দাওয়াত ও তাবলিগের গুরুত্ব এবং দাঈর গুণাবলি

  • মোহাম্মদ মাকছুদ উল্লাহ, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কোরআনে কারিমে বিশদ বলা হয়েছে দাঈর গুণাবলি সম্পর্কে, ছবি: সংগৃহীত

কোরআনে কারিমে বিশদ বলা হয়েছে দাঈর গুণাবলি সম্পর্কে, ছবি: সংগৃহীত

ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হলো- দাওয়াত ও তাবলিগ। দাওয়াত আরবি শব্দ, অর্থ ডাকা বা আহবান করা। তাবলিগ শব্দটিও একই ভাষার। অর্থ পেীঁছে দেওয়া।

ইসলামের পরিভাষায় তাবলিগ বলতে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আল্লাহর দ্বীন ও শরিয়তের বিধি-বিধান প্রচারের কাজকে বোঝায়। দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন তথা ইসলাম আল্লাহর জমিনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যুগে যুগে। আর এ কাজের জন্যে মহান আল্লাহ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোকে বেছে নিয়েছেন। নবী-রাসূলদের মূলতঃ দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ দিয়ে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। সে মতে মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে মানবসমাজে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ চলে আসছে।

বিজ্ঞাপন

হজরত আদম (আ.) ছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ এবং প্রথম নবী। সুতরাং এটাই বাস্তবতা যে, দ্বীনের দাঈর (আল্লাহর পথে আহবানকারী) আগমনের মাধ্যমে পৃথিবীতে মানবসভ্যতার সূচনা। নবী ও রাসূলদের একমাত্র তাবলিগের দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল এ বিষয়টি আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমের বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন ভঙ্গিতে বিবৃত করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘রাসূলের একমাত্র দায়িত্ব হলো (আল্লাহর দ্বীন মানুষের মাঝে) প্রচার করা। আর তোমরা যা প্রকাশ করো আর যা গোপন করো সবই আল্লাহ জানেন।’-সূরা আল মায়িদা: ৯৯

কোরআনে কারিমে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, যাতে তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে (দ্বীনের কথা) ব্যাখ্যা করতে পারে।’-সূরা ইবরাহিম: ৪

বিজ্ঞাপন

দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ না করাকে আল্লাহ নবুওয়ত ও রিসালাতের অযোগ্যতা হিসেবে আখ্যায়িত করে ইরশাদ করেছেন, ‘হে রাসূল! তোমার প্রতি তোমার রবের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার কর! যদি তুমি তা না করো, তাহলে তুমি তার বার্তা প্রচার করলে না।’-সূরা আল মায়িদা: ৬৭

যেহেতু দাঈর মাধ্যমে পৃথিবীতে মানব সভ্যতার সূচনা সুতরাং পৃথিবীটা দাঈ শূন্য হলেই কিয়ামত কায়েম হবে। এ বিষয়ে হজরত শাকিক (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি আবদুল্লাহ (রা.) ও আবু মুসা (রা.)-এর সঙ্গে একত্রে বসেছিলাম। এমন সময় তারা উভয়ে বললেন, নবী করীম (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই কিয়ামতের আগে এমন সময় আসবে যখন ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে এবং মূর্খতা ছড়িয়ে পড়বে। আর সে সময়ে হারজ ব্যাপক হবে। হারজ হলো- হত্যাকাণ্ড। -সহিহ বোখারি: ৬৭৮৬

হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে নবুওয়ত ও রিসালাতের সমাপ্তি ঘটলেও তাবলিগে দ্বীনের কাজ সমাপ্ত হয়নি আজও সেটা অব্যহত থাকবে কিয়ামত অবধি। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতকে দেওয়া হয়েছে দাঈর মহান দায়িত্ব। যেমন আল্লাহতায়ালা এ সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন, ‘বল, এটাই আমার পথ; আমি সজ্ঞানে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করি আমি এবং আমার অনুসারীগণ।’-সূরা ইউসুফ: ১০৮

যেহেতু দ্বীনের দাওয়াতের কাজ না থাকলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে তাই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইন্তেকালের আগে দাওয়াতের দায়িত্ব স্বীয় উম্মতের ওপর অর্পণ করে গেছেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার পক্ষ থেকে দ্বীনের একটি কথা হলেও পৌঁছে দাও।’ -সহিহ বোখারি: ৪৪১৮

যেহেতেু দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ অত্যন্ত মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ সেহেতু যে কেউ যেনতেনভাবে তা করতে পারে না। তাবলিগের জন্যে কিছু শর্ত রয়েছে এবং দাঈর জন্যে কিছু গুণেরও আবশ্যকতা রয়েছে। দাঈ যদি নিজের মধ্যে সেসব গুণ আয়ত্ব করতে ব্যর্থ হন, তাহলে বাহ্যিকভাবে তার কাজ তাবলিগ মনে হলেও আল্লাহর দরবারে সেটা সম্পূর্ণ মূল্যহীন। দাঈর মধ্যে যে গুণাবলি থাকা আবশ্যক সেগুলো হলো-

ওহির জ্ঞানের অনুসারী হওয়া: দাঈকে অবশ্যই ওহির জ্ঞানের অনুসারী হতে হবে এবং দাওয়াতের একমাত্র ভিত্তি হতে হবে ওহি তথা কোরআন ও সুন্নাহ। যেমন হজরত রাসূলুল্লাহকে (সা.) সম্মোধন করে মহান আল্লাহর নির্দেশ, ‘তোমার ওপর যে ওহি নাজিল করা হয়েছে তুমি তার অনুসরণ করো আর তুমি ধৈর্যধারণ করো যে পর্যন্ত না আল্লাহ ফায়সালা করেন আর আল্লাহই সর্বোত্তম ফায়সালকারী।’-সূরা ইউনুস: ১০৯

