ফিরে দেখা

মুনীর-খুকু এবং রীমা হত্যা ট্র্যাজেডি



তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
সংবাদপত্রে মুনীর-খুকুর ফাঁসির খবর

সংবাদপত্রে মুনীর-খুকুর ফাঁসির খবর

  • Font increase
  • Font Decrease

সময়টা আজ থেকে অনেকদিন আগের। ১৯৮৯ সালের এপ্রিল মাসের শুরুর দিক, প্রকৃতিতে তখনও ফাগুনের আগুন হাওয়া বিদ্যমান। ভোরের আলো মাত্র ফুটে উঠছে, অদূরে মসজিদের মিনার হতে ভেসে আসছে মোয়াজ্জিনের দরদমাখা গলা। জীবিকার সন্ধানে মানুষ বেরিয়ে যাচ্ছে ঘরের বাইরে। ঠিক তখনই তাদের চোখে পড়ে একটি মর্মান্তিক দৃশ্য। ঢাকা চিটাগাং রোডের মুক্তি সরণির নিকট মিজমিজি গ্রামে যাওয়ার কাঁচা রাস্তার মোড়ে একটি লাশ পড়ে আছে। আরেকটু কাছে গেলে দেখা যায় লাশটা একজন মেয়ে মানুষের। পুরো শরীরে আঘাতের দাগ, চেহারায় আভিজাত্যের রঙ ফুটে আছে তখনও। গায়ে সোনার গহনা দেখে বুঝতে বাকি থাকে না মেয়েটি কোনো অবস্থাসম্পন্ন ঘরের। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পরিস্থিতি দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয় এটা কোনো ডাকাতি বা ছিনতাই নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তা না হলে গায়ে গহনা রেখে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। পাশে খালের মধ্যে পাওয়া যায় রক্ত মাখা প্যান্ট, আরেকটু দূরে দেখা যায় পড়ে আছে একটি ধারাল ছুরি। পুলিশ বুঝতে পারে কেউ তাকে হত্যা করেই ফেলে রেখেছে এখানে। কিন্তু কেন? এই মেয়েই বা কে? উপস্থিত জনতাসহ সকলের মুখে তখন এই একটাই প্রশ্ন।

এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে খুবই বেদনা-বিধুর এবং নির্মম এক তথ্য। সেই সময় সারা বাংলাদেশে চায়ের দোকানে, অফিস পাড়ায় কিংবা ট্রেনে বাসে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনা। প্রতিদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হতে থাকে এই খুনের সংবাদ, বিচারের আপডেট খবর। সব জায়গা থেকে রব ওঠে খুনীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। যেন আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে না পারে সন্ত্রাসী, সেই দাবিতে চলে নানা স্লোগান প্রতিবাদ। মোটকথা সারা বাংলাদেশ জড়িয়ে পড়ে এই ঘটনায়।

পুলিশের সূত্রে পরিচয় মেলে মেয়েটির। নাম শারমিন রীমা। শহিদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন হোসেনের মেয়ে। যে নিজাম উদ্দিন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নির্মমভাবে নিহত হন, সেই নিজামুদ্দিনের মেয়েকে স্বাধীন দেশে এমন নির্মমতা বরণ করে নিতে হবে তা হয়তো তিনি ভাবেননি। যাকে বিয়ের মাত্র চার মাসের মাথায় নির্মমভাবে হত্যা করে তারই স্বামী। হাত থেকে তখনও যায়নি মেহেদির দাগ, বিয়ের এলবামগুলোতে তখনও জমেনি একটি ধুলো। কিন্তু তারই আগে সে লাশ হয়ে গেল। তার কবরে উঠে গেল ঘাস। পরিচয় পাওয়া যায় রীমার স্বামীরও। মুনির হোসেন সুরুজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল এবং ডাক্তারদের সংগঠন বিএমএ’র প্রাক্তন সভাপতি ডাঃ আবুল কাশেম এবং সে সময়ের খ্যাতনামা গাইনি ডাক্তার মেহেরুন্নেসার ছেলে। নিজেও পড়াশোনা করেছেন আমেরিকায় উইসকনসিন ইউনিভার্সিটিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে।

নৃশংস খুনী এরশাদ শিকদারের শুরু ও শেষ

তাদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৮৮ সালের ১১ ডিসেম্বর। বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে মুনির দেশে এসে শুরু করেছিলেন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বিক্রয়ের ব্যবসা। সবকিছু ভালোই চলছিল। বাবা মা তাই ছেলেকে বিয়ে দিতে চান। মেয়ে খোঁজা হয়। রীমাকে পছন্দ হয় তাদের পরিবারের। মেয়ের পরিবারও ছেলের খোঁজ নেন। সম্ভ্রান্ত ফ্যামিলি, দেখতে শুনতে ভালো, ছেলে নিজেও শিক্ষিত এবং ব্যবসায়ী। ব্যাস, আর কী লাগে। দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন রীমা এবং মুনির।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/22/1563795235721.jpg
পুরনো ছবিতে রীমা ও মুনীর ◢

 

