বাংলাদেশ সরকারের অধীনে পরিচালিত অ্যাস্পায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) কর্মসূচির আওতায় ই-পেমেন্ট সেবা দিচ্ছে ‘একপে’।
‘একপে’ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে যথাযথ অনুমতি না নিয়ে লাইসেন্স ছাড়াই সেবা পরিষেবা দিচ্ছে, যা ‘পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেম অ্যাক্ট-২০২৪’-এর স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে জানা গেছে।
এই এটুআই কর্মসূচি ইউএনডিপি’র সহযোগিতায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) অধিদফতর থেকে পরিচালিত হচ্ছে। এটি বিগত সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এজেন্ডার বিশেষ কর্মসূচি হিসেবে পরিচালিত হয়ে এসেছে।
এই ‘একপে’ পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটর (পিএসও) কোনো লাইসেন্স গ্রহণ না করেই ২০১৯ সাল থেকে পরিচালিত হচ্ছে। অথচ কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা কোম্পানি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যথোযুক্ত লাইসেন্স গ্রহণ ছাড়া এ ধরনের অর্থনৈতিক পরিষেবা চালিয়ে যেতে পারে না। এ পরিষেবার জন্য ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ‘পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট বিল-২০২৪ পাস হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স ছাড়াই ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক দ্য বাংলাদেশ পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেম রিগুলেশন-২০২৪ পরিচালনা করছে।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই প্ল্যাটফর্ম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিবিধানকে বাইপাস করে বছর বছর ব্যবসা চালিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদফতর এ বিষয়ে একবারে নীরব রয়েছে।
২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় আইসিটি অধিদফতরের মাধ্যমে এই পেমেন্ট সিস্টেম উদ্বোধন করেন।
অ্যাস্পায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) কর্মসূচি এই ‘একপে’ পদ্ধতি তৈরি করেছিল।
এটুআই্-রে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৪৭টি সরকারি সেবার অধীনে ৭৮টি অধিদফতরের হয়ে সেবা দিয়ে আসছে ‘একপে’। ৩টি ব্যাংকের উদ্যোগে ৫টি ব্যাংক, ৯টি মোবাইল ব্যাংকিং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত।
পিএসও প্রতিদিন ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার সেবার মাধ্যমে ২ থেকে ৩ কোটি টাকার আর্থিক লেনদেন করে থাকে।
চলতি বছরের জুলাই মাসে ‘একপে’ ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম পরিচালনা করার জন্য প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে লাইসেন্স পেতে আবেদন করে। কিন্তু যথাযথ প্রক্রিয়া না মেনে আবেদন করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্ট, তা প্রত্যাখ্যান করে দেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যিনি এই বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা রাখেন, তিনি বলেন, ‘একপে’ যথোপযুক্ত নিয়ম না মেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করায়, তা প্রত্যাখ্যাত হয়।
তখন আমরা তাদের বলি, লাইসেন্স পাওয়ার আগে আপনারা একটি আলাদা কোম্পানি তৈরি করে সীমিত আকারে পিএসও পরিচালনা করুন। কিন্তু ‘একপে’ আজ পর্যন্ত সেই কোম্পানি গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এই পেমেন্ট সিস্টেম বিভিন্ন ব্যাংকসহ সেটেলমেন্টের দায়িত্ব বহন করে। এ জন্য আস্থা ও দায়িত্ব অর্জন করতে হয়। কিন্তু এর জন্য ‘একপে’র কোনো লাইসেন্স নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিবিধান এটি পরিচালনার অনুমতি দেয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মুখপাত্র হুসনে আর শিখার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘একপে’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে পদক্ষেপ নিয়েছিল। এটি পেমেন্ট সিস্টেম পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি সনদের জন্য আবেদন করে।
হুসনে আর শিখা বলেন, এই পেমেন্ট সিস্টেম পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ প্রক্রিয়া ও নির্দেশনা মেনে কাজ করার কথা জানায়। এইসব নির্দেশনা এখন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এজন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ১২০ দিন সময় চেয়েছিল।
লিখিত এক বিবৃতিতে এই মুখপাত্র বলেন, এই প্ল্যাটফর্ম একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়ে থাকে। সে জন্য কোনো ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়নি।
এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশ্য লেনদেন পরিচালনাসহ ইউটিলি বিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফিস এবং সরকারি বিভিন্ন ধরনের সেবা গ্রহণের জন্য ফিস এবং বিল লেনদেন করা।
পিএসও-এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘একপে’ সরকারি সেবা প্রদানের মনোপলি ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। সরকারের একটি ডিভিশনের অধীনে এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটি অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে।
এটি বাংলাদেশ পোস্টাল বিভাগের ‘নগদ’-এর আদলের মোবাইল অর্থনৈতিক পরিষেবার মতোই একটি পরিষেবা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, অ্যাস্পায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) কর্মসূচির উদ্যোগে ‘একপে’ এবং ‘একশপ’সহ মোট ৪টি ডিজিটাল পেমেন্ট প্রতিষ্ঠান বিগত বছরগুলো থেকে তাদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছে। সরকার এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতি বছর নির্দিষ্ট বাজেট নির্ধারণ করে দিয়েছে। এইসব উদ্যোগ প্রাইভেট সেক্টরের জন্যও পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে দ্য এজেন্সি টু ইনোভেট (এটুআই) বিল ২০২৩ পাস হয়েছিল। কিন্তু সেই এটুআই প্রজেক্ট এখনো কোনো এজেন্সি পরিচালনা করতে পারেনি। সেই কারণে ‘একপে’ লাইসেন্স পায়নি।
এটুআই প্রজেক্টের এডিশনাল সেক্রেটারি এবং প্রজেক্ট ডিরেক্টর মামুনুর রশিদ ভূঁইয়া বলেন, এটুআই্-এর অধীনে এটি ছিল একটি উদ্ভাবনী উদ্ভাবন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘একপে’-র বিষয়ে জ্ঞাত ছিল।
একটি ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা এবং ‘বিডিজবস’ ও ‘আজকের ডিল’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সিইও একেএম ফাহিম মাশরুম বলেন, অনেক উদ্যোগই আইন ও বিধিবিধান মানেনি। এর সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় যুক্ত থাকায় রেগুলেটরি বডি সে কারণে কোনো কাজ করতে পারেনি।
তিনি বলেন, যেহেতু এই ডিজিটাল পেমেন্ট একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে, সে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘নগদ’-এর মতো কোনো বিধিবিধানে অধীনে আনতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকে উচিত এর স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা প্রয়োগ করা।
যেহেতু, ‘একপে’ মনোপলিভাবে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে, সে কারণে অন্য পিএসও-এর ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়েছে।