থার্ড ক্যারিয়ার যুক্ত হলে হজযাত্রীদের অর্থ সাশ্রয় হবে, হাব মহাসচিব
মক্কা মোকাররমা (সৌদি আরব) থেকে: ১৫ আগস্ট ২০১৮। ফ্লাইট বিজি- ৫০৯৩। বাংলাদেশ বিমানের হজ ফ্লাইট। বেলা পৌনে ১টায় উড়াল দেবে জেদ্দার উদ্দেশে। হাব মহাসচিব শাহাদাত হোসাইন তসলিম যথাসময়ে পৌঁছে গেছেন বিমানবন্দরে। বোডিং পাশ সংগ্রহ করতে যাবেন, এ সময় জানতে পারলেন হজ এজেন্সির প্রতারণায় ভিসা হওয়া সত্বেও ৯ হজযাত্রী সৌদি আরবে যেতে পারছেন না। টিকেট না করেই গা ঢাকা দিয়েছে দুই এজেন্সির মালিক।
মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ততক্ষণে যাত্রাসঙ্গী ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ও ধর্ম সচিব মো. আনিসুর রহমান উঠে গেছেন বিমানে।
মুহূর্তের সিদ্ধান্তে যাত্রা বাতিল করলেন। কিভাবে হজযাত্রীদের মক্কায় নেওয়া যায়, সেই ভাবনাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। তড়িঘড়ি করে হজযাত্রীদের পাসপোর্টগুলো সংগ্রহ করলেন। এবার প্রয়োজন টিকেট। অসহায় হজযাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেই সংগ্রহ করলেন টিকেটের টাকা।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই ফোন দিলেন সৌদি এয়ারলাইন্সের কান্ট্রি ম্যানেজারকে। ১৭ আগস্ট পর্যন্ত চলবে এই উড়ান সংস্থাটির হজ ফ্লাইট। জবাব এলো, কোনো ফ্লাইটেই আসন খালি নেই। ভরসা কেবল রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থা ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।’ সর্বশেষ ফ্লাইট বিজি-৭০৯৩। ঢাকা ছাড়বে বিকেল ৪ টা ৫১ মিনিটে। হাতে সময় অল্প।
ফোন করলেন বিমানের এমডিকে। যে করেই হোক ৯টি টিকেট চাই। টিকেট মিললো। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পেরিয়ে গেলো- ফ্লাইটেই সময়। দুই ঘন্টা দেরিতে ছাড়লো সর্বশেষ হজ ফ্লাইট।
একে একে নয় হজযাত্রী বিমানে আরোহণ করলেন। সবার শেষে শাহাদাত হোসাইন তসলিম। পাইলট তখন এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে নিলেন তাকে।
ততক্ষণে বিমান যাত্রার বিলম্বের পেছনে নয় হজযাত্রীকে নিয়ে তসলিমের যুদ্ধের গল্পটা ছড়িয়ে গেছে যাত্রীদের কানে কানে।
শ্বাসরুদ্ধকর এ মিশন যেন হার মানায় মিশন ইম্পসিবলকেও!
চলতি মৌসুমে হজ ব্যবস্থাপনার নিয়ে মক্কায় বাংলাদেশ হজ মিশনে- হজ এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) কার্যালয়ে যখন বার্তা২৪.কমকে এ অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন, তখন কক্ষজুড়ে যেন পিনপতন নীরবতা।
‘আমি বলেছিলাম, ভিসা হলে কোনো হজযাত্রীকে রেখে আমি হজে যাবো না। আমি আমার কথা রেখেছি। আমার বাবা বেঁচে থাকলে এ কথা শুনে অনেক খুশি হতেন।
আমার বাবা নেই। বাবার বয়সী এই মানুষগুলোর মলিন মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। তাদের অনিশ্চিত যাত্রাকে নিশ্চিত করতে পেরেছি- এটাই আমার প্রাপ্তি।’
অবশ্য শাহাদাত হোসাইন তসলিমের জন্যে এ অভিজ্ঞতা নতুন নয়। আগেরবার ‘নিবিড় হজ-ওমরা অ্যান্ড ট্যুরিজম’ নামের এক এজেন্সি মালিকের প্রতারণায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে ৪৪ জনের হজযাত্রা। সেবার নিজেই সৌদি অ্যাম্বাসিতে ছুটে গিয়ে টানা দুই ঘণ্টা বসে থেকে ৪৪ হজযাত্রীর ভিসা করিয়ে আনেন শাহাদাত হোসাইন তসলিম।
কুমিল্লার সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের মরহুম মাওলানা রশিদ আহমেদের ছেলে তসলিম। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার বড় তসলিম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে উচ্চ শিক্ষার্থে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে।
বিশ্বের অন্যতম সেরা সিটি ইউনিভার্সিটি অফ নিউইর্য়ক থেকে পড়াশোনা শেষ করে নিজেকে গড়ে তোলেন উদ্যোক্তা হিসেবে।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে আমদানি- রপ্তানি বাণিজ্য। প্রথমে দেশ থেকে গ্রে টিশার্ট আমদানী, সময়ের ব্যবধানে নানা দেশ থেকে ফ্রোজেন ও ড্রাই ফুড আমদানি। তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও ডাইনেস্টি ট্রাভেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসাইন তসলিম হাবের নেতৃত্বে আসেন ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল। রাজধানীর নয়াপল্টনে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হজ এজেন্সির মালিকদের সংগঠন হজ এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) নির্বাচনে সরকার সমর্থিত গণতান্ত্রিক ঐক্য ফ্রন্টের প্যানেলে মহাসচিব নির্বাচিত হন তিনি।
নির্বাচিত হয়েই প্রথমে যে কাজটা করি, সেটা হলো- ট্রলি নিয়ে দুর্নীতির পাহাড়ে গুড়িয়ে দেওয়া। ট্রলির জন্যে প্রতি হজযাত্রীর কাছ থেকে ২৫শ’ টাকা নেওয়া হতো।
বিনিময়ে হাজার টাকার নিচে নিম্নমানের ট্রলি গছিয়ে দিয়ে লোপাট করা হতো- কোটি কোটি টাকা।
ধরেন, হাজীদের কাছ থেকে নেওয়া হলো- ৩০/৩১ কোটি টাকা। কেনা হলো- ৮ কোটি টাকার ট্রলি। টেন্ডারের নামে অবশিষ্ট টাকা লোপাট।
প্রথম চিঠিতেই ধর্ম মন্ত্রণালয়কে জানালাম, এটা চলতে দেওয়া যায় না। ট্রলি ব্যবসার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।
নানা হুমকি, চোখ রাঙানি, প্রচ্ছন্ন ভয়-ভীতির তোয়াক্কা না করে সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। বন্ধ হলো- ট্রলি কারবারে দুর্নীতি।
প্রশিক্ষণের জন্যে হজযাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া হতো জনপ্রতি ২শ’ টাকা।
আমি বললাম, এটা হাজীদের হক। তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জেলায় জেলায় শুরু হলো- হাজীদের প্রশিক্ষণ। আমি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে ইন্দোনেশিয়া সফরকালে দেখলাম, তারা হাজীদের খুঁটিনাটি বিষয় থেকে শুরু করে প্রতীকী কাবা ঘর তৈরি করে কিভাবে সেখানে তাওয়াফ করতে হবে সে প্রশিক্ষণটাও দিচ্ছে। আমাদের দেশে যে প্রশিক্ষণটা শুরু হলো, আশা করছি, একদিন আমরাও হজযাত্রীদের সে রকম নিবিড় প্রশিক্ষণ দিতে পারবো।
মক্কায় আগে হাবের অর্থে জমজম টাওয়ার বা হিলটনের মতো পাঁচ তারকা মানের হোটেলে থাকতেন হাবের শীর্ষ নেতৃত্ব।
গেলো বার আমি হিলটনে নিজের অর্থে রুম বুকিং দিলাম। মনে হলো- আরে আমি যে হিলটনে থাকছি, সবাই তো ভাববে হাবের অর্থে থাকছি।
তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে হিলটন ছেড়ে এলাম। হজযাত্রীর সংখ্যানুপাতে হাবের একটা বাজেট থাকে। ২০১৬ সালে ব্যয় হয়েছে ৫৪ লাখ টাকা। আমি দায়িত্ব নেবার পর গত বছর ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৭ লাখ টাকা। এবার তো ব্যয়ই দেখছি না।
আমি ব্যবসায়িক কাজে লন্ডন, নিউইর্য়ক, টরোন্টোতে যেসব হোটেলে থাকি, আপনি আমার সাথে মক্কায় আমার রুমে চলেন। কিছুতেই সে হিসাব মেলাতে পারবেন না। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হাজীদের জন্যে যে ১ ভাগ বাড়ি ফাঁকা থাকে, আমরা সেখানে উঠেছি।
লক্ষ্য একটাই দেশের অর্থ সাশ্রয় করা।
আমি যুদ্ধ করছি, বিমান পরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ে। হজযাত্রী পরিবহনে মাত্র দু’টি বিমান সংস্থার পরিচালনায় আমাদের আপত্তি রয়েছে।
হয় বিমানের ভাড়া কমিয়ে দেওয়া হোক, নয়তো থার্ড ক্যারিয়ার হিসেবে নতুন বিমান সংস্থাকে যুক্ত করা হলে এই খাতে মনোপলি ব্যবসা থাকবে না। প্রতিযোগিতা এলে হজযাত্রীদের অর্থের সাশ্রয় হবে।
ধরুন, বিমান যদি ভাড়া কমিয়ে দেয়, তাহলে সৌদি এয়ারলাইন্সকে হয় সে ভাড়ায় যাত্রী টানতে হবে- না হয়, ব্যবসা ছেড়ে যেতে হবে। তখন থার্ড ক্যারিয়ার হিসেবে অনেক পরিবহন সংস্থার ফ্লাইট পরিচালনার সুযোগ আসবে।
হজ নিয়ে সমন্বয় সভায় যখন আমি এসব কথা বলি, তখন অনেকে মন খারাপ। কিন্তু আমি বলেই যাবো। আমার কাছে দেশের মানুষের স্বার্থ আগে।
আমি হয়তো সুপারম্যান হতে পারবো না, কিন্তু সততা আর সাহস থাকলে যে অনেক কিছুতেই ঝলক দেখানো যায়- তা প্রমাণ করে দেবো।
নিজের সংগঠনের অনেক এজেন্সির বিরুদ্ধে তো নানা অভিযোগ। তাদের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি?
আমি দায়িত্ব নেবার পর অভিযোগ কমে এসেছে। এটাকে শূন্যের কোটায় আনার কাজ চলছে। হজ নীতিমালা থেকে হজ আইন হচ্ছে। এই আইনটা হলে দেখবেন অনেক কিছুই স্বচ্ছ হয়ে যাবে।
ব্যবসার পাশাপাশি মানুষের কল্যাণে কাজ করার ব্যস্ততায় আর গাঁটছড়া বাঁধার সময় হয়নি শাহাদাত হোসাইন তসলিমের। অকৃতদার বলেই কি এত সাহস?
না, আসলে ঠিক তা না নয়। বলতে পারেন আমার পারিবারিক আদর্শ, ঐতিহ্য আর বাইরে উচ্চ শিক্ষার প্রভাব।
রাজনৈতিক উচ্চবিলাস?
না, নেই। কুমিল্লা-১০ সংসদীয় আসনের সাংসদ, সফল পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের জন্যে আমরা গর্বিত।
অঢেল স্নেহ আর মমতায় তিনিই আমাকে গড়ে তুলেছেন। তার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার।
পুণরায় হাবের নেতৃত্বে আসার স্বপ্ন?
এখনও সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে এটা হলফ করে বলতে পারি যে, হাবের জন্যে আমার ব্যক্তিজীবনকে জলাঞ্জলি দিয়েছি।