ভালোই যাচ্ছিল তাদের দিনকাল। কিন্তু কিছুদিন পরে শুরু হয় অন্য যন্ত্রণা। স্বামীর ঘরে মন টেকে না। বউয়ের সাথে সামান্য বিষয় নিয়ে শুরু হয় ঝগড়া। এরই মাঝে রীমা একদিন দেখতে পান স্বামীর শার্টের মধ্যে লিপস্টিকের দাগ। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, পায়ের তল থেকে সরে যায় মাটি। এ কোথায় এসে পড়লেন তিনি! ভাবলেন যাই হোক, আজকে জিজ্ঞেস করতেই হবে। স্বামী বাসায় আসলে জিজ্ঞেস করেন রীমা, কিছুক্ষণ চুপ থাকেন মুনীর। এরপর এমন পরিস্থিতে পুরুষ যা করে, মিথ্যার পর মিথ্যা বলে এড়িয়ে যেতে চায় ঘটনা থেকে। যখন আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না তখন শুরু হয় উচ্চবাচ্য, হাতাহাতি। লাথি মেরে সরিয়ে দেন রীমাকে। রীমা সে রাতে আর ঘুমাতে পারেন না। বালিশ ভেজান কান্নায়। কাকে দুষবেন তিনি, বাবা মাকে, স্বামীকে নাকি তার কপালকে?

বছর খানেক আগের কথা। মুনিরের মা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ মেহেরুন্নেসার ছিল একটি ক্লিনিক। সেখানে প্যারালাইজড হয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রাম পোর্টের ইন্সপেক্টর আবু জাফর। সাথে আসেন তার চল্লিশোর্ধ্ব স্ত্রী খুকু। দেখতে শুনতে খুব একটা মন্দ নয়। এ বয়সের শান্ত সচেতন নারীদের মতো তারও ছিল আকর্ষণীয় দেহাবয়ব। মুনীরের সাথে এখানেই পরিচয় ঘটে খুকুর। এ বয়সের নারীদের প্রতি অনেক তরুণের দুর্বলতা থাকে। অনেকে অনেক রকমের ফ্যান্টাসিতে ভোগে। দীর্ঘদিন সংসার যাপন করার ফলে একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে নারীরাও ক্ষেত্র বিশেষে এসব পুরুষদের সান্নিধ্যে আসে। অন্যতম কারণ হয়তো ঘরে থাকা সঙ্গী তার কথা শুনতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। মুনীর-খুকুও নিজের দুঃখ শোনানোর, নিজের গল্প ভাগ করার একজন মানুষ পেলে একটু নির্ভার বোধ করত। কিন্তু কথা বলতে বলতে অনেক ক্ষেত্রেই সেসব সম্পর্ক আর খালি কথার ভেতর আটকে থাকে না। আর তখনই শুরু হয় বিপত্তি। মুনীর-খুকুর বেলাতেও ঘটেছিল এমন বিপত্তি।

অসুস্থ স্বামীকে চিকিৎসা করাতে আসা খুকুকে নানা বিষয়ে সাহায্য করেন মুনির। বেশ খানিকটা সময় তারা গল্প গুজব করেন প্রতিদিন। এতে মুনীরের যেমন ভাল্লাগে, খুকুর তেমন সময় কেটে যায়। কিন্তু কথা একটা সময় আর কথা থাকে না। হাসপাতালের বাইরেও তারা দেখা সাক্ষাত শুরু করেন। জড়িয়ে পড়েন সম্পূর্ণ অনৈতিক একটা সম্পর্কে। সহজে যোগাযোগের জন্য মুনীর, খুকুকে লাললামটিয়ায় একটা বাসাও ভাড়া করে দেন। চলতে থাকে তাদের এই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, যেটাকে আমরা পরকিয়া হিসেবে জানি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/22/1563795348682.jpg
পুরনো ছবিতে খুকু ◢

 

এই পরকিয়ায় আসক্ত মুনীর বিয়ের প্রথম দিকে তার বউকে নিয়ে সুখে থাকলেও কিছুদিনের মধ্যেই আবার খুকুর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। আর এর ফলেই ধরা পড়েন রীমার কাছে। তাদের আর বনাবনি হয় না একেবারেই। রীমা কাঁদতে থাকেন দিনের পর দিন। স্বামীর অবহেলা তিনি সহ্য করতে পারেন না। পাশাপাশি চলতে থাকে বিভিন্ন শারিরীক নির্যাতন। বেঁচে থাকাকে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর মনে হতে থাকে তার।

কিন্তু এর কিছুদিন পরে ঘটে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। বদলে যেতে থাকে মুনীর। বাসায় এসে আর স্ত্রীকে মারধর করে না। রোজই কিছু না কিছু নিয়ে আসে তার জন্য। কথা বলে, গল্প করে, স্বামীসুলভ আদর সোহাগও করে। রীমাও খুশি হয়। স্বামীর এমন বদলে যাওয়া দেখে সে খুবই খুশি হয়। সেও আর পারতপক্ষে আগের কথা তোলে না। একপাশ থেকে ভালোবাসা আসলে অপর পাশ থেকে মানুষ দায়িত্ববোধ আশা করে। রীমাও তার ব্যত্যয় করে না। সে তার দায়িত্ব পালন করে অক্ষরে অক্ষরে। ভালোবাসার বিনিময়ে সেও আগলে রাখে তার স্বামীকে। মুনীর নিজেই রীমাকে বলে খুকুকে সে ছেড়ে দেবে। তার সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না। এর কিছুদিন পরে মুনীর খুকুকে তার অফিসে আসতে বলে। রীমাও সেখানে উপস্থিত ছিল। সেখানে রীমা খুকুকে তার স্বামীর সাথে মিশতে বারণ করে। খুকু কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। যাওয়ার সময় সে রীমাকে বলে যায়, আমি তোমাকে দেখে নেব। দেখব কে জেতে আর কে হারে। সেই রাত্রে মুনীর রীমার ইস্কাটনের বাড়িতে রাত্রি যাপন করে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/22/1563795290586.jpg