প্রজ্ঞা: দাঈকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সত্য প্রতিষ্ঠিত করার মতো প্রজ্ঞা এবং প্রমাণ ও যুক্তি যথাযথভাবে উপস্থাপনে বিজ্ঞ হতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার রবের পথে মানুষকে আহবান করো প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে আর প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে বিতর্ক করো উত্তম পন্থায়। তোমার রব জানেন তার পথ থেকে কে বিচ্যুত হয়ে গেছে আর তিনি জানেন হেদায়েতপ্রাপ্তদের সম্পর্কে।’-সূরা আন নাহল: ১২৫

ইখলাস: দাঈকে পার্থিব মোহমুক্ত হতে হবে। সে মানুষকে দ্বীনের দিকে আহবান করবে, দ্বীনের কথা প্রচার করবে ইখলাসের সঙ্গে। কোনো প্রকার পার্থিব মোহ তার মধ্যে থাকবে না। কোরআনে কারিমে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘বল, আমি এ জন্যে তোমাদের থেকে এটা ছাড়া অন্যকোনো প্রতিদান চাই না যে, যার ইচ্ছা সে তার রবের পথ অবলম্বন করুক।’ -সূরা আল ফোরকান: ৫৭

আল্লাহর ওপর ভরসাকারী: দাঈকে জীবনের সর্ববস্থায় একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে। যেমন আল্লাহতায়ালা নবী করিমকে (সা.) এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তুমি বলো, আমার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া অন্যকোনো ইলাহ নাই। আমি একমাত্র তার ওপরই নির্ভর করি আর তিনি মহান আরশের অধিপতি।’-সূরা আত তওবা: ১২৯

তাকওয়া: দাঈকে মুত্তাকি-পরহেজগার হতে হবে। পূর্ণমাত্রায় তাকওয়া তথা খোদাভীরুতা নিয়ে দাওয়াতের কাজ করতে হবে। ফাসেক-ফুজ্জারকে অনুসরণ করা যাবে না। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে নবী! আল্লাহকে ভয় করো আর কাফের ও মুনাফেকদেরকে অনুসরণ করো না। আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’-সূরা আল আজাযাব: ১

ধৈর্য: দাঈকে হতে হবে অত্যন্ত ধৈর্যশীল। বিরুদ্ধবাদিদের অবজ্ঞা-উপেক্ষা, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্যকরে দ্বীন প্রচারের মহৎ কাজ চালিয়ে যেতে হবে নিঃসংকোচে। আল্লাহতায়ালা আলোচ্য বিষয়ে স্বীয় হাবিবকে (সা.) কে ধমকের সুরে বলেছেন, ‘যদি তাদের উপেক্ষা তোমার কাছে দুর্বিসহ হয়, তাহলে পারলে জমিনে কোনো সুঢ়ঙ্গ খুঁজে নাও অথবা আকাশে কোন সিঁড়ি, তারপর তাদের কাছে কোনো মুজিযা নিয়ে এসো। যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তাহলে অবশ্যই তাদের সবাইকে হেদায়েতের ওপর একত্রিত করতেন। সুতরাং তুমি জাহেলদের অর্ন্তভূক্ত হবে না।’ -সূরা আল আনআম: ৩৫

উম্মতের মঙ্গলকামী: সাধারণ মানুষকে হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবাসতে হবে এবং সর্বদা তাদের মঙ্গল কামনা করতে হবে। যেমন আল্লাহ বলছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল এসেছে। তোমাদেরকে যেসব বিষয় বিপন্ন করে সেগুলো তার জন্য কষ্টদায়ক। সে তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি সে দয়াদ্র ও পরম দয়ালু।’-সূরা আত তওবা: ১২৮

পরস্পর সাহায্যকারী: দ্বীনের দাঈদেরকে অবশ্যই পরস্পরের সমর্থক ও সাহায্যকারী হতে হবে। যেমন কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করো, যখন আল্লাহ নবীদের থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তোমাদেরকে আমি কিতাব ও হেকমত যা কিছু দিয়েছি, অতঃপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সত্যায়নকারীরূপে যখন একজন রাসূল আসবে, তখন অবশ্যই তোমরা তার ওপর ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। -সূরা আলে ইমরান: ৮১

সুভাষী: দ্বীনের দাঈকে অবশ্যই সুন্দর ভাষা ও আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গীর অধিকারী হতে হবে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তার চেয়ে উত্তম ভাষা আর কার হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, সৎকাজ করে আর বলে, আমি মুসলমানদের একজন।’ –সূরা আল মুমিন: ৩৩

বস্তুত দাওয়াতের মাধ্যমে পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুগে যুগে। বস্তুত দাওয়াতের বিষয়বস্তুর মাহাত্ম্য এবং দাঈর গুণাবলি মানুষকে দলে দলে দ্বীনের পথে টেনে এনেছে। কিন্তু আজ দাওয়াতের কাজের ব্যাপকতা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হলেও মানুষ দ্বীনের প্রতি ততটা আকৃষ্ট হচ্ছে না, বরং ভীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে। ওয়াজ, বক্তৃতা ও লিখনি ইত্যাদি মাধ্যমে চলছে তাবলিগের কাজ, কিন্তু দাঈ গুণসম্পন্ন না হওয়ায় দাওয়াতের বিষয়বস্তু একই হলেও মানুষ দ্বীনের ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে পড়ছে- যা উম্মতের জন্যে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আল্লাহতায়ালা উম্মতের সবাইকে উন্নত গুণসম্পন্ন দাঈ হিসেবে কবুল করুন। আমিন।

লেখক: ইমাম ও খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ।