জনগণের আস্থা অর্জনের পরামর্শ সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের

  • ইসমাঈল হোসাইন রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জনগণের আস্থা অর্জনের পরামর্শ সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের, ছবি: সংগৃহীত

জনগণের আস্থা অর্জনের পরামর্শ সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের, ছবি: সংগৃহীত

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র তিন মাস। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে ভোটের উত্তাপ। ইভিএমসহ নানা ইস্যুতে চলছে তর্ক-বিতর্ক। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারসহ বেশ কিছু বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এমন সব বিতর্কের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আশাবাদি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে নির্বাচনের আগে জনগণের আস্থা অর্জনের পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনার।

তারা বলছেন, নির্বাচনের আসল প্লেয়ার ভোটার। তাই জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। আর জনগণের আস্থা অর্জনে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা বলেছেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব মূলতঃ সরকারের। সরকারই এটা করবে। তারা না করতে পারলে এটা অবশ্যই অসুবিধার কথা। কী করলে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে সরকারকেই সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। সেটা সরকারের দায়িত্ব।

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি আব্দুর রউফ বলেছেন, ‘যদি রাজনীতিটাকে রাজার নীতি ধরেন, তাহলে নির্বাচনের দরকার নেই। আর যদি রাজনীতিকে নীতির রাজা হিসেবে চিন্তা করেন, তাহলে নির্বাচনের দরকার আছে। তাহলে আমরা সেভাবে চিন্তা করতে পারছি না কেন? যত কিছুই হোক নির্বাচন ছাড়া আমাদের কোনো গণতন্ত্র নেই। নির্বাচনের আসল প্লেয়ার ভোটার। এসপি, ডিসি সবাই ভোটার, তারা ভোটার না হলে এসপি, ডিসি হতে পারতেন না। সেই কালচার ডেভলপ করতে পারলে, নির্বাচন যে ধারায় আমরা চিন্তা করি সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আর তা না করতে পারলে সেটা খুবই অসম্ভব।’

সংবিধান অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা।

ফোরাম অব ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বডিস অব সাউথ এশিয়া (ফেম্বোসা) এর নবম সম্মেলনে তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

এই সম্মেলন আমাদের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে উৎসাহী করবে। আমরা আগেও বলেছি অংশগ্রহণমূলক আমরা চাই। সব সুষ্ঠু নির্বাচনে জন্য যা করা প্রয়োজন তাই করবে বর্তমান কমিশন।

এদিকে সংসদ নির্বাচনের আগে শেষ মুহূর্তে এসে ইভিএম নিয়ে অনেকটা বিতর্কের মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী জাতীয় নির্বাচনে সীমিত পরিসরে হলেও ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ইভিএমের বিতর্কের বিষয়েও কথা বলেছেন সাবেক দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনার।

জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিং ভোটিং মেশিন (ইভিএম) জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয় মত দিয়ে এটিএম শামসুল হুদা বলেছেন, ইভিএমের জন্য তাড়াহুড়ার কিছু নেই। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে এটি ব্যবহার করে সকলের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করে জাতীয় নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার করা যেতে পারে। আমাদের সময় চালু হওয়া ইভিএমের ধারাবাহিকতা থাকলে আজকের বিতর্কের জন্ম নিতো না। আমরা ইভিএম চালু করেছিলাম। কিন্তু তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়নি। আমাদের পরের কমিশন এটাকে হিমাগারে ফেলে রাখল। আবার এই কমিশন চালু করেছে। আমরা যেটা শুরু করেছিলাম তার ধারবাহিকতা রাখা হলে এখন কোন অসুবিধা হতো না।

জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম বিতর্কের প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন ইভিএম নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, এটা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের সিদ্ধান্তটাই সঠিক ছিলো। আমরা বলেছিলাম, আমরা ঝট করে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে যাবো না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এটা আমরা প্রথমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করব। স্থানীয় সরকারের কিছু কিছু জায়গায় এটা করবো এবং আমরা সেটা করেও ছিলাম। মানুষ তাতে ইতিবাচকভাবে সাড়াও দিয়েছিল। তবে যে মেশিনটা উদ্ভাবন করা হলো- তাতে আরো কি কি নিরাপত্তা সংযুক্ত করা যায়, আরো কীভাবে তা উন্নতি করা যায় এবং সমস্ত রাজনৈতিক দল যখন বিশ্বাস আনবে, সবাই যখন বলবে ঠিক আছে তখনই জাতীয় নির্বাচনের ব্যবহার করা উচিত।

