হজপালনকারীদের চাওয়া এক পশলা বৃষ্টি!
মক্কা নগরী (সৌদি আরব) থেকে: স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সকাল ৮টা। মসজিদে হারামের দেয়ালে লাগানো স্ক্রিনে দেখাচ্ছে তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিন তাপমাত্রা সকালেই ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রিতে ওঠানামা করে। বইতে থাকে গরম ও লু হাওয়া।
আজও বাতাস বইছে, কিন্তু তা ঝড়ো বাতাস। রোদের তেমন তেজ নেই, তবে রয়েছে ভ্যাপসা গরম। কিন্তু গত সোমবার (৫ আগস্ট) সন্ধ্যা থেকে বাতাস বইছে, তবে সেটা লু হাওয়া নয় অনেকটা ঝড়ো বাতাস, ধূলিযুক্ত বাতাস। দৃষ্টিসীমার মধ্যেই অন্ধকার দৃশ্যমান।
আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখে কিং আবদুল্লাহ গেটে দায়িত্বপালনকারী অফিসার হাম্মাদ নেসারের কাছে জানতে চাইলাম, হাবিবি! আকাশ নতুন বউয়ের মতো ঘোমটায় মুখ ঢেকেছে কেন? তিন বললেন, ‘বন্ধু! এ মেঘ খুব একটা সুবিধার নয়। ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস। যেকোনো সময় ভারী বর্ষণ হতে পারে।’
এখানকার মেঘ-রোদের লুকোচুরির হিসেব হজপালনকারীদের সবার জানা নেই, তবে তারা অপেক্ষায় আছেন বৃষ্টির। যে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কাবার তাওয়াফ করবেন, হাতিমে কাবায় মিজাবে রহমতের নিচে ভিজে মোনাজাত করবেন, মাতাফে দাঁড়িয়ে নফল নামাজ আদায় করবেন।
কমবেশি হজপালনকারীদের চাওয়া থাকে বৃষ্টির। হজের আগে হজপালনকারীরা সেই বৃষ্টিরই অপেক্ষা করছেন। অনেকে তো বৃষ্টিতে ভেজার আশা নিয়ে মসজিদের হারামে অবস্থান করছেন, কখন আসবে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি।
হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে আর বাকি মাত্র দু’দিন। এ সময়টাতে হজপালন করতে আসা সবাই মক্কা মোকাররমে অবস্থান করেন। যে কারণে এখন মক্কায় প্রচুর ভিড়। মসজিদে হারামের চারপাশের রাস্তাগুলোতে নামাজের দেড় থেকে দুই ঘণ্টা আগেই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ফলে বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রবেশপথগুলো। তখন মসজিদে হারামের এক্সটেনশন অর্থাৎ নতুন হারামে প্রবেশ করতে হয় নামাজের জন্য।
জারওয়াল, গাজা ও জান্নাতুল মোয়াল্লা এলাকার হোটেল কিংবা বাড়িতে ওঠা হজপালনকারীরা সহজে প্রবেশ করার সুযোগ পান নতুন হারামে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় মিসফালা, কেদুয়া ও আজিজিয়া এলাকায় অবস্থানরত হজযাত্রীদের। তাদেরকে অনেকটা পথ ঘুরে নতুন হারামে প্রবেশ করতে হয়। না হলে নামাজ আদায় করতে হয় রাস্তায়। তারপরও ক্লান্তি নেই কারও মাঝে। নামাজের সময় হওয়ার অনেক আগে থেকেই মানুষ যেতে থাকেন মসজিদে হারামের দিকে। লক্ষ্য একটাই মক্কায় অবস্থানকালীন সময়ে মসজিদে হারামে নামাজ আদায় করা।
লোকে-লোকারণ্য মক্কা। দলে দলে হজপালনকারীরা আসছেন। প্রত্যেক রাস্তায় ইহরাম পড়া মানুষের জটলা, মুখে তালবিয়া- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...।
মূলত হজের আগের সময়টাতে হজ পালনকারীরা মসজিদের হারামে নামাজ আদায় এবং তাওয়াফ করে সময় কাটান। অনেকে শুধু নামাজ আদায় না করে বিশ্রাম নেন, যেন মূল হজের আনুষ্ঠানিকতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। তারপরও প্রচুর ভিড়, প্রতি মুহূর্তেই আসছেন হজপালনকারীরা। আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ দর্শনের আজন্ম ইচ্ছা বলে কথা।
মুসলমান মাত্রই বায়তুল্লাহ তথা কাবাঘর দর্শন এবং তাওয়াফের তীব্র আকাঙ্ক্ষা লালন করেন মনে। যে কাবাঘরের দিকে মুখ করে প্রতিদিন নামাজ আদায় করেন সেই ঘরকে সরাসরি সামনে রেখে নামাজ আদায় এবং আল্লাহতায়ালার কাছে নিজেকে সমর্পণ, তার ঘরের সামনে বসে তার কাছে মোনাজাতের অনুভূতিই আলাদা। যে অনুভূতির বলে বা লিখে বুঝানো মুশকিল।
কাবাঘর হচ্ছে প্রথম ঘর, যা মানুষের ইবাদতের জন্য নির্মিত হয়েছে এবং যেকোনো উপাসনালয়ের চেয়ে কাবা ঘর বেশি প্রাচীন। সেই কাবাকে ঘিরে গড়ে ওঠা মক্কার অলিগলিতে এখন শুধু ইহরাম পরিহিত মানুষের ভিড়, আর তালবিয়ার আওয়াজ- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...। এভাবেই লাখো কণ্ঠের তালবিয়ার আওয়াজ মক্কার পাহাড়ে ভাজে ভাজে ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ইথারে।
কাবাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর হজের সময় ৩০ লক্ষাধিক মুসলমানের সমাগম ঘটে। এ ছাড়া সারাবছর ওমরা পালনের জন্য ছুটে যান আরও কোটি মানুষ। এই ছুটে যাওয়ার পেছনে এক অনাবিল ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি ও আধ্যাত্মিক আবেশ কাজ করে থাকে। যার দৃশ্যমান হয় হজযাত্রীদের চেহারায়। ভিড় ঠেলে, পায়ে হেঁটে ও গরম বাতাস উপেক্ষা করে কাবা পানে ছুটে যায় লাখো মানুষের ঢল। কিন্তু কারও মুখে নেই বিরক্তি। উল্টো বিনয়ের চূড়ান্ত প্রকাশকে বেশি দেখানোর প্রতিযোগিতা চলে। সাম্য আর ভ্রাতৃত্ববোধ এই মহাসম্মিলনের দেখা মেলে শুধু হজেই। মক্কায় উপস্থিত হজযাত্রীরা এখন সেই হজের অপেক্ষায়।