গ্যাস রফতানির সুযোগ রেখে পিএসসি সংশোধন
গ্যাসে দাম (হাজার ঘনফুট) ৬ দশমিক ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ ডলার এবং রফতানির সুযোগ রেখে মডেল পিএসসি-২০১২ সংশোধনি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পুর্বের পিএসসিতে (উৎপাদন বন্টন চুক্তি) গ্যাসের দাম ২ শতাংশ বৃদ্ধির অপশন ছিলো, এবার তা কমিয়ে দেড় শতাংশ করা হয়েছে।
রফতানি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে প্রথমে পেট্রোবাংলাকে প্রস্তাব করতে হবে। পেট্রোবাংলা যদি গ্যাস কিনতে অস্বীকৃতি জানায়, দ্বিতীয় অপশন হিসেবে বাংলাদেশেই তৃতীয়পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারবে। আগ্রহী তৃতীয়পক্ষ পাওয়া না গেলে তবেই গভীর সমুদ্র থেকে উত্তোলিত গ্যাস বিদেশে রফতানি করতে পারবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি।
এমন তথ্য বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে নিশ্চিত করেছেন পেট্রোবাংলার জেনারেল ম্যানেজার (পিএসসি) শাহনেওয়াজ পারভেজ।
সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বিষয়টি চুড়ান্ত হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকের রেজুলেশন চূড়ান্ত হয়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে স্বাক্ষর দিলে পিএসসি আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। এরপর অবসোর বিডিং রাউন্ডে যেতে চায় পেট্রোবাংলা। তবে যে কোম্পানিই কাজ পাক না কেনো অগভীর ব্লকে বাপেক্সের ১০ শতাংশ শেয়ার থাকবে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বাপেক্সকে সমুদ্রে তেল-গ্যাস আহরণে অভিজ্ঞ করে তোলা। গভীর সমুদ্রে থাকছে না বাপেক্সের শেয়ারিং।
গত রমজানে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ওপর গণশুনানিতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বলেছিলেন গ্যাসের দাম কম থাকায় অনেকবার দরপত্র আহ্বান করেও তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই মডেল পিএসসি-২০১২ সংশোধন করে গ্যাসের দাম আকর্ষণীয় করা হচ্ছে।
কিন্তু পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না অনেকেই। পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক (মাইনিং) মকবুল ইলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়ালেই বিদেশি কোম্পানি আসবে- এ ধারনা সঠিক না। তথ্য উন্মুক্ত করাই সবচেয়ে জরুরি। আমাদের সাগরে কী আছে, কী নেই- এটা না জানলে বিদেশি কোম্পানি আগ্রহী হবে কেনো? আমাদের কাছে যে প্রাথমিক তথ্য রয়েছে সেগুলো পাবলিক করতে হবে অথবা স্বল্প দর দিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যখন বিদেশি কোম্পানি বুঝতে পারবে আমাদের সাগরে অনেক তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখনই বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হবে। না হলে দর বাড়ালেও অথৈ সাগরে সহজে কেউ টাকা ঢালতে চাইবে না। আমাদের কাছে সার্ভের যে সব তথ্য রয়েছে এগুলো বাক্সবন্দি করে রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে খুব ভালো ফল পাওয়া কঠিন হবে। আমাদের চেয়ে কম তথ্য রয়েছে ভারতের তাদের ব্লকে অনেকে আগ্রহ দেখাচ্ছে কেনো? এটা ভাবতে হবে।
প্রসঙ্গত, পিএসসি-২০০৮ প্রস্তুত করার সময় খসড়া উন্মুক্ত করা হয়। তারপর সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হয়। এমনকি উন্মুক্ত গণশুনানি করে চূড়ান্ত করা হয় পিএসসি। ২০১২ সালেও গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। এবার আরও কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে চলে সংশোধনির কার্যক্রম।
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার মতে, মডেল পিএসসি-২০১২ অনুসারে কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। তখন প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দর ধরা হয়েছিল ৪.১৬ ডলার। আর মিয়ানমারের গ্যাসের দর রয়েছে ৭ ডলার। যে কারণে বিদেশি কোম্পানি আগ্রহী হচ্ছে না।
২০১২ সালে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। আর ভারতের সাথে নিষ্পত্তি হয় ২০১৪ সালে। এতে বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৯ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমাকে ১১টি অগভীর ও ১৫টি গভীরসহ মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। যার মধ্যে অগভীর সমুদ্রে মাত্র ৩টি ও গভীর সমুদ্রে ১টি ব্লকে চুক্তি করা হয়েছে।’
অন্যদিকে, স্থলভাগে গ্যাস দিন দিন ফুরিয়ে যাওয়ায় সংকট মোকাবিলা করতে বেশি দামে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। অভিযোগ আছে, যথাসময়ে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান না করায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে মোট ২৬টি গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে। এরমধ্যে ২০ ক্ষেত্রের ১০১টি কূপ দিয়ে গ্যাস উত্তোলন চলমান রয়েছে।
প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মিলে ২৭ টিসিএফ গ্যাস প্রাক্কলন করা হয়। এরমধ্যে উত্তোলন শেষে বর্তমানে ১১টিসিএফ গ্যাস উত্তোলনযোগ্য রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। প্রতি বছর ১ টিসিএফ উত্তোলিত হচ্ছে। সে হিসেবে নতুন আবিস্কার না হলে ১০ বছর পর গ্যাস ফুরিয়ে যেতে পারে। আবার গ্যাসের মজুদ কমে যাওয়ায় কূপের অভ্যন্তরে চাপ কমে যাবে। সে কারণে আসছে বছরগুলোতে গ্যাস উৎপাদন হ্রাসের শঙ্কা রয়েছে।
তবে ধারণা করা হয়, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের পাশ্ববর্তী ব্লক থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে মায়ানমার। একই বেসিনে অবস্থিত বাংলাদেশের ব্লকগুলো। এতে ভালো পরিমাণের মজুদ থাকতে পারে। আবার সিলেট থেকে শুরু করে বাংলাদেশের গোটা পুর্বাঞ্চল জুড়ে গ্যাসের মজুদ বিস্তৃত বলে ধারণা করা হয়।
সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মবাড়িয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ভোলায় গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে। সে দিক বিবেচনায় সাগরে গ্যাসের মজুদ থাকার সম্ভাবনা দৃঢ করে। কিন্তু নানা কারণে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেকটা হতাশাজনক।
বিদেশি কোম্পানি যাতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সে জন্য গভীর সমুদ্রে মাল্টিক্লেইন সার্ভের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী অনেক সভায় বলেছেন, মাল্টিক্লেইন সার্ভে হলে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ডাটা থাকবে। তখন অনেকেই আগ্রহী হবেন।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দেশীয় কোম্পানি বিজিএফসিএল'র কাছ থেকে ৭৭২ এমএমসিএফডি গ্যাস ৭০ পয়সা হারে (ঘন মিটার), বাপেক্সের কাছ থেকে ৩ টাকা ৪ পয়সা হারে ১০৮ এমএমসিএফডি, এসজিএফসিএল'র কাছ থেকে ২০ পয়সা হারে ১২৪ এমএমসিএফডি, আইওসির কাছ থেকে ২ দশমিক ৫৫ টাকা হারে ১ হাজার ৭১২ এমএমসিএফডি গ্যাস কিনছে। যার ইউনিট প্রতি দাম পড়ছে গড়ে প্রায় সাড়ে ৬ টাকার মতো। আর এলএনজি আমদানিতে প্রতি ইউনিটের দাম দাম পড়ছে ৩৯ দশমিক ৮২ টাকা।