রীমার ইস্কাটনের বাসা ◢

 

একদিন রাতে এমনই পাশাপাশি শুয়ে দুজন। মুনীর রীমার পাশ ঘেঁষে শোয়। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে। মুনীর রীমাকে বলে, তোমাকে নিয়ে তো আসলে খুব বেশি কোথাও যাওয়া হয়নি আমার। তাই চলো দুজন মিলে চিটাগাং ঘুরে আসি। রীমা খুশি হয়। তার ভেতরের কোনো এক পুকুরে ফোটে ওঠে একশো একটা পদ্মফুল। সেই ফুল দুলতে থাকে বাতাসে, যেই বাতাস এসে শীতল করে দেয় রীমার মনটাকেও।

পরদিন তারা রওয়ানা হয়। সারাদিন এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি করে রাতে আশ্রয় নেয় হোটেল সৈকতে। সেখান থেকে ফিরে আসে পরেরদিন রাতে। বসন্ত আর হলুদ যেমন মাখামাখি, তেমনই বসন্তের সাথে বাতাসেরও আছে একটা গভীর সম্পর্ক। ১৯৮৯ সালের এপ্রিলের নয় তারিখ, বাংলা ক্যালেন্ডারে তখন বসন্ত বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এগিয়ে আসছে নতুন আরেকটি বৈশাখ। এমনই এক বাতাস ভরা রাতে খোলা আকাশের নিচে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল মুনীর এবং রীমা। গাড়ি যখন নারায়ণগঞ্জের মিজমিজি গ্রামের কাছে এসে পৌঁছল, তখন গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিল মুনীর। রীমা কারণ জিজ্ঞেস করল। মুনীর চুপচাপ নেমে গেল গাড়ি থেকে। চুপচাপ ফিরে এলে রীমা জিজ্ঞেস করল শরীর খারাপ কিনা। মাথা টিপে দিতে চাইল রীমা। কিন্তু মুনীর ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলেন তার হাত। গাড়িতে থাকা একটি বোতল দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন মাথায়। রীমা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। তার স্বামীর কী হলো হুট করে! সে পড়ে গেল ঘোরের ভেতর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্বিতীয় আঘাত। রীমার পুরো দুনিয়া তখন ঘুরতে থাকে। চোখের সামনে হয়তো ভেসে ওঠে সকল ঘটনা। তার শহিদ বাবার কথা হয়তো ভেসে আসে মনে, কিংবা আদর করে মুখে তুলে মায়ের খাইয়ে দেওয়ার কথা। আটলান্টায় স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকা বোনটার কথাও হয়তো চোখে ভাসে। মৃত্যুর সমইয় নাকি এমনই হয়। প্রিয়জনদের আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায় সবাই। যে আত্মহত্যা করে মারা যায়, সেও নাকি বেঁচে যাওয়ার চেষ্টা করে। এরই মধ্যে মুনীর গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। টেনে হিঁচড়ে নামায় রীমাকে। গাড়িতে রাখা একটা ধারাল চাকু দিয়ে পেটের মধ্যে আঘাত করতে থাকে। রীমা একবার হাতে ধরে, একবার পায়ে। এদিক সেদিক তাকায়, গভীর অন্ধকার ছাড়া তার চোখের সামনে আর কিছু ভাসে না। হাতে পায়ে ধরে রক্ষা হয় না মেয়েটার। খুকুর সাথে পরকিয়ায় আসক্ত মুনীরের আঘাতে জর্জরিত হয়ে একটা সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

মৃত্যু নিশ্চিত হলে মুনীর গাড়ি স্টার্ট দেয়। একটু দূরে ডোবায় গিয়ে নিজের পরনের প্যান্ট এবং রক্তাক্ত জামা ছুড়ে ফেলে ডোবায়। হাতে থাকা ছুরিটা ছুড়ে মারে আরেকটু দূরে। গাড়ি নিয়ে আগায় যাত্রাবাড়ির দিকে। নিজের গাড়িটি ফেলে রেখে যায় সায়েদাবাদের বাস টার্মিনালের উল্টো দিকে। গাড়িটি তালাবদ্ধ করে রাখে সে। অপরাধী যতই অপরাধ করুক, সে একটা না একটা চিহ্ন ফেলে যায় সবসময়। মুনীরও সেই কাজ করল। রক্ত মাখা সব জামা ফেলে দিলেও একটি গেঞ্জি রয়ে যায় গাড়ির ভেতর। আর গাড়ির গায়ে রয়ে যায় রক্তের কিছু চিহ্ন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে গাড়িটি যখন পুলিশের হাতে আসে তখন পুলিশের কাছে বিষয়টি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়।

মুনীর গিয়ে আশ্রয় নেয় হোটেল বদরে। সেখানে সে বিশ্রামের জন্য গেলে হোটেলের দারোয়ান আলী হোসেন তাকে ২০৩ নাম্বার রুমে নিয়ে যায়। ডাঃ মেহেরুন্নেসার ছেলে পরিচয় পাবার পর আলী হোসেন তাকে জিজ্ঞেস করে বাসা ছেড়ে সে হোটেলে কেন এসে উঠল। মুনীর তার স্ত্রীকে হত্যার কথা বলায় কিছুটা ভয় পেয়েই হয়তো আলী হোসেন চলে যায়। এরমাঝে হোটেল কক্ষে সে আত্মহত্যা করার জন্য বিছানার চাদর গলায় বেঁধে উপরে ফ্যানের সাথে ফাঁস দেওয়ার চেষ্টা করলে পাশের রুমের লোকেরা তালা ভেঙে ভেতরে এসে তাকে উদ্ধার করে এবং সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে সে তার মায়ের সাথে ফোনে আলাপ করে এবং একজন আইনজীবী নিয়ে হাসপাতালে আসতে বলে। এর মধ্যে পুলিশ তার খোঁজ পেয়ে যায়, তাকে গ্রেফতার করে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/22/1563795440555.jpg
মুনীর খুকুকে নিয়ে প্রকাশিত ভিডিও নাটক ◢

 

গ্রেফতার হওয়ার পর মুনির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। যেখানে সে বলে—যেদিন খুকুর সাথে তার অফিসে রীমার দেখা হয় সেদিন রীমা খুকুকে তার সাথে মিশতে মানা করলে খুকু তার কাছে জানতে চায় সে কী করবে। মুনীর তখন কোনো জবাব দেয় না। খুকুর চোখ বেয়ে টলটল করে জল নামে। এরপর যখন খুকু রীমাকে হুমকি দিয়ে মুনীরের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় তখন তার খুব মায়া হয়। খুকুর প্রতি তার ভালোবাসা আবার জেগে ওঠে। আর যার ফলে সে তার জীবন থেকে রীমাকে সরিয়ে দিতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

জেরা, শুনানির পর ১৯৯০ সালের ২১ মে আদালত এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন।

মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় মুনীর ও খুকুকে। মোট ৬৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যপ্রদানের মাধ্যমে রায় হয় মামলাটির। কিন্তু পরে মামলাটি আবার হাইকোর্টে ওঠানো হলে আদলত মুনীরের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখলেও খুকুকে বেকসুর খালাস দেন। তখন সারা দেশেই এর প্রতিবাদ হয়েছিল। লোকে মুনীরের সাথে খুকুরও ফাঁসি চেয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞ আদালত সে সব দাবি আমলে নেননি। এরপর মুনীরের প্রাণ রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে পুনঃ পুনঃ আবেদন করা হলেও প্রেসিডেন্ট সে আবেদনে সাড়া দেননি। মুনীর খুকুর এই ঘটনা এতটাই আলোচিত হয়েছিল যে এটা নিয়ে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মঞ্চনাটক, যাত্রা পালা এবং অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়। ১৯৯৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে মুনিরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সমাপ্ত হয় আলোচিত ওই হত্যার বিচারের।

   

নগরে ফুলের জলসা, গ্রীষ্মের উত্তাপে সৌরভ, স্বস্তি 



মানসুরা চামেলী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
হাতিরঝিলে নাগরিক পর্যটকদের স্বাগত জানায় উচ্ছল জারুল, রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া ও সোনাইল/ছবি: নূর এ আলম

হাতিরঝিলে নাগরিক পর্যটকদের স্বাগত জানায় উচ্ছল জারুল, রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া ও সোনাইল/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

চারিদিকে খাঁ খাঁ রোদ্দুর। যেন বইছে গনগনে আগুনের ফুলকি। চারপাশের পরিবেশ ফুটন্ত কড়াইয়ে মতো টগবগে। দাবদাহের তেজে ব্রহ্মতালু ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তাপদগ্ধ চরাচর ক্লান্ত, স্তব্ধ, স্থবির। বৈশাখের রুদ্র রূপে বিপর্যস্ত নাগরিক পরিসর আর জনজীবন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় উচ্চারিত গ্রীষ্মের প্রতিচ্ছবিই দেখা যাচ্ছে রাজধানীর প্রকৃতিতে: 'প্রখর তপনতাপে, আকাশ তৃষায় কাঁপে,/বায়ু করে হাহাকার।’

পরিস্থিতি যখন এমনই খরতাপে পোড়া ও তামাটে, ঠিক তখন একপশলা বৃষ্টির ছোঁয়া ঢাকা নগরীর পথে পথে জাগিয়েছে খণ্ড খণ্ড ফুলের জলসা। গ্রীষ্মের এই রংবাহারের উজ্জ্বলতা এবং সৌরভ; নাগরিক বিড়ম্বনা মুছে বুলিয়ে দিয়েছে অনিন্দ্য স্বস্তির পরশ।

সাদা গোলাপীর মিশলে সোনাইল—দূর থেকে মনে হয় পুষ্পিত পোস্টকার্ড/ছবি: নূর এ আলম


নগরের ইটপাথর, কংক্রিটের কংকালের মধ্যে তাপ ও দূষণের সাম্রাজ্যে নানা রঙের বর্ণিল ফুলের বৃন্ত ও পত্রালীতে খেলা করছে মুক্তি ও স্বাধীনতার আরাম। কৃষ্ণচূড়ার বুনো ঘ্রাণ, টগরের শুভ্রতা এবং সোনালুর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য দাবদাহে পীড়িত রাজধানীতে বসিয়েছে ফুলের জলসা। নিয়ে এসেছে রঙের উল্লাস। গন্ধের মাদকতা। ভালোলাগার এক অনির্বচনীয় অনুভূতি।

উচ্ছল জারুল


গ্রীষ্মের তপ্ত রোদের মধ্যেই শুক্রবার ও শনিবার ছুটির জোড়া দিনে হাতিরঝিলের নাগরিক পর্যটকদের স্বাগত জানাল উচ্ছল জারুল, রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া, কনকচূড়া ও সাদা গোলাপীর মিশলে সোনাইল। খুব কাছ থেকে দেখলে মনে হাতিরঝিলে ‘সোনাইল ব্লসম উৎসব’ চলছে। আর দূর থেকে মনে হয় পুষ্পিত পোস্টকার্ড।

কৃষ্ণচূড়ার বুনো ঘ্রাণ, টগরের শুভ্রতা এবং সোনালুর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য দাবদাহে পীড়িত রাজধানীতে বসিয়েছে ফুলের জলসা/ছবি: নূর এ আলম


হালকা বাতাসে সোনাইল দুলুনির সমান্তরালে গুঞ্জরিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়' গানের শিহরণ জাগানিয়া আবেশ। হাতিরঝিলের পথে পথে হেঁটে ক্লান্ত হলে ছায়া দিতেও প্রকৃতি তৈরি হয়ে আছে। ফুলে ভরা মেঘশিরীষ গাছ প্রসারিত শাখা ও পল্লবে কাছে টানছে পথিকের মনোযোগ। এখানে জারুলের এমন অপূ্ব রূপ— চলতি পথে গাড়ি থামিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে থমকে গিয়ে ক্যামেরাবন্দী করছেন নগরীর মানুষ।

নানা রঙের বর্ণিল ফুলের বৃন্ত ও পত্রালীতে খেলা করছে মুক্তি ও স্বাধীনতার আরাম/ছবি: নূর এ আলম


‘কি বলব- এত গরম, সহ্য করার মতো না। আমার বাসা মধুবাগে। প্রায় হাতিরঝিলে বাতাস খেতে আসি। এত ভালো লাগে বোঝাতে পারব না। তার সঙ্গে বাহারি ফুল তো রয়েছেই। অনেক ফুল চিনি না— কিন্তু ব্যাপারটা অসাম’, বলছিলেন হাতিরঝিলের বেঞ্চ বসা ইরাব নামের এক টগবগে যুবক। এখানকার প্রকৃতি যেন অগোচরে ইরাবের মতো অনেক তরুণ-যুবককে প্রকৃতিপ্রেমী ও ভাবুক বানিয়ে দিয়েছে।

গ্রীষ্মের এই রূপ শুধু ঢাকার পর্যটন-হটস্পট হাতিরঝিলে নয়, প্রাচীন ও রমনীয় রমনা পার্ক, কলোনিয়াল আরবান নস্টালজিয়া মিন্টো রোড, আধুনিক এয়ারপোর্ট রোড, কুড়িল, স্থাপত্যকলার নান্দনিক সংসদ ভবন এলাকা ও ক্রিসেন্ট লেকসহ যেদিকে চোখ যায়- শুধু চোখে পড়ে ফুলের হাসি, রঙের খেলা। ইন্দ্রিয় স্পন্দিত হয় উদ্ভিদজাত গন্ধে ও সৌরভে।

কুড়িলে কৃষ্ণচূড়ার উচ্ছ্বাস/ছবি: নূর এ আলম


নগরীর সর্বাধুনিক সংযোজন মেট্রোরেলে বা এক্সপ্রেস ওয়ে থেকে বিস্তৃত রাজধানীর দিকে তাকালে সুবিশাল দালান-কোঠা আর সবুজের ফাঁকে মাথা চাড়া দিচ্ছে জারুল, কৃষ্ণচূড়া ও গ্রীষ্মকালীন গাছপালার উচ্ছ্বাস। কোথাও কোথাও ছাদবাগানের বিভা। ফুলে ফুলে রঙিন এসব দৃশ্য প্রাচ্যের রোমান্টিক নগরী ঢাকার প্রাচীন স্মৃতি মনে দোলা দেয়। ক্ষণিকের জন্য বর্ণিল ফুলে ছাওয়া এক অন্য ঢাকা হৃদয়ের অলিন্দে জায়গা করে নেয় সুভাষিত আবাহনে।

সবুজ পাতা ছাপিয়ে সোনালি রঙের ফুলে সেজেছে সোনালু গাছ/ছবি: নূর এ আলম


সংসদ ভবন এলাকা ও ক্রিসেন্ট লেকে গেলে তো মনে হবে সুনীল আকাশের পানে চেয়ে কৃষ্ণচূড়া বলছে- ‘কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে-/আমি ভুবন ভোলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে’। এখানে চোখে পড়ে লেকের দু’ধারে কৃষ্ণচূড়ার সুদৃশ্য বীথি-  ‘ডাক দিয়ে যায় পথের ধারের কৃষ্ণচূড়ায়।’ বাতাসে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ঝরে রঙিন হয়ে ওঠা চলার পথ।

চন্দ্রিমা উদ্যান; গাছের পাতার সবুজ রঙ আজ যেন আরও গাঢ় হয়েছে


এমন মনোরম প্রকৃতিতে ক্রিসেন্ট লেকে গরম নিবারণে নেমে পড়েছে একদল ডানপিটে কিশোর। যারা কৈশারকাল উদযাপনে মেতেছে। 

পাশেই চন্দ্রিমা উদ্যান; গাছের পাতার সবুজ রঙ আজ যেন আরও গাঢ় হয়েছে। গত রাতে ঝরেছে বহু প্রতীক্ষার বৃষ্টি। দীর্ঘ তাপদাহে পোড়ার পর বৃষ্টির পরশ পেয়ে গাছগুলো যেন- প্রাণ পেয়েছে। চড়া রোদে স্নিগ্ধ হয়ে দেখাচ্ছে সবুজ পাতা। নেতিয়ে পড়া ফুল আড়মোড়া ভেঙে সুভাষ ছড়াচ্ছে। প্রাণবন্ত সবুজ পাতার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে হরেক রঙ ও রূপের ফুল।

কংক্রিটের নগরীতে কৃষ্ণচূড়ার স্পর্শ/ছবি: নূর এ আলম


‘শোনো বন্ধু শোনো,/ প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা/ ইটের পাঁজরে, লোহার কাটায়/দারুণ মর্মব্যথা।/এখানে আকাশ নেই,/এখানে বাতাস নেই,/ এখানে অন্ধ গলির নরকে/মুক্তির আকুলতা।/জীবনের ফুল মুকুলেই ঝরে...।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তার গানে নগরীকে তুলনা করেছেন ইটপাথরের প্রাণহীন গলি হিসেবে। যেখানে ব্যস্ততার ফাঁকে লুকিয়ে থাকে নানা কষ্ট। তবে এমন প্রাণহীন নগরীতে প্রশান্তির গান ধরেছে আগুন ঝরা কৃষ্ণচূড়া, সোনালু আর জারুল। সঙ্গে অফুরান শোভা ছড়িয়েছে ডুলি চাপা, বরুণ, নাগলিঙ্গম, মাধবীলতা ও কাঠগোলাপ। গরমে ওষ্ঠাগত জীবনে ঢাকার প্রকৃতির রূপ-রস মনে শান্তির সু-বাতাস বইয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে নগরীর ফুলের নৈসর্গিকতা উপভোগ করার সবচেয়ে ভালো সময় ছুটির দিন।

হাতিরঝিলের পথে দেখা মেলে কাঠগোলাপের


‘উষ্ণ তাপমাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবুজ ও মনোরম পরিবেশ তৈরির দিকে জোর দেওয়া প্রয়োজন’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন।

তিনি বলেন, ঢাকার প্রকৃতিকে মনোমুগ্ধকর করতে দেশি ফুলের গাছ দিয়ে সাজালে আরো ভালো হত। পরিকল্পিতভাবে ১০টি প্রধান অ্যাভিনিউকে ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো যেতে পারে। তাহলে শোভা বর্ধনের পাশাপাশি মানুষকে প্রশান্তি দিত- এই নগর।

সোনালুর ছায়া মাখানো পথ/ছবি: নূর এ আলম


মাঝে মাঝে এই ঢাকা, একদিন স্বপ্নের দিন হয়ে, ফুলের জলসার মুগ্ধতা দগ্ধ নাগরিক জীবনের সকল গ্লানি মুছে দিয়ে যায়।  

;

হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেলেন ৫৪ বছর পর!



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

৫৪ বছর পর হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেয়েছেন ম্যারিলিন বার্চ (৭৬)। তিনি যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের পন্টারডাউইর বাসিন্দা।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম স্কাই নিউজের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

ম্যারিলিন বার্চ স্কাই নিউজকে বলেন, এতো বছর পর আংটিটি খুঁজে পাওয়া সত্যিই অবাক করা বিষয়। ১৯৭০ সালে পারিবারিক খামারে গরুকে খড় খাওয়ানোর সময় আংটিটি হারিয়ে গিয়েছিল। পরে অনেক খোঁজার পরও না পেয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবে নিয়েছিলাম এটা আর কখনো পাবো না।

তবে শনাক্তবিদ কিথ ফিলিপসের মনে ছিল অন্য কিছু। তিনি খামারের লোকজনকে বিভিন্ন সময় সেখানকার ভূমি খননের পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তাঁর হিসাবে, সেখানে মাটির নিচে অনেক মূল্যবান জিনিস থাকতে পারে।

সেখান থেকে পাওয়া বিভিন্ন মুদ্রা এবং বিটের টুকরা আমাদের দেখাতেন। কিন্তু আংটিটির খোঁজ মেলেনি। 

