১২৫তম জন্মবর্ষ

মুক্তির অন্বেষী নজরুল

  • ড. মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

নজরুল জীবনের ‘আর্তি ও বেদনা’র সম্যক পরিচয় পেতে হলে সেকালের মুসলিম সমাজের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কিছু আলোচনা আবশ্যক হয়ে পড়ে। নজরুলের আবির্ভাবকালে মুসলমানদের সামাজিক আবহাওয়া এমনই জীর্ণ ও গণ্ডিবদ্ধ ছিল যে, কোনো শিল্পীরই সেই আবহাওয়াতে আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার সম্ভব ছিল না। জীবনের প্রথমদিকে তাই কামাল পাশা প্রমুখ ইতিহাসখ্যাত বীর মুসলিমেরা নজরুল-মানসকে আচ্ছন্ন করেছিল।

কিন্তু অচিরেই তিনি বাঙালির জাগরণের পথিকৃতে রূপান্তরিত হন। বাংলার জাগরণ গ্রন্থে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর অগ্রণীজন কাজী আবদুল ওদুদ জানাচ্ছেন, ‘নজরুলের অভ্যুদয়ের পরে ঢাকায় একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর অভ্যুদয় হয়; তাঁদের মন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ এবং যারা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং বাঙালি মুসলমানের চেতনার জগতে নাড়া দিলে সচেষ্ট হয়েছিলেন।’

বিজ্ঞাপন
চরম দারিদ্র্যের মাঝে থেকেও জীবনের জয়গান গেয়েছেন কবি নজরুল, ছবি- সংগৃহীত

উল্লেখ্য, ১৯ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অধ্যাপক ও ছাত্রের মিলিত প্রয়াসে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। সংগঠনটির সঙ্গে ‘সাহিত্য’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও এটি গতানুগতিক ও মামুলি কোনো সাহিত্য সংগঠন ছিল না। ‘সাহিত্য’ শব্দটিকে বৃহত্তর পরিসর ও অর্থে গ্রহণ করেছিলেন উদ্যোক্তারা। ফলে, তাঁদের কাছে সাহিত্যচর্চা ছিল জীবনচর্চার নামান্তর। এই সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। নিজেদের কর্মকাণ্ডকে তাঁরা অভিহিত করেছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-প্রতিষ্ঠার পরের বছরেই (১৯২৭) সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র হিসেবে সাময়িকী ‘শিখা’ প্রকাশ করে, যে কারণে এদের ‘শিখা গোষ্ঠী‘ নামেও অভিহিত করা হয়।

বিজ্ঞাপন

শিখা প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ বছর (১৯২৭-১৯৩১)। বাঙালি মুসলমানের বিভিন্ন সমস্যা তথা শিক্ষা, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দর্শন, চিন্তা ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানদীপ্ত আলোচনা করেছেন এই সমাজের লেখকগণ। ‘বুদ্ধির মুক্তি ও কবি নজরুলকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

বুদ্ধির মুক্তি, মানব মুক্তি, সমাজের মুক্তি তথা মানুষের শির উচ্চতর করার বাণী উৎকীর্ণ করেছিলেন নজরুল। গেয়েছিলেন মানবতার জয়গান। অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যের গানে মুখরিত ছিল তাঁর জীবন ও কর্ম। মানুষের চেয়ে বড় কিছু ছিল না তাঁর কাছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী ছিলেন তিনি। জগতের বঞ্চিত, ভাগ্য বিড়ম্বিত, স্বাধীনতাহীন বন্দিদের জাগ্রত করার মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন নজরুল। মানবতার জয়গান গেয়ে লিখেছিলেন-'গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্ …’।

মানুষ আর মানুষের হৃদয়কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’। আবার তাঁর কলম থেকেই বেরিয়ে এসেছিল বজ্রনির্ঘোষ আহ্বান- ‘জাগো অনশন-বন্দি, ওঠ রে যত জগতের বঞ্চিত ভাগ্যহত’।

