কুমিল্লার বিজয়পুরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পীদের সংকট ও সম্ভাবনা

  • মাছুম কামাল, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুরের বারপাড়া এলাকা, এখানে একসময় প্রচুর পরিমাণে কুমোররা ছিলেন। পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই বর্তমানে এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তবু এলাকায় প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল চারপাশের মাটির ঘরগুলোর সামনে সারি-সারি মাটির তৈজসপত্র, নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী। এরমধ্যে কিছু কিছু পণ্য রোদে শুকোনো হচ্ছে, কিছু শুকিয়ে আবার পোড়ানোর জন্য জমা করে রাখা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

খানিকটা এগোনোর পর, যান্ত্রিক হুইলের আওয়াজ শোনা গেল। আমরাও টিম-ক্যামেরা নিয়ে এগোলাম। একটা ছোট পটারি (মাটির জিনিস তৈরির কারখানা)। একজন মৃৎশিল্পী সেখানে বসে হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় মাটি দিয়ে দধির পাতিল বানাচ্ছেন। কথায়-কথায় জানালেন তার নাম সুখলাল পাল (২১)। প্রায় ৫ বছর ধরে তিনি এই কাজ করছেন। প্রতিদিন গড়ে ১০০-১৫০টি পণ্য উৎপাদন করে থাকেন তিনি। 

বিজ্ঞাপন

তারপর সেগুলো স্থানীয় মার্কেটে বিক্রি করে গড়ে ৬০০-৭০০ টাকা আয় করেন। তার উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে, দধির পাতিল, ল্যাম্পশেড, কয়েল বাস্কেট, ফুলদানী ইত্যাদি। এছাড়াও ফরমায়েশ অনুযায়ীও যে কোনো পণ্য তৈরি করতে পারেন তিনি।

কী কী সীমাবদ্ধতা রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে জানালেন, জায়গা ও গ্যাসের সংকটের কথা। কাঁচামাটি থেকে তৈরি পণ্য শুকানোর পর, পোড়ানোর জন্য তারা পুরনো মাটির চুলোই ব্যবহার করে থাকেন।

আমরা করতে থাকলাম সম্পূর্ণ হাতে কাজ করা (যান্ত্রিক হুইল ছাড়া) মৃৎশিল্পীর খোঁজ। পেয়েও গেলাম। কথা হয়, প্রার্থনা রানী পালের (৩৫) সঙ্গে। তিনি এবং তার পরিবারের সবাই মাটির পণ্য তৈরি করেন। তিনি দেখালেন কিভাবে হাতে তৈরি মাটির শানক (ভাত খাওয়ার মাটির বাসন) বানাতে হয়।

প্রথমেই মাটির স্তূপ থেকে মাটি খুঁড়ে নামাতে হয়। এরপর নরম এঁটেল মাটির দলা নিয়ে কেঁচতে হয়। জল দিয়ে মাটি নরম করে হাতের সাহায্যে একটা নেকড়া দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাঙ্ক্ষিত পণ্য তৈরি করা হয়।

এ সময় কথা হয় দুঃখিনী রাণী পাল (৪৫) নামের আরেক মৃৎশিল্পীর সঙ্গেও। তিনিও হাতে মাটির পণ্য তৈরি করে দেখালেন। এসময় তারা অভিযোগ করে বলেন, ‘আমারারে কেউ টাকা-পয়সা দিয়া সাহায্য করে না। খোঁজও নেয় না। আমরা খাইয়া-না খাইয়া থাকি। টাকা দেয় পটারিওয়ালাগোরে। অথচ, হাতের কামেই কষ্ট বেশি। তারা তো যন্ত্র দিয়া বানায়, গ্যাসও আছে পোড়া দেওনের। আমরা মাটির চুলা ব্যবহার করি। আমগো কষ্ট দেখার কেউ নাই।’

এরপর আমরা যাই স্থানীয় আরেক—অভয়পল্লী মৃৎশিল্প নামের পাটারিতে। এটি সমবায় সমিতির অধীন একটি পটারি। পটারিটির মালিক শিবু কুমার পাল। তার অধীনে ১০/১২ জনের মতো কাজ করেন। একজন কর্মচারী জানালেন এখানকার পণ্য লোকাল মার্কেট ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের ওমান, আরব-আমিরাত, কাতারসহ বেশ কয়েকটি দেশে যায়।

এখানকার কয়েকজন মৃৎশিল্পীর সঙ্গে কথা হয়। লাকী পাল (২৮) নামে একজন বানাচ্ছিলেন দধির কাপ। জানালেন, প্রতিদিন গড়ে ৫০০-১০০০ দধির কাপ বানাতে পারেন একেকজন। তেমন কোনো সীমাবদ্ধতাও নেই বলে জানা গেল।

বোঝা গেল সমিতির অধীন পটারিতে যারা কাজ করছেন তারা মোটামুটি ভালো আছেন। যারা ব্যক্তি উদ্যোগে কিংবা নিজ বাড়িতেই কাজ করছেন, তারাই আছেন সমস্যায়।

সবশেষ আমরা গেলাম বিজয়পুরের রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির কারখানায়। এটা বাংলাদেশ সরকারের সমবায় অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চশজন কর্মরত আছেন। এই পটারির মধ্যে প্রযুক্তির ছোঁয়াও লেগেছে। মাটি তাল পাকানো থেকে প্রস্তুত-উপযোগী করা পর্যন্ত প্রায় পুরো প্রক্রিয়াই মেশিনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

যতু গোপাল পাল নামের একজন কর্মচারী আমাদের ভিতরে এগিয়ে দিলেন। কথা হয়, উত্তম পাল (৩৮) নামের একজন মৃৎশিল্পীর সঙ্গে। একটি অপূর্ব সুন্দর ল্যাম্পশেডে তিনি নকশা ফুটিয়ে তুলছিলেন। জানালেন, প্রায় ২০-২৫ বছর এইখানে কর্মরত আছেন। ভালোই আছেন।

এক সময় সস্তা এবং যোগান প্রচুর থাকায় মাটির তৈজসপত্র, নিত্য ব্যবহার্য-সামগ্রীর বেশ চাহিদা থাকলেও সে জায়গা দখল করে নিয়েছে সিরামিক কিংবা মেলামাইন। তবে, অনেকাংশে কমে গেলেও, এখনো মাটির শিল্পকর্ম ও তৈজসপত্রের চাহিদা রয়েছে। রপ্তানি হচ্ছে দেশের বাইরেও। সরকারের পক্ষ থেকে পটারির পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে যারা কাজ করছেন, তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় প্রশাসন উদ্যোগ নিলেই উপকৃত হবেন তাঁরা। টিকে থাকবে হাজার বছরের মৃৎশিল্পকর্ম। তবে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা এবং এনজিওগুলো এগিয়ে এলেই কেবল সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।