একগুঁয়ে নীতি নয়, পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ ইসলামের শিক্ষা
ইসলামে পরামর্শের গুরুত্ব অনেক। এমনকি আল্লাহতায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করার আগে ফেরেশতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে মূলতঃ আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে পরামর্শের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন।
আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব পরিহার করে অন্যদের সঙ্গে পরামর্শভিত্তিক কাজ করা ইসলামের শিক্ষা। অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, পরামর্শ না করেও তো উন্নতি-অগ্রগতি লাভ করা যায়, কিংবা উন্নতির পথে পরামর্শের খুব বেশি গুরুত্ব নেই। আপাত দৃষ্টিতে এটাকে পুরোপুরি অস্বীকার হয়তো করা যাবে না। তবে এটাও সত্য যে, জীবনযাপনের ক্ষেত্রে পরামর্শভিত্তিক পথ চলার যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।
ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই সব কাজ সম্পাদিত হতো পরামর্শের ভিত্তিতে। ইসলাম বরাবরই পরস্পরের পরামর্শকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে আসছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা পরামর্শের ভিত্তিতে সব কাজ সম্পাদন করো।’
শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে পরামর্শ করেছেন এবং পরামর্শের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। খেলাফত পরিচালনারও অন্যতম ভিত্তি ছিলো পরামর্শ। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা জাতীয় দুর্যোগে পরামর্শ করলে অনেক সহজেই তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব।
হাদিসে শরিফে আছে, ‘যে পরামর্শ নিয়ে কাজ করে তাকে লজ্জিত হতে হয় না, যে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে সে নিরাপদ থাকে।’
আচ্ছা, পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ আছে কি; যে জীবনে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়নি? মনে হয় নেই। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সমস্যায় পড়ে এবং সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠার চেষ্টাও করে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অভ্যাস হলো- সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা সময় দিতে চাই না। তাই সমস্যা সমাধানের বহু পথ ও উপায় থাকা সত্ত্বেও সেগুলো আমাদের চোখে পড়ে না। দ্রুত সমাধানের পথে অগ্রসর হই আমরা। অথচ তাড়াহুড়া করে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত সমস্যা সমাধানে খুব বেশি কার্যকর নয়। কারণ, দ্রুততার সঙ্গে গৃহীত সিদ্ধান্তে সমস্যার গভীরে দৃষ্টি দেওয়ার সুযোগ থাকে না; তাই সমাধানও সুদূরপ্রসারী হয় না।
মনে রাখতে হবে, জীবনযাপনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- আত্মম্ভরিতা পরিহার করে অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করা।
ইসলাম সব মানুষের রাজনৈতিক ও সরকারি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার উদারভাবে প্রদান করেছে। ইসলাম কোনো সমাজের মানুষকে উঁচু ও নিচু বা শাসক এবং শাসিত হিসেবে বিভক্ত করার পক্ষপাতী নয়। ইসলাম নির্দেশিত এই পরামর্শ ব্যবস্থা নিজ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
তবে পরামর্শের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- পরামর্শ যথার্থ এবং বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে করা। পরামর্শের কারণে অভিজ্ঞ ও চিন্তাশীলদের চিন্তাকে কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। আর অভিজ্ঞদের চিন্তার প্রভাবে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাও গভীর হয়, সমৃদ্ধ হয়।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা ধীরে ধীরে পরামর্শ ব্যবস্থা থেকে সরে আসছি। আমাদের মাঝে ঠাঁই করে নিয়েছে, একগুয়েমিপনা। নিজের কর্তৃত্ব বড় করে দেখার প্রবণতা। ফলে পরিবারে কলহ, সমাজে অশান্তি ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে অহরহ।
ইসলামে পরামর্শের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হলেও তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে পরামর্শ করতে নিষেধ করা হয়েছে। ওই তিন শ্রেণির মানুষ হলো- ভীতু, লোভী ও কৃপণ।
অভিজ্ঞ ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, ভীরু লোকের সঙ্গে পরামর্শ করতে নেই। কেননা সে বিপদে পড়লে গোপন তথ্য ফাঁস করে দিতে পারে। কৃপণ লোকের সঙ্গেও পরামর্শ করতে নেই। কেননা সে অন্যের উন্নতি সহ্য করতে পারে না। আর লোভীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে নেই, কেননা সে লোভ-লালসাকে সবসময় বড় করে দেখে। সুতরাং এমন লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করতে নেই।