বাঙলার কিছু বিলুপ্ত বই পুস্তক



তানিয়া চক্রবর্তী
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

বহু গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েও কালের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে, কখনোবা লেখকরা সমসাময়িক সময়ে গুরুত্ব পেয়েও পরে হারিয়ে গেছেন। কোথাও চর্চার আড়ালে, কোথাও বা পুস্তকের দুর্লভ হওয়ার কারণে কোথাওবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে বইপত্র অনেকসময় ধ্বংস হয়ে স্মৃতির ধুলোতে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে।
এখন যে বইয়ের কথা বলছি যথা ‘ছেলেদের মহাভারত’, ‘মসূয়ার ইতিহাস’, ‘ধ্রুব’, ‘বিক্রমাদিত্য’ ও ‘প্রতাপাদিত্য’, এই সকল বইয়ের রচয়িতা শ্রদ্ধেয় শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য—সম্পর্কে আমার মায়ের ঠাকুরদা হন। আমার মা শ্রীপূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রী প্রতাপ ভট্টাচার্য্যের সন্তান। পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের স্ত্রী শ্রীমতী সুনীতি দেবীকে আমি দেখেছি ও তার মুখে ছেলেবেলায় কিছু গল্পও শুনেছি, তাঁকে সম্বোধনে বম্মা (বড়মা থেকে) বলে ডাকতাম। এই পাঁচটি বইয়ের প্রতিটিই রচনার দিক থেকে ভিন্ন। হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের কারণে ১৩৫৪ সনের ১২ই চৈত্র মসূয়ার (বর্তমান বাংলাদেশের ময়মসিংহ জেলার মসূয়া গ্রাম) বাড়ি (ভারতী কুটীর) ত্যাগ করে স্ত্রী, দুই পুত্র ও দুই কন্যা নিয়ে তাকে ভারতবর্ষে আসতে হয়। সেইসময়  স্বভাবতই তাঁকে বেশ অর্থকষ্টে পড়তে হয় কিন্তু এসবের মধ্যেও ক্রমাগত নিজের সাহিত্যসৃষ্টি অব্যাহত রেখেছিলেন।

প্রথমে গৌরীপুর, কালীপুরে কিছুদিন কাটিয়ে মালদার চাঁচলে বাস করেছিলেন। ভারতবর্ষে ফিরে তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন শারীরীকভাবেও খুব সুস্থ ছিলেন বলে জানা যায় না। ১২৯০ বঙ্গাব্দে ময়মনসিংহ জেলার মসূয়া নামক বর্ধিষ্ণু গ্রামে শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য জন্মগ্রহণ করেন। এই মসূয়া গ্রামেই শ্রদ্ধেয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জন্ম হয়। বম্মার মুখে শুনেছি বড়দাদু তথা শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের বিশেষ সুহৃদ ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সাহিত্যের বিভিন্ন কর্ম নিয়ে তাঁরা আলোচনা করতেন। তাঁর যেসকল বই বিশেষ জনপ্রিয় ছিল তার মধ্যে ‘ছেলেদের মহাভারত’, ‘প্রতাপাদিত্য’, ‘বিক্রমাদিত্য’, ‘কেদার রায়’, ‘ঈশা খাঁ’, ‘ধ্রুব’, ‘মসূয়ার ইতিহাস’ উল্লেখযোগ্য। শিশুসাহিত্যের এই মূলগ্রন্থগুলি ছাড়াও পাখি নিয়ে বিশেষ কিছু কাজ করেছিলেন যথা ‘গায়ক পাখি’, ‘বাংলার পাখি’, ‘পক্ষীতত্ত্ব’। বাংলার পাখি সম্পর্কে শিশুদের সম্যক জ্ঞান হোক এই আশায় এসকল বই তিনি লিখেছিলেন। এই বইগুলো আজ প্রায় দুর্লভ। ১৩৬০ সনের ১লা বৈশাখ তাঁর জীবনাবসান ঘটে। 

আমাদের মহাকাব্যের দিক থেকে “মহাভারত” মানুষের সংবেদনশীলতাকে, জীবনযাপনকে বোঝার সবচেয়ে অপূর্ব সৃষ্টি। সম্ভবত ছোটদের মহাভারতকেই এখানে ‘ছেলেদের মহাভারত’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এখন সময় ও উন্নত ভাবনায় এসে এই নামকরণে আমাদের অসন্তোষ থাকতেই পারে। তবে যেভাবে ছোটবেলাকে ছেলেবেলা বলা হয় এটা তারই সাদৃশ্যযুক্ত প্রয়োগ সমসাময়িক প্রভাব থেকে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রচিত ‘ছেলেদের মহাভারত’ প্রকাশের বেশ কয়েকবছর পরে শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের ‘ছেলেদের মহাভারত’টিও প্রকাশিত হয়। সেইসময়ের বিশিষ্ট প্রকাশক ‘বৃন্দাবন ধর এন্ড সন্স লিমিটেড” থেকে এই বই প্রকাশিত হয়। তিনটি স্থানে এই প্রকাশনার অফিস ছিল যথা ৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা, ৯০, হিউয়েট রোড, এলাহাবাদ এবং ৭৮/৬, লায়েল স্ট্রিট, ঢাকা”। এই প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী ছিল আশুতোষ লাইব্রেরি। এই আশুতোষ লাইব্রেরিই তাঁর বেশীরভাগ বই প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিল। এই প্রকাশনী সেইসময়ের বিখ্যাত প্রকাশনীদের অন্যতম। ওখান থেকে ছোটদের বই বেশি প্রকাশিত হতো। এই প্রকাশনা থেকেই ‘শিশুসাথী’ পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এই পত্রিকায় বহু বিশিষ্টজনেরা লিখেছেন নিয়মিত। এই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদনাও করেছেন। সেই সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য ও রমেশ্চন্দ্র মজুমদার দুজনের পরিবারের মধ্যে বিশেষ ভাবের সম্পর্ক ছিল বলে জানতে পারি। শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য’র অজস্র লেখা প্রকাশিত হয়েছে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায়।

১৩৫৬ সনে ‘ছেলেদের মহাভারত’-এর চতুর্থ সংস্করণটি প্রকাশিত হয়। সেইসময় এই বইটির মূল্য ছিল আড়াইটাকা। এই বইটি মুদ্রিত হয়েছিল ‘নিউ আর্য্যমিশন প্রেস (১১নং রঘুনাথ চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা)’ থেকে। ‘ছেলেদের মহাভারত’ আসলেই শিশুদের সুখপাঠযোগ্য একটি বই। আঠারোটি পর্বে রচিত এই মহাভারত অতি সরল সহজ ভাষায় রচিত। মূলগ্রন্থটিতে ব্লক প্রিন্টের অপূর্ব সব ছবি সাযুজ্য বজায় রাখে। দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ, অভিমন্যুর যুদ্ধ, ভীম ও বকরাক্ষস এইসব ছবি মনের মধ্যে রচনা ও চিত্রের যুগপৎ ব্যবহারে দারুণ কল্পজগৎ সৃষ্ট করে। মহাভারতটি পড়লে বোঝা যায় কিশোর-কিশোরীদের মনের কথা ভেবেই যেন সতর্ক থেকে লেখা হয়েছে। প্রকাশভঙ্গি সাধুভাষায় হলেও তা ভীষণভাবে বোধগম্য। “মাকে বলিও,—বাবাকে বলিও,—জ্যেঠা মহাশয়,—মাতা দ্রৌপোদী আর অপরাপর সকলকে বলিও—অভিমন্যু বীরের মতো মরিয়াছে। আর বলিও অভিমন্যু শত্রুর নিকট একটিবার দয়া ভিক্ষা করে নাই—যুদ্ধে বিন্দুমাত্র ভয় পায় নাই; অভিমন্যু বাপের মান রাখিয়াছে। সূত! তুমি আরো বলিও, আমার জন্য যেন কেউ কাঁদেন না”—যুদ্ধ শেষে বালক যোদ্ধা অভিমন্যুর তাঁর সারথির প্রতি কথাকে তিনি এইপ্রকারের ভাষায় লিখেছেন। যার ফলে “ছেলেদের মহাভারত” পরপর ঘটনার পারম্পর্যে এক সুখপাঠ্য রচনা হয়ে উঠেছে।

১৩৩৬ সনে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য কতৃক ৭নং বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট (কলকাতা) থেকে তাঁর লেখা ‘মসূয়ার ইতিহাস’ প্রকাশিত হয়। সেই সময়ে এর মূল্য ছিল ২ টাকা। ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার অধীনে মসূয়া গ্রামের কাশ্যপবংশীয় ব্রাহ্মণ ও মৌদগল্য গোত্রীয় কায়স্থগণের বংশ পত্রিকা, বংশ-বিবরণ, প্রধান ব্যক্তিগণের জীবনী ও অন্যান্য কথা নিয়ে এই বই। এটি মূলগ্রন্থে ‘প্রথম ভাগ, ব্রাহ্মণ কাণ্ড’ নামে অভিহিত। এই গ্রন্থের শেষে শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য খেদোক্তি করেছেন—“এই ইতিহাস সংগ্রহ করিতে গিয়া আমি পদে পদে বিশেষ বাধা পাইয়াছি। গ্রামের প্রায় কাহারও নিকট সহানুভূতি পাই নাই। এমনকি বইখানা লেখা হইলে পরেও সকলকে পুনঃ পুনঃ আহ্বান করিয়াছি। বড় দুঃখ এই যে, এমন একটা গুরুতর বিষয় বুঝিবার বা জানিবার কাহারও একবিন্দু কৌতূহল নাই।”

তিনি এও বলেছেন—“বিভিন্ন অসুবিধের কারণে এর সব অংশ প্রকাশ পায়নি। এটা প্রথম ভাগ। সম্ভব হলে পরে বাকিটা প্রকাশিত হবে।” সেই ভাবনা থেকেই হয়তো এই বই ‘প্রথম ভাগ, ব্রাহ্মণ কাণ্ডের’ নামে নামাঙ্কিত ছিল। মূলত যাঁর মুখনিঃসৃত উপদেশ বাণী শুনে শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য এই বই লিখতে তৎপর হয়েছিলেন তাঁর সেই বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠপুরুষ শ্রী ঈশান চন্দ্র ভট্টাচার্য্যকে এই বই তিনি উৎসর্গ করেছেন। বইটি বাঙালির জীবনচরিত বোঝার এক অপূর্ব ঐতিহাসিক কাজ। সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, রাজনীতি, খাওয়া-দাওয়া, বেশভূষা সমস্ত কিছুর সুন্দর বিবরণ এই বইতে পাওয়া যায়।

ব্রহ্মপুত্র যেখানে “আড়ালিয়া খাত” নামে পরিচিত ছিল সেইসময়, সেখানে নদীর ভাঙনে প্রতি মাসে বাসস্থান সরিয়ে নিতে হতো সেই থেকে গ্রামের নাম হলো ‘মাস্যা’—এটাই নাকি মসূয়া নামের উৎপত্তির প্রাথমিক কারণ। কেউ বা বলেন মা অসূয়া থেকেই নাকি মসূয়ার উৎপত্তি। একদিকে ঈশা খাঁ অন্যদিকে সম্রাট আকবর আর এদিকে বারেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় এইসমস্ত প্রভাব ছাড়িয়ে কিম্বা নিয়ে বাঙ্গালি জাতি তার সাধারণ জীবন কিভাবে যাপন করত তারই ঐতিহাসিক নিদর্শন এই বই। মসূয়া ছাড়াও তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার ভিটাদিয়া, নওপাড়া, উখড়াশাল, বাণিয়াগ্রাম, আচমিতা এইসব অঞ্চলের কথা এবং বিভিন্ন গোত্রের ব্রাহ্মণদের জীবনযাপনের সম্যক পরিচয় এই বই থেকে পাওয়া যায়। এখানে শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য নিজেদের বংশের বিশিষ্ট পণ্ডিতগণেরও কথা বলেছেন। সেইসময় দাবা, পাশা ছাড়াও ‘বলাই নিয়া পালাই’, ‘কান্দুরে কান্দু’ (গাছে চড়ে), মেয়েদের সব অভিনব খেলা ‘বাঘবন্দী’, ‘চাপিলা চুপিলা’, ‘লল্ট গোঁসাই’ প্রভৃতি খেলাধূলার প্রভাব ছিল।

পোশাকে গরদ, তসর ছাড়াও গিলাপ, বনাত, দোলাই—এইসব বস্ত্রের উল্লেখ আছে। প্রথম কিভাবে চাল ধোয়া জলের ব্যবহারে লেখার কালি প্রস্তুত হতো সেকথাও এখানে লিপিবদ্ধ আছে। স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারেও এই বইতে  নিজের উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। সবমিলিয়ে বাঙ্গালির সংস্কৃতির ইতিহাস জানার অনবদ্য এক বই এই ‘মসূয়ার ইতিহাস’। ১৩২৪ সনে সম্ভবত এই বইটি প্রকাশিত হয়। এর সপ্তম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৫৭ সনে। এই বইটির প্রকাশকও ‘বৃন্দাবন ধর অ্যান্ড সন্স লিমিটেড’। এটি মুদ্রিত হয়েছিল ‘শ্রীনারসিংহ প্রেস (৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট,কলকাতা ‘ থেকে। বইটির সেইসময় মূল্য ছিল ‘দশ আনা’। শিশুসাহিত্যের জনপ্রিয় এই বইটি সেইসময়ে ডিরেক্টর বাহাদুর কর্তৃক অবিভক্ত বাংলার সমস্ত স্কুলের পুরস্কার ও লাইব্রেরির পাঠ্যপুস্তক রূপে অনুমোদিত ছিল। বইটির ভূমিকায় লেখক লিখেছেন, এই কাহিনী পড়ে যাতে শিশুরা ভক্তিপরায়ণ হয় এটাই তাঁর একান্ত কামনা। গল্পটি পড়লে বোঝা যায় একটি সদর্থক, ইতিবাচক শিশু চরিত্রের মাধ্যমে তিনি সততাকে সাফল্য ও সুখের উপকরণ হিসেবে দেখিয়েছেন। এধরনের বই নিঃসন্দেহে শিশুমনে সুপ্রভাব আনতে সক্ষম হয়েছিল। ধ্রুব ও ধ্রুবতারার এই যে গাঠনিক মেলবন্ধন তিনি দেখিয়েছেন তাতে কল্পনার প্রভাব থাকলেও তা খুব সহজেই  মনের কাছাকাছি এসে যায়। ঐতিহাসিক গল্প রচনার দিক থেকে এই বইটি অন্যতম। ছয় আনা মূল্যের এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৩২২ সনে। এর প্রকাশক ছিলেন ‘পপুলার লাইব্রেরী, ঢাকা’ এবং এটি  ঢাকার আশুতোষ প্রেস হতে মুদ্রিত হয়েছিল। গোলকপুর, ময়মনসিংহের জমিদার উপেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরী বাহাদুরকে তিনি এই বই উৎসর্গ করেছিলেন। মূলত বিক্রমাদিত্যকে কেন্দ্র করে এই কাহিনী আবর্তিত হলেও এখানে বারবার রাজ্যের কথা এবং অবশ্যই মহাকবি কালিদাসের কথা এসেছে। ভূমিকায় অবশ্য তিনি লিখেছেন যেহেতু মহারাজ বিক্রমাদিত্যের কোনো প্রামাণিক ইতিহাস নেই  তাই কিংবদন্তীর ওপর নির্ভর করেই এই বই তাকে লিখতে হয়েছে। সংস্কৃত শ্লোকের প্রাসঙ্গিক প্রয়োগে এবং কাহিনীর সহজবোধ্য ভাষায় এই বইটিও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বই। শিশুদের কাছে কিভাবে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি গল্পের ছলে সামঞ্জস্য রেখে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা যায় এই বই তার উপযুক্ত নিদর্শন।

তাঁর রচিত ‘প্রতাপাদিত্য’ নামক বইটিও বাঙালির যুদ্ধ ও বীরত্বের ইতিহাসের এক যোগ্য নমুনা বলা যায়। বাঙ্গালির শক্তি মোগলের আধিপত্যেও যে একেবারে হীন হয়ে যায়নি, তারা যে ক্রমাগত সাহস দেখিয়ে বাংলাকে রক্ষা করার প্রয়াস নিয়েছে তা স্পষ্টভাবে এই রচনাতে প্রতিভাত। বিভিন্নরকম বাধা-বিপত্তি থাকলেও সবসময় সাহিত্যের কাজ করার চেষ্টা করেছেন একাগ্রমনে, তাই হয়তো অন্যদিকের স্বচ্ছলতার প্রতি তোয়াক্কাও করেননি। তার সাহিত্যকর্মের কথা সেই সময়ে কারোরই অজানা ছিল না। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শ্রীনলিনীরঞ্জন সরকার (অর্থ সচিব, পশ্চিমবঙ্গ), সুরেশচন্দ্র সমাজপতি (সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক), রায় বাহাদুর জলধর সেন, অমৃতলাল বসু, ডাঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার (ভাইস চ্যান্সেলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন (ভাইস চ্যান্সেলর, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়), ডাঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মহামহোপাধ্যায় আদিত্যরাম ভট্টাচার্য্য (প্রো-ভাইস চ্যান্সেলার, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস), রায় বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ ভদ্র (জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ও ‘ঢাকা রিভিউ ও সম্মেলন’-এর সম্পাদক), রায় বাহাদুর সুরেশচন্দ্র সিংহ (ম্যাজিস্ট্রেট, হাওড়া), পদ্মিণীভূষণ রুদ্র (অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম কলেজ), শশাঙ্কমোহন সেন, সঞ্জীবচন্দ্র চৌধুরী (অধ্যাপক, নেপাল রাজ কলেজ), মৌলভী মহম্মদ ইছরাইল (বি-এল ওয়াকফ কমিশনার), সুরেশচন্দ্র ঘটক, ডাঃ নলিনিকান্ত ভট্টশালী (কিউরেটর, ঢাকা মিউজিয়াম) এঁদের সকলের বন্ধুতা, সম্মতি ও প্রশংসা তার সাহিত্যজীবনের সহায়ক ছিল।

তাঁর সাহিত্যকর্মের বিষয়ে অবগত হয়ে স্বয়ং রবিঠাকুর ১৩৩২ সালের ৩০শে ফাল্গুন তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা প্রকাশ করেন, তাঁর কিছুটা অংশ এইরকম—“শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় যে কাজে জীবন নিয়োগ করিয়াছেন তাহার কিছু কিছু পরিচয় পাইয়া আমি বিশেষ আনন্দলাভ করিয়াছি।” শোনা যায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন নিতান্ত সরল মানুষ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশেষ স্নেহ করতেন তাঁকে।  এই মেধাবী ও সরল মনের মানুষটির সঙ্গেও পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের একপ্রকার বন্ধুতা ছিল। তিনি শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্যকে লিখেছিলেন—“নমস্কার দাদা, আপনার পাখী আর বাঙ্গালির গল্প প্রত্যেক শিক্ষার্থীর আবশ্যক। শিক্ষকেরাও ইহার প্রয়োজনীয়তা গ্রহণ করিবেন।” শ্রদ্ধেয়  উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী তাঁকে লিখছেন—“আপনার ‘গায়কপাখী’ সবগুলিই চেনাজানা অথচ কাহারো জীবনকথা আমাদের জানা নেই। আপনি জানাইলেন, বঙ্গ সাহিত্যের ইহা অভিনব সম্পদ হিসাবে গণ্য হইবে।” দুঃখের কথা এইসব বই এখন পাওয়াই যায় না, বাঙালি এইসকল বই এর কথা বর্তমানে জানেই না।

   

১২৫তম জন্মবর্ষ

মুক্তির অন্বেষী নজরুল



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নজরুল জীবনের ‘আর্তি ও বেদনা’র সম্যক পরিচয় পেতে হলে সেকালের মুসলিম সমাজের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কিছু আলোচনা আবশ্যক হয়ে পড়ে। নজরুলের আবির্ভাবকালে মুসলমানদের সামাজিক আবহাওয়া এমনই জীর্ণ ও গণ্ডিবদ্ধ ছিল যে, কোনো শিল্পীরই সেই আবহাওয়াতে আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার সম্ভব ছিল না। জীবনের প্রথমদিকে তাই কামাল পাশা প্রমুখ ইতিহাসখ্যাত বীর মুসলিমেরা নজরুল-মানসকে আচ্ছন্ন করেছিল।

কিন্তু অচিরেই তিনি বাঙালির জাগরণের পথিকৃতে রূপান্তরিত হন। বাংলার জাগরণ গ্রন্থে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর অগ্রণীজন কাজী আবদুল ওদুদ জানাচ্ছেন, ‘নজরুলের অভ্যুদয়ের পরে ঢাকায় একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর অভ্যুদয় হয়; তাঁদের মন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ এবং যারা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং বাঙালি মুসলমানের চেতনার জগতে নাড়া দিলে সচেষ্ট হয়েছিলেন।’

চরম দারিদ্র্যের মাঝে থেকেও জীবনের জয়গান গেয়েছেন কবি নজরুল, ছবি- সংগৃহীত

উল্লেখ্য, ১৯ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অধ্যাপক ও ছাত্রের মিলিত প্রয়াসে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। সংগঠনটির সঙ্গে ‘সাহিত্য’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও এটি গতানুগতিক ও মামুলি কোনো সাহিত্য সংগঠন ছিল না। ‘সাহিত্য’ শব্দটিকে বৃহত্তর পরিসর ও অর্থে গ্রহণ করেছিলেন উদ্যোক্তারা। ফলে, তাঁদের কাছে সাহিত্যচর্চা ছিল জীবনচর্চার নামান্তর। এই সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। নিজেদের কর্মকাণ্ডকে তাঁরা অভিহিত করেছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-প্রতিষ্ঠার পরের বছরেই (১৯২৭) সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র হিসেবে সাময়িকী ‘শিখা’ প্রকাশ করে, যে কারণে এদের ‘শিখা গোষ্ঠী‘ নামেও অভিহিত করা হয়।

শিখা প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ বছর (১৯২৭-১৯৩১)। বাঙালি মুসলমানের বিভিন্ন সমস্যা তথা শিক্ষা, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দর্শন, চিন্তা ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানদীপ্ত আলোচনা করেছেন এই সমাজের লেখকগণ। ‘বুদ্ধির মুক্তি ও কবি নজরুলকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

বুদ্ধির মুক্তি, মানব মুক্তি, সমাজের মুক্তি তথা মানুষের শির উচ্চতর করার বাণী উৎকীর্ণ করেছিলেন নজরুল। গেয়েছিলেন মানবতার জয়গান। অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যের গানে মুখরিত ছিল তাঁর জীবন ও কর্ম। মানুষের চেয়ে বড় কিছু ছিল না তাঁর কাছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী ছিলেন তিনি। জগতের বঞ্চিত, ভাগ্য বিড়ম্বিত, স্বাধীনতাহীন বন্দিদের জাগ্রত করার মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন নজরুল। মানবতার জয়গান গেয়ে লিখেছিলেন-'গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্ …’।

মানুষ আর মানুষের হৃদয়কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’। আবার তাঁর কলম থেকেই বেরিয়ে এসেছিল বজ্রনির্ঘোষ আহ্বান- ‘জাগো অনশন-বন্দি, ওঠ রে যত জগতের বঞ্চিত ভাগ্যহত’।

শুধু যে কবিতাই লিখেছেন তা তো নয়। তিনি এমন অনেক প্রবন্ধও রচনা করেছেন। নজরুলের দেশপ্রীতি, দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আজও অনুপ্রাণিত করে। তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে।

সাম্য ও মানুষের কবি ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম, ছবি- সংগৃহীত

‘সাম্য, সম্প্রীতির কবি নজরুল তাঁর হৃদয়মাধুর্য দিয়ে সব শ্রেণিবৈম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে জাত–ধর্ম ছিল হৃদয়ের প্রেমধর্ম; যে প্রেম মানুষের কল্যাণে উৎসারিত হয়ে ওঠে। শুধু লেখনীর দ্বারা নয়, নিজের জীবনের সবরকম ঝুঁকি নিয়ে ঐক্যের আশায় আশাবাদী ছিলেন নজরুল।

তাঁর ব্যক্তিজীবনে এই ভাবনার প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর বিবাহের ক্ষেত্রে, পুত্রদের ক্ষেত্রেও। তাঁর পরিবারের সব সদস্য এবং আপামর বাঙালি এই সত্য নিত্য উপলব্ধি করেন।

১২৫তম জন্মবর্ষে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চৈতন্য মুক্তির অন্বেষী। তাঁর গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক তথা সুবিশাল সাহিত্যকর্ম বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, নানা কারণে তাৎপর্যবাহী।

কেননা, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রখর প্রতাপে ত্রস্ত এবং যুদ্ধ ও আগ্রাসনে জর্জরিত পৃথিবীতে থেমে নেই অন্যায়, অবিচার, হামলা, নির্যাতন।

ইউক্রেন, ফিলিস্তিন থেকে মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত পৃথিবীময় শোষণ, নির্যাতন, হত্যা, রক্তপাতে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত করোনা-বিপর্যস্ত পৃথিবী আর মানুষ এখন অবর্ণনীয় দুর্দশা ও দুর্বিপাকে বিপন্ন।

এমতাবস্থায় অনাচারের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী নজরুলের মানব অধিকারের রণহুঙ্কার বড়ই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। কারণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহীরুহ-তুল্য কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম, বিদ্রোহ, মুক্তি ও মানবতার মহান সাধক।

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বৃটিশ-বাংলার সর্বপশ্চিম প্রান্তের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় জন্ম নেন কাজী নজরুল ইসলাম আর ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

বাংলাদেশের এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষীদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, যেমনটি তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।'

উল্লেখ্য, কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর কবরস্থানের স্থান নির্ধারণ নিয়ে নানাজন নানামত দিতে থাকেন। এ অবস্থায় স্থাননির্ধারণী সভায় রফিকুল ইসলাম প্রস্তাব করেন নজরুল তাঁর এক গনে লিখেছেন-

‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’॥

সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর কবর হোক। তাঁর এ প্রস্তাব সভায় গৃহীত হলো। পরবর্তীকালে এ কবর পাকা ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি নজরুলকে ভারত থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, ছবি- সংগৃহীত

‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবনযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলির একটি 'বিদ্রোহী', যা স্পর্শ করেছে রচনার শতবর্ষের ঐতিহাসিক মাইলফলক।

কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়, ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক ‘প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক ‘সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ‘ধূমকেতু’তে (২২ আগস্ট, ১৯২২) ছাপা হয়।

বলা বাহুল্য, অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তার কারণেই কবিতাটিকে বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত করেছিল। ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি ও রচয়িতা কবি নজরুল ‘চির উন্নত শির’ রূপে বিরাজমান।

পুরো বাংলা ভাষা বলয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এমন শাণিত প্রতিবাদ তুলনাহীন। বিদ্রোহীর শতবর্ষকে ‘জাগরণের শতবর্ষ’ রূপে উদযাপন করা হয়, বাংলা ভাষাভাষী পরিমণ্ডলে আর ১২৫তম জন্মবর্ষে মুক্তির অন্বেষী নজরুলকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করে সমগ্র বাঙালি জাতি!

 ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

;

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;