শুধু যে কবিতাই লিখেছেন তা তো নয়। তিনি এমন অনেক প্রবন্ধও রচনা করেছেন। নজরুলের দেশপ্রীতি, দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আজও অনুপ্রাণিত করে। তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে।

সাম্য ও মানুষের কবি ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম, ছবি- সংগৃহীত

‘সাম্য, সম্প্রীতির কবি নজরুল তাঁর হৃদয়মাধুর্য দিয়ে সব শ্রেণিবৈম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে জাত–ধর্ম ছিল হৃদয়ের প্রেমধর্ম; যে প্রেম মানুষের কল্যাণে উৎসারিত হয়ে ওঠে। শুধু লেখনীর দ্বারা নয়, নিজের জীবনের সবরকম ঝুঁকি নিয়ে ঐক্যের আশায় আশাবাদী ছিলেন নজরুল।

তাঁর ব্যক্তিজীবনে এই ভাবনার প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর বিবাহের ক্ষেত্রে, পুত্রদের ক্ষেত্রেও। তাঁর পরিবারের সব সদস্য এবং আপামর বাঙালি এই সত্য নিত্য উপলব্ধি করেন।

১২৫তম জন্মবর্ষে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চৈতন্য মুক্তির অন্বেষী। তাঁর গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক তথা সুবিশাল সাহিত্যকর্ম বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, নানা কারণে তাৎপর্যবাহী।

কেননা, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রখর প্রতাপে ত্রস্ত এবং যুদ্ধ ও আগ্রাসনে জর্জরিত পৃথিবীতে থেমে নেই অন্যায়, অবিচার, হামলা, নির্যাতন।

ইউক্রেন, ফিলিস্তিন থেকে মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত পৃথিবীময় শোষণ, নির্যাতন, হত্যা, রক্তপাতে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত করোনা-বিপর্যস্ত পৃথিবী আর মানুষ এখন অবর্ণনীয় দুর্দশা ও দুর্বিপাকে বিপন্ন।

এমতাবস্থায় অনাচারের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী নজরুলের মানব অধিকারের রণহুঙ্কার বড়ই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। কারণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহীরুহ-তুল্য কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম, বিদ্রোহ, মুক্তি ও মানবতার মহান সাধক।

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বৃটিশ-বাংলার সর্বপশ্চিম প্রান্তের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় জন্ম নেন কাজী নজরুল ইসলাম আর ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

বাংলাদেশের এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষীদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, যেমনটি তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।'

উল্লেখ্য, কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর কবরস্থানের স্থান নির্ধারণ নিয়ে নানাজন নানামত দিতে থাকেন। এ অবস্থায় স্থাননির্ধারণী সভায় রফিকুল ইসলাম প্রস্তাব করেন নজরুল তাঁর এক গনে লিখেছেন-

‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’॥

সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর কবর হোক। তাঁর এ প্রস্তাব সভায় গৃহীত হলো। পরবর্তীকালে এ কবর পাকা ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি নজরুলকে ভারত থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, ছবি- সংগৃহীত

‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবনযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলির একটি 'বিদ্রোহী', যা স্পর্শ করেছে রচনার শতবর্ষের ঐতিহাসিক মাইলফলক।

কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়, ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক ‘প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক ‘সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ‘ধূমকেতু’তে (২২ আগস্ট, ১৯২২) ছাপা হয়।

বলা বাহুল্য, অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তার কারণেই কবিতাটিকে বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত করেছিল। ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি ও রচয়িতা কবি নজরুল ‘চির উন্নত শির’ রূপে বিরাজমান।

পুরো বাংলা ভাষা বলয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এমন শাণিত প্রতিবাদ তুলনাহীন। বিদ্রোহীর শতবর্ষকে ‘জাগরণের শতবর্ষ’ রূপে উদযাপন করা হয়, বাংলা ভাষাভাষী পরিমণ্ডলে আর ১২৫তম জন্মবর্ষে মুক্তির অন্বেষী নজরুলকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করে সমগ্র বাঙালি জাতি!

 ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম