প্রতিদিন ৩ মাইল পথ হেঁটে শহরে যান পত্রিকা পড়তে

  • রাকিবুল ইসলাম রাকিব, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ), বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পত্রিকাপ্রেমী মোসলেহ উদ্দিন মোসলেম। ছবি: বার্তা২৪.কম

পত্রিকাপ্রেমী মোসলেহ উদ্দিন মোসলেম। ছবি: বার্তা২৪.কম

ছোট একটা উঠান। সেখানে বিছানো আছে পলিথিন। তাতে রাখা আছে শত শত পুরানো পত্রিকা। তার ওপরে জমেছে ধুলাবালির প্রলেপ। সূর্যের আলোর তাপে পত্রিকা থেকে বেরিয়ে আসছে ছোট ছোট পোকামাকড়। আর এক বৃদ্ধ লোক তা পরিষ্কার করছেন খুব যত্ন করে।

গতকাল বুধবার (৯ জানুয়ারি) বিকেলে এই দৃশ্য দেখা যায় গৌরীপুর উপজেলার বেকারকান্দা গ্রামে। ওই বৃদ্ধের নাম মোসলেহ উদ্দিন মোসলেম (৭২)। তার বাবা মৃত রহিম উদ্দিন। মা মৃত আমেনা খাতুন। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। পেশায় শিক্ষক হলেও গ্রামবাসী তাকে চেনে একজন পত্রিকাপ্রেমী মানুষ হিসেবে।

বিজ্ঞাপন

কাছে গিয়ে পরিচয় দিলে এ প্রতিনিধির সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন মোসলেম। তিনি জানান, অভাবী পরিবারের ছেলে হলেও তার পত্রিকা পড়ার খুব নেশা ছিল।

তার সংগ্রহশালায় আছে-১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সংসদে দেওয়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষণ, শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধকালীন পত্রিকা, বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম মিটিংয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ (২১ জুন, ১৯৭৫), কাশ্মীর ও ফিলিস্তিন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, আদিবাসী কারা, শেখ হাসিনার বিভিন্ন কথা ও ট্রানজিট- এমন তথ্যসমৃদ্ধ দৈনিক।

বিজ্ঞাপন

আরও রয়েছে- চার্লস-ডায়না, ক্লিনটন-মনিকা, এরশাদ-মেরীর বিষয়ে লেখা পত্রিকাগুলোও। এছাড়া তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ষাট ও সত্তর দশকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইংরেজি ‘মস্কো নিউজ’ ও মার্কিন পরিক্রমা পত্রিকা, মাসিক কারেন্ট ওয়ার্ল্ডের সব সংখ্যা।

সেই সঙ্গে সযত্নে তার সংগ্রহে আছে- পুরাতন পঞ্জিকা ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র। ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ে মার্কিন নভোচারীদের চাঁদে অবতরণের বিষয়ে লেখা তৎকালীন দৈনিক ইত্তেফাক, মার্কিন পরিক্রমা ও পাকিস্তান আমলের কয়েকটি দৈনিক দেশপত্রিকা।

কিন্তু আলমারি কিংবা সেলফ না থাকায় এই বিশাল তথ্য ভান্ডারে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ শুরু হয়েছে। তাই বাড়ির উঠানে পলিথিন বিছিয়ে এগুলো পরিষ্কার করছেন তিনি।

এদিকে মোসলেমের কাছে সংগৃহীত পত্রিকাগুলো তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ হলেও জীবনযুদ্ধে এক পরাজিত সৈনিক তিনি। ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাশ করে অভাবে পড়ে ৫ বছর পড়াশোনা বন্ধ থাকে তার। পরে ১৯৭২ সালে ৩৪ টাকায় একটি ছাগল বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে কলেজে ভর্তি হন তিনি। এরপর ১৯৭৪ সালে এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৮৪ সালে এক স্কুলে চাকরির জন্য ১৭ শতাংশ জমি বিক্রি করে ৫ হাজার টাকা দক্ষিণা দেন। কিন্তু ভগ্নিপতি সাদত আলী ও ভাগ্নে নজরুল কাল হয়ে দাঁড়ান সেখানে । এ নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে তার পাওয়া চাকরিটাও হারাতে হয়। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ১৯৯৩ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেও তার আর ভালো চাকরি হয়নি। ভাগ্য প্রবঞ্চনায় করতে পারেননি বিয়েও।

আক্ষেপ নিয়ে মোসলেম বলেন, ‘আমি অসুস্থ মানুষ, কষ্ট করে চললেও বয়স্ক ভাতা পাই না। নিজের একটুখানি জমির উপর সরকারি ঘর চেয়েও পাইনি। অভাবের কারণে ৫ টাকা দামের একটা পত্রিকা দুই জনে মিলে কিনে পড়ি। কিন্তু সেই পত্রিকাটা পড়ার জন্য আমাকে প্রতিদিন ৩ মাইল পথ হেঁটে শহরে যেতে হয়।’

এরই মাঝে বিকেলের রোদ হেলে পড়েছে পশ্চিমে। বেকারকান্দা গ্রামে অন্ধকার নেমে আসছে একটু একটু করে। এমন সময় গল্পে এসে যোগ দেন মোসলেমের বড় ভাই আবুল হাসিম। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় মোসলেম বিয়ে করেনি কেন? বিয়ে করলে তো এই বয়সে স্ত্রী-সন্তানরা তার সেবা করত। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা তো বলি মোসলেম তুই বিয়ে কর, কিন্তু সে রাজি হয় না।’

এ সময় কথার মাঝে মুচকি হেসে মোসলেম বলেন, ‘বুড়ো মানুষের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে কে? পারলে আমার মৃত্যুর আগে একটা ঘর ও আলমারি কেনার ব্যবস্থা করে দিন। আমি পত্রিকাগুলো যেন সেই আলমারিতে সংগ্রহ করে রাখতে পারি।’