদানই গুরুত্বপূর্ণ ।
তিনি বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত, অবহেলিত ও নির্যাতিত হয়ে আসছে। এ বৈষম্যের অবসান হওয়া প্রয়ােজন। কেননা নারী ও পুরুষ উভয়ই মানুষ, এ দুই সত্তার মাঝে যে কারও অধিকার খর্ব হলে ব্যাহত হবে কাক্ষিত অগ্রগতি। মানুষ তার মেধা আর কায়িক পরিশ্রম দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলেছে বর্তমান সভ্যতার তিলােত্তমা মূর্তি। এ নির্মাণ অভিযাত্রার নৈপথ্যে রয়েছে নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা সভ্যতার বেদীমূলে পুরুষের পরিশ্রমের আর সংগ্রামের চিহ্ন খােদিত হলে তার সাথে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে নারীর সেবা আর কর্তব্যনিষ্ঠাও। সভ্যতাকে সাজাতে-গােছাতে পুরুষ দিয়েছে শ্রম। আর তাতে সর্বদা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে নারী। সব যুগের সব দেশের মানুষের জন্য একথা সত্য। এখানে তাই স্বেচ্ছাচারিতার কোনাে সুযােগ নেই। তা সত্ত্বেও নারীদের অবদানকে অগ্রাহ্য করলে তা সামাজিক ভারসাম্যকে নষ্ট করবে। এমন অবস্থা কখনােই কাম্য হতে পারে না। পৃথিবীর সকল সভ্য সমাজ তাই নারীদের এ বিরাট ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়েই উন্নয়নের পথে পা বাড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নর এবং নারী একে অপরের পরিপূরক। মানবকল্যাণের পথে তাই নারী-পুরুষ উভয়কেই অগ্রসর হতে হবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালােবাসার অনুভূতির মধ্য দিয়ে।
শিল্পী সোমঋতা মল্লিক বিশ্বাস করেন, 'পুরুষের শৌর্য-বীর্য আর নারী হৃদয়ের সৌন্দর্য, প্রেম-ভালােবাসার সম্মিলনেই বিশ্বের সকল উন্নতি সাধিত হয়েছে। তাই নারী, পুরুষের পারস্পরিক সহযােগিতার মধ্য দিয়েই কেবল পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে গড়ে তােলা সম্ভব। আর এক্ষেত্র চির উন্নত শির নজরুল আমাদের চিরকালীন অবুপ্রেরণার উৎসস্থল।