ইভিএম কারো ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখনো এটি পুরোপুরিভাবে পরীক্ষা করা হয়নি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে আরো ব্যবহার করা উচিত। তারপর সেটা মনিটর করে, তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করে কী হয়েছে কী সুবিধা অসুবিধা যাচাই-বাছাই করে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘঠিয়ে কারিগরি ব্যবস্থাপনার আরো উন্নয়ন ঘটিয়ে যখন সফলতা আসবে তখনই জাতীয় নির্বাচনে এর ব্যবহার হবে। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একসঙ্গে করা ঠিক নয়। পরীক্ষামূলকভাবে করা যেতে পারে।

জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধন প্রশ্নে সাবেক সিইসি বলেন, এটা নিয়ে এখন মন্তব্য করে লাভ কি? যে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আগে তা যথোপযুক্ত কিনা দেখা উচিত। যারা এটা করছেন এবং যারা ক্ষমতায় আছেন বিষয়টি তাদেরই দেখা উচিত ছিলো। নির্বাচন খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এটা প্রতিযোগিতার বিষয়। ক্ষমতা দখলের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। রুলস অব দ্য গেম, লেভেল প্লেইং ফিল্ড এগুলো নিশ্চিত না করলে তো খেলা সমান হবে না। এটা নিশ্চিত করতে হবে।

শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষের ইভিএম বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নেই বলে মত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি আব্দুর রউফের।

তিনি বলেন, ইভিএম কি সাধারণ মানুষ তা জানে না। তাদের নানাভাবে বোঝানো হয়। টেকনোলজি যেহেতু এসেছে, তা তো আমি রুখতে পারব না। টেকনোলজি এখানে ঢুকবেই। তাই টেকনোলজিকে সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহার যেতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে যদি আগে থেকেই চিন্তা করেন যে ইভিএমে ভোট হলে একজন টেকনোলজি পরিবর্তন করে নিয়ে কেউ ভোট নিয়ে গেল। এটা আগে থেকে মাথায় ঢোকালে কিছুই হবে না। এটা চিনতে হবে, জানতে হবে। শতকরা ৯৮ ভাগ লোক ইভিএম মেশিনটা কি, টেকনোলজি কি, কিভাবে এটি আসে এ বিষয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণা নেই। অনেক ক্ষেত্রে গোলমাল হয়েছে। অনেক দেশ আবার সেটা বন্ধও করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, নিজের ওপর কনফিডেন্সটা আনলে পরে, এসব কিছু চলে যাবে। টেকনোলজি নিয়ে এমন রং (ভুল) ইনফরমেশন, হাফ নলেজ, কোয়ার্টার নলেজ দিয়ে টেকনোলজিকে সমালোচনা করতে গেলে বিষয়টি খারাপ হবে। এই মুহূর্তে হবে কি হবে না, তা সক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে। কিছু কিছু জায়গায় তো করেছেন, আস্তে আস্তে শেখান। এটা শতভাগ নিরাপদ কিনা সেটা ভোটারদের আগে বোঝানো চেষ্টা করেন। এডুকেটেড দ্যা ভোটারস, দ্যান ইউ কাম।

আগামি প্রজন্মের মাঝে বিশ্বস্ততার অভাব ঢুকে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আস্থাটা আমরা প্রায় হারিয়ে ফেলেছি। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে। মানবিকভাবে সবাইকে ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। দোষাদোষী করে নির্বাচন হবে না। অনাস্থা দিয়েও নির্বাচন হবে না। আমাদের মেনে নিতে হবে নির্বাচন ছাড়া আমাদের গণতন্ত্র নেই। আগামি প্রজন্মের মাঝে বিশ্বস্ততার অভাব ঢুকে গেছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। আস্থাটা আমরা প্রায় হারিয়ে ফেলেছি। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে।