‘যখন কোন নারী কিছু করতে চায় তখন সবাই উৎসাহ দেওয়ার বদলে ভয় দেখায়, নিরুৎসাহিত করে। ভাবে সে তো একজন নারী সে আর কী ব্যবসা করবে। আসলে এখনো আমাদের (নারী উদ্যোক্তা) প্রতি সমাজে অনেকের আস্থাই তৈরি হয়নি।’
কথাগুলো বলছিলেন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা ইসরাত জাহান চৌধুরী। যিনি পাটজাত পণ্য বিদেশে রফতানি করেন। শুরুতে ব্যাংকিং পেশা দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেও সেই পেশায় বেশিদিন স্থায়ী থাকতে পারেননি ইসরাত। সংসারের ঝক্কি, সন্তান লালন-পালন সব কিছু সামলে নিজের ক্যারিয়ারের দিকে আর মনোনিবেশ করতে পারেননি তিনি। কিন্তু একটা সময় ভাবলেন এভাবে আর বসে থাকলে চলবে না। নিজের এবার কিছু করা উচিত। শুধু নিজে নয় সমাজের বেকার নারীদের জন্য করার ইচ্ছা জাগে তার। যেই কথা সেই কাজ। ২০১৫ সালে শুরু করলেন পাট পণ্য উৎপাদন। প্রতিষ্ঠানের নাম দিলেন 'তুলিকা'। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে ১৫ জন কর্মী আছে। এর মধ্যে নারীকর্মী আছেন আটজন।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে চলমান অষ্টম জাতীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প পণ্য (এসএমই) মেলায় তুলিকার স্টল দিয়েছেন ইসরাত। তার স্টলে পাট এবং সুতা দিয়ে তৈরি গৃহ সজ্জার বিভিন্ন পণ্যসহ হরেক রকমের ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে। এই পণ্যগুলোর মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০-২০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
ইসরাত বলেন, ‘আমি যখন ব্যবসা শুরু করব, তখন আমার নিজের কোনো পুঁজি ছিল না। কোথাও থেকে যখন ঋণ নিতে পারছিলাম না, তখন আমার মায়ের কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু মা টাকা দিতে অসম্মতি জানান। আসলে উনি বিশ্বাসই করতে পারেননি যে আমি একজন উদ্যোক্তা হতে পারব! কারণ আমি একজন নারী। ছেলে হলে হয়তো নির্দ্বিধায় দিয়ে দিতেন। আসলে মাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই এমন।’
অনেকটা স্মৃতিকাতর হয়ে ব্যবসার গোড়ার কথা টেনে তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমে এই পণ্যের বাজার দেখেছি। যারা এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। পাট পণ্যের আদি-অন্ত জেনে তবেই ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তখন এমন অবস্থা ছিল আমার ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এই ব্যবসায় আমার শেষ পুঁজিটুকু বিনিয়োগ করতে হবে। এটা যদি হারাই তাহলে আমার হাতে আর কোনো সুযোগ থাকবে না। আমাদের সমাজে একজন ছেলের হাতে পরিবার দায়িত্ব দিতে পারে, কিন্তু একজন মেয়ের ওপর সামান্য আস্থা রাখতে পারে না।’
এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, ‘সরকারের কাছে আমাদের একটাই প্রত্যাশা, সরাসরি যেন বিদেশি বায়ারদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগটা তৈরির ব্যবস্থা করে দেয়। আমরা যেন স্বল্প খরচে আন্তর্জাতিক মেলাগুলোতে যোগদান করতে পারি। তবেই দেশীয় পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ ভালোভাবে করা সম্ভব।’
এসএমই ফাউন্ডেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার মোরশেদ আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘এবার মেলায় ২৯৬ জন উদ্যোক্তা স্টল দিয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৫ জন নারী এবং ১০১ জন পুরুষ উদ্যোক্তা। প্রায় ৬৬ শতাংশই নারী উদ্যোক্তাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে এখানে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসএমই নারী উদ্যোক্তা বান্ধব প্রতিষ্ঠান। আমরা প্রায় ৩০ হাজার উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকি। এর মধ্যে প্রায় ১৮ হাজারই নারী উদ্যোক্তা। নারীরা এখন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে এটা আমাদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। এসএমই ফাউন্ডেশন এটাই চায়। তবে নারী উদ্যোক্তাদের অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। এর মধ্যে ফিন্যান্সিয়াল চ্যালেঞ্জটাই বেশি। তবে আমরা যতটুকু পারছি ঋণ দিয়ে সহায়তা করার চেষ্টা করছি।’
গত ৪ মার্চ দেশীয় পণ্যের স্থানীয় আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে অষ্টম জাতীয় এসএমই মেলা-২০২০ শুরু হয়েছে। যার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেলা চলবে বৃহস্পতিবার (১২ মার্চ) পর্যন্ত।