ম্যারিলিন বলেন, ‘এক সন্ধ্যায় ফিলিপস যখন খামার ত্যাগ করছিলেন, আমি তাঁকে ঠাট্টাচ্ছলে বলি, ফিলিপস শোনো, যেসব আবর্জনা তুমি উদ্ধার করেছ এসব ফেলো। যাও, আমার বিয়ের আংটিটি খুঁজে বের করতে পার কি না, দেখো।’

এ কথা শোনার পর তারা দুজনেই তখন হেসেছিল। তবে এক সপ্তাহ বা তারও কিছু সময় পরে ফিলিপস ম্যারিলিনের আংটিটি নিয়ে হাজির হন।

ম্যারিলিন বলেন, আংটিটিকে খামারের মাঠে মাটির প্রায় ৮ ইঞ্চি নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে সেটিকে তিনি ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করেছেন এবং তখন থেকেই তিনি এটিকে আঙ্গুল দিয়ে রেখেছেন।

মিসেস বার্চের স্বামী পিটার বার্চ গত জানুয়ারিতে ৮০ বছরে পা দিয়েছেন। সে উপলক্ষে অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। কিন্তু এমন ঘটনার পর সব আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে। এখন সবকিছু এই আংটিটি ঘিরেই হচ্ছে।

;

সাংবাদিকের ফেসবুকে পোস্ট: মিললো আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর, ইজিবাইক



রাকিবুল ইসলাম রাকিব, বার্তা২৪.কম, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) করেসপন্ডেন্ট
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

৭৭ বছরের বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানের স্ট্রোক হয়েছে একাধিকবার। এই বয়সে যখন তার বিছানায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম করার কথা, তখন তাকে একটি রিকশার প্যাডেল মেরে অবিরাম ছুটে চলতে হয় ঢাকার রাস্তা-ঘাটে।

দিন শেষে যা আয় হয়, তার একটা অংশ নিজের জন্য রেখে, বাকিটা পাঠাতেন গ্রামে থাকা বৃদ্ধ স্ত্রীর কাছে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে এভাবেই চলছিল তার দিনকাল।

হাবিবুরের ইচ্ছে ছিল, শেষ বয়সের সময়টা তিনি শহর ছেড়ে গ্রামে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে কাটাবেন। কিন্ত সেখানে থাকার মতো ঘর ও জীবিকার নিশ্চয়তা না থাকায় বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতে হতো তাকে।

হাবিবুরের দুরবস্থার খবর জানার পর সে বিষয়ে ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক জ. ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন।

সে পোস্টটি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর তার উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর উপহারের সুখবর পান হাবিবুর। পাশাপাশি হাবিবুরের কর্মসংস্থানের জন্য ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী তাকে একটি ইজিবাইক উপহার দেন।

এতে করে গ্রামের ফেরার ইচ্ছা ও গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলেছে এই অসহায় বৃদ্ধের।

হাবিবুর রহমানের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সহনাটি ইউনিয়নে সোনাকান্দি গ্রামে।

বৃহস্পতিবার (২ মে) বিকেলে গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে জেলা প্রশাসকের দেওয়া উপহারের ইজিবাইকের চাবি হাবিবুর রহমানের হাতে তুলে দেন। পাশাপাশি সোনাকান্দি গ্রামে এই বৃদ্ধের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, বাবার মৃত্যুর পর জীবিকার তাগিদে ১৯৬৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন হাবিবুর রহমান। সংসারে তার স্ত্রী ও চার মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের সবাই গরিব ঘরে বিয়ে হওয়ায় বাবাকে দেখার সামর্থ্য নেই তাদের। স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানে মাত্র আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া আর কিছু নেই হাবিবুর রহমানের। সে কারণে বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। ঢাকায় মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় রাত্রিযাপন করতেন রাস্তায় রাস্তায়।

এদিকে, রিকশাচালক হাবিবুর রহমানের দুরবস্থা নিয়ে গত ২৫ এপ্রিল সাংবাদিক জ.ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। পোস্টটি নজরে আসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের। এরপরই নির্দেশনা আসে হাবিবুরকে তার এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার।

ওপর থেকে নির্দেশনা আসার পর গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ সোনাকান্দি গ্রামে গিয়ে হাবিবুর রহমানের বাড়ি পরিদর্শনে করে দেখেন, তার মাত্র আধা শতাংশ জমি রয়েছে। এটুকু জমিতে ঘর নির্মাণ করা সম্ভব না হওয়ায় বিপত্তি বাধে। এ সময় হাবিবুর রহমানের জমির পাশেই দুই শতাংশ জমি দানের ঘোষণা দেন সহনাটি ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. দুলাল আহমেদ। ইতোমধ্যে, জমির দলিল সম্পাদন হয়ে গেছে। শিগগিরই ঘরের নির্মাণ কাজ শুরু হবে।

হাবিবুর রহমান বলেন, সারাজীবন কষ্ট করেছি। আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া নিজের আর কিছুই ছিল না আমার। সাংবাদিক মামুন ভাইয়ের লেখালেখির কল্যাণে এখন বাড়ি ও একটি ইজিবাইক হয়েছে। এখন স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আমার দিন ‘রাজার হালে’ কাটবে। আমি অনেক আনন্দিত ও খুশি। সেইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাসহ যারা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ বলেন, বৃদ্ধ বয়সে হাবিবুর রহমানের রিকশা চালানো নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক জ.ই. মামুনের একটি পোস্ট প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মহোদয়ের দৃষ্টিগোচর হয়। তার প্রেক্ষাপটে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে হাবিবুরকে নিজ গ্রামে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তার কর্মসংস্থানের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় একটি ইজিবাইক উপহার দিয়েছেন। এছাড়াও হাবিবুর ও তার স্ত্রীকে বয়স্ক ভাতা দেওয়ারও উদ্যোগ নে্ওয়া হয়েছে।

 

;

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম: রসে সেরা, স্বাদে সেরা!



আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, টাঙ্গাইল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

চমচমের কথা শুনলে কার না জিভে জল আসে! তারপরে যদি হয় সেই টাঙ্গাইলের চমচম! তাহলে তো কথাই নেই! ছোট-বড় সব বয়েসি মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে- টাঙ্গাইলের চমচম।

কথায় আছে, ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথা তো সবারই জানা। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসের উত্তরাধিকার টাঙ্গাইল জেলা। জানা যায়, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আনুমানিক প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস।

ইতিহাস বলছে, দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এখন পোড়াবাড়ির সে জৌলুস আর নেই।

বর্তমানে ‘টাঙ্গাইল মিষ্টিপট্টি’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শহরের পাচঁআনি বাজরের মিষ্টির দোকানগুলোতেও চমচম তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই এখন নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চম চম, স্বাদে সেরা, মানে সেরা, ছবি-বার্তা২৪.কম

এই পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানেই এখন গড়ে উঠেছে, চমচমের দোকান। চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়। বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগলিক নিদের্শক ইউনিট ভৌগলিক নিদের্শক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন-২০১৩ অনুয়ায়ী, চলতি বছরের (৯ জানুয়ারি) টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি চমচম ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন দেখা যায়, এই সুস্বাদু চমচম তৈরির কাজে জড়িত শত শত কারিগর কাজ করছেন। আগুনের তাপে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জ্বাল হচ্ছে চমচমের। নিজেদের তৈরি চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় কারিগররাও খুশি।

বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে, মান ভেদে তিনশ থেকে চারশ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন ছুটে আসেন মিষ্টির দোকানগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ নিতে।

মিষ্টি কিনতে আসা সাগর বার্তা২৪.কমকে বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি আমাদের ঐতিহ্য ও আমাদের গর্বের। টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজারে আসলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাই। ছোট বড় সবাই টাঙ্গাইলের মিষ্টি পছন্দ করেন।

মিষ্টি কিনতে আসা আরেকজন হরিপদ সরকার বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আমি যেমন টাঙ্গাইলের মিষ্টির জন্য এসেছি, আমার মতো অনেকেই টাঙ্গাইলের মিষ্টি নিতে এসেছেন। এই মিষ্টির স্বাদ অন্যরকম! না-খেলে বোঝা যাবে না।

মিষ্টি ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ কর্মকার বলেন, আমাদের টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য পোড়াবাড়ির চমচম। প্রায় দুইশ বছর আগে থেকেই টাঙ্গাইলে পোড়াবাড়ির মিষ্টি তৈরি হয়ে থাকে। টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম দেশ ও দেশের বাইরে রয়েছে। আমাদের পোড়াবাড়ির চমচমে ভেজাল কোনো কিছু যুক্ত করা হয় না। চমচম স্বাদ হওয়ার কারণ খাঁটি দুধ, ছানা ও ময়দা দিয়ে পোড়াবাড়ির চমচম তৈরি করা হয়। এজন্য এত স্বাদ! প্রতিদিন দোকানগুলিতে ৫ থেকে ১০ মণ মিষ্টি তৈরি করা হয়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা, ছবি- বার্তা২৪.কম 

মিষ্টি ব্যবসায়ী কালাচাঁদ বলেন, আমি ৪০-৪৫ বছর ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। মিষ্টির স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের সুনাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের মিষ্টি দেশের বাইরে পাঠাতে পারবো। আমাদের মিষ্টি চাহিদা আরো বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের আগ্রহও বেড়ে যাবে।

সরকারের কাছে দাবি, বিদেশে এই মিষ্টি রফতানি করার ব্যবস্থা করলে আমাদের বিক্রি আরোও বাড়বে। তখন আমরা আরো বেশি বেশি মিষ্টি তৈরি করতে পারবো।

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, সারাদেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা মিষ্টি ব্যবসায়ীরা অনেক খুশি। এই মিষ্টি যদি বিদেশে রফতানি করা যায়, তাহলে আমাদের ব্যবসা আরো প্রসার পাবে।

তিনি বলেন, আমার বাবা মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। বাবার হাত ধরেই মিষ্টির ব্যবসায় আসা। আমি করছি। আমার ছেলেও এই পেশায় আছে। পোড়াবাড়ির চমচমের ইতিহাস প্রায় দুইশ বছরের। টাঙ্গাইলের চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে, গাভির দুধ চরাঞ্চল থেকে আসে। এখানকার দুধ অনেক ভালো হয় আর জলেরও একটা বিষয় আছে! দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয় অন্যরকম। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। এই মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না।

;