মুজতাহিদ ফারুকীর কাব্যে ভাষা বৈচিত্র্য



সাঈদ চৌধুরী
কবি মুজতাহিদ ফারুকী

কবি মুজতাহিদ ফারুকী

  • Font increase
  • Font Decrease

কবি মুজতাহিদ ফারুকী একজন মেধাবী লেখক। তার ঝলমলে কবিতায় অফুরন্ত হিউমার আর ভাবনার পরিপক্বতায় মুগ্ধ হতে হয়। নিপুন সত্যসন্ধানী এই লেখক খানিকটা ব্যতিক্রম এবং স্বকীয়। তিনি দৈনিক নয়াদিগন্তের সহকারী সম্পাদক ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সদস্য। চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর ও প্রজ্ঞাবান। কবিতার মত উপসম্পাদীয় কলামেও নিজস্ব শব্দ ও বাক্য ব্যবহারে সফল। কবিতার ছন্দগুলো তিনি নির্মাণ করে চলেছেন নিজস্ব শক্তির আলোকিত পথে।

মুজতাহিদ ফারুকীর কাব্যে ভাষার বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। নদী পারের শব্দ সম্পদের অফুরন্ত ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ তার কবিতার শরির। কতখানি নিখুঁত শব্দমালা সাজালে কবিতা হয়, তা দেখতে চান এই কবি। এফবিতে আমি তা বেশ আগে থেকেই অবলোকন করছি। প্রতিদিন কবিতায় তার কসরত আমাকে আপ্লুত করে। সাম্প্রতিক কয়েকটি কবিতা এখানে উল্লেখ করা যায়।

নিসর্গ যাপন মুজতাহিদ ফারুকীর একটি দুর্দান্ত কবিতা। এতে মধ্যবিত্ত সমাজের চিত্র এবং আবেগ-অনুভূতি খুব সহজ কথা ও ছন্দে উঠে এসেছে।

‘ঝিঁঝিঁরা শিখেছে পাথরের ভাষা, পাতারা ঘুমের শিশু, / পাল তোলা রাতে আকাশ নেমেছে নাটকের মেহফিলে / আধখানা চাঁদ একাকী দেখনদার। / সোনালি রূপালি চকমকি ঝরে শিশিরের দোলনায় / খোলা ছাদ থেকে; চোখের আড়ালে ফোটে শত ফুল। / যারা সেজেছিল রাজা রাণী, চাকর বাকর, রঙিলা, বিবেক / ফিরে গেছে ঘরে- / হয়তো নিজের পার্ট নিয়ে খাটে উদোম হয়েছে। / যাকগে সে যাক, যে মরার সে মরুক, আমি শুয়ে আছি / উপকূলে, মাতাল সবুজে, চারপাশে অরণ্য বিধুর, / চোরা করাতের টানে ভূপাতিত / মেহগনি শালের বিজনে সুর খেলে আহ্লাদী হাওয়া / মলিন পায়ের ধুলি মুছে, মৃদু হেসে / বিচূর্ণ লাস্যে যায় পার্বতীর মেয়ে এঁকেবেঁকে। / থর থর নিথর সময়ে।’

নদী নির্ভর জনপদের প্রকৃতিকে চেনা সহজ ব্যাপার নয়। অনেক পরিশ্রম ও জ্ঞানান্বেষণ থাকতে হয়। মুজতাহিদ ফারুকী চেতনায় বিশ্বজনীন হলেও বিষয়ে প্রচণ্ডমাত্রায় দেশজ হতে পেরেছেন । তার কবিতায় গ্রামীণ দৃশ্যপট গভীরভাবে ধারণ করেন। চমৎকার মুনশিয়ানার ছাপ রেখে পাঠককে জ্ঞানের গভীরে নিয়ে যান। ফলে পাঠক মহলে চমক সৃষ্টি করতে সক্ষম হচ্ছেন।


‘এই তো কেবলই এলে, কেন যাবে, কেন এত তাড়া? / একটু রিল্যাক্স করো, বোসো এই নরোম সোফায়,/ শরীর জুড়াবে দ্রুত কুলারের কৃত্রিম শীতল হাওয়ায়। / মনের কথা তো বলি, নিরিবিলি, এই শান্ত গোধূলি বেলায়!’

মুজতাহিদ ফারুকীর সাহিত্য-বিবেক বুঝতে হবে তার লেখার ভিতর দিয়ে, ভাষা ও ভাবনার মাধ্যমে। চমৎকার সব চিত্রকল্প কবির বিভিন্ন কবিতায় নানা কাহিনিতে বিধৃত। চেনা দৃশ্যের ওপর কল্পনার মিশেলে চিন্তা ও বোধের দৃশ্যপট রচনা করেন তিনি। যেখানে যে-কোনও বয়সের পাঠকই পেয়ে যাবেন তার পরিচিত কাহিনী আর ভাবনার ব্যাপক সাদৃশ্য।

ফারুকীর ‘চোখ কাঁদে না মন কাঁদে’ কবিতায় মিলে অন্যরকম নান্দনিকতার ছোঁয়া। ‘চোখের জলে ভাসছি যখন ভাবছো বুঝি চোখ কাঁদে? / চোখ কাঁদে না, মন কাঁদে রোজ প্রেম বিহ্বল নীল ফাঁদে। / আনাড়ি মন কাঁদতে জানে, নেই জানা তার অশ্রুপাত, / কাঁদবে বলে ধার নিয়েছে দুই নয়নের জল প্রপাত। / কেউ বোঝে না হৃদয়-মনের সঙ্গে চোখের খুনসুটি / কান্না বুকের রক্তক্ষরণ অশ্রু ধারায় নেয় ছুটি। / মনের নেকাব সরাও যদি আকাশ পারে দাও পাড়ি / অশ্রুতে মন ছোঁয়াও মেয়ে বুঝবে হৃদয় কেন ভারি।’

মুজতাহিদ ফারুকীর কয়েকটি কবিতা পড়লেই তাকে স্বরুপে আবিষ্কার করা সহজ। প্রাত্যহিক জীবনাচার সম্পর্কিত বিষয় তার লেখায় রয়েছে নিঃশঙ্ক চিত্তে। যা ব্যবহৃত হয় সারা বাংলার ঘরে ঘরে সবুজ পাড়ের জমিনে।

ফারুকীর নান্দনিক উচ্চারণ- ‘লিখি কিছু এলেবেলে ধান, / চিনি গুঁড়া, কালিজিরা, বেগুন বিচি ও দুধশাইল; / আর লিখি কিছু তেতো দেশি পাটপাতা, / সুষনির শাক / শুকনো মরিচ পোড়া, দেশি পেঁয়াজের কুচি, কিছুটা রসুন.../ আমাদের তোষাগারে আর কোনও জহরত নাই।’

শীতের প্রস্তুতি কবিতায় কবির শিল্পীমনের স্পর্শ পাওয়া যায়। ‘শীত আসছে। আলোয়ান কিনতে যাইনি সুপার শপে, নিউ মার্কেটে। / ফুটপাতে, গুলিস্তানে খুঁজে নিই ওমঠাঁসা ভাষার পুরান। / গরীবের নিজস্ব বাগান, আহা, ঠিকরানো জহর নিলামে, / দেরাজের এক কোণে উলেন জাম্পার ঠেলে দেয় যথাশব্দ, আশ্বাস, সাহস, / আমার কী ভয় শীতে! মার মুখে স্রোতস্বীনী ভোরের কালাম / রেখেছি দু’ কানে, পুরানের পথে হেঁটে কবিতায় বাজাই তুফান।’

মুজতাহিদ ফারুকীর লেখায় আজ এবং আগামীকে সঞ্চালিত করার অসীম ক্ষমতা বিদ্যমান। তিনি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে এক বিশাল সম্ভাবনাময় রত্নভাণ্ডার। তার টুকরো আকাশ কবিতায় নতুন কাব্যভাষা প্রস্ফুটিত হয়েছে। রূপকল্প ও কাব্যময়তার অনাবিল ভুবনে লেখকের উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় মিলে।

‘ফচকে মেঘের ফাঁকে চলে গেলে পলাতক চাঁদ / সবুজ পাহাড় বোঝে, বুকজুড়ে নচনচে ঘাসের যৌবন / ডেকে আনে দুর্বিনীত দুর্মর গুরুস্কন্ধ গয়ালসকল / ফিনফিনে রেশম-আঁধার বিহ্বল অবশ সম্মোহনে / চেতনা ছিনিয়ে নিলে সব ভুলে গাছেরাও ছায়ামূর্তি ধরে / স্তব্ধ মূঢ় সময়ের বল্কলে মেলে না গাছপাথর / খুব বেশি স্পর্শকাতর নাসারন্ধ্রে মেহনের ঘ্রাণ থৈ থৈ / কারা যেন গান্ধর্ব তাপনে তনুমনে ঢেলে দেয় / সুনিপুণ প্রাণের আরক / আরণ্যক নিরালোকে প্রেম প্রেম, ঢেউ ঢেউ গোষ্ঠলীলা খেলে। / দুষ্টু চাঁদ ছোবলায় গভীর সলিলে, তাকে বলি ভাবের কটাল / বাতাসে কেন যে ভাসে মানুষের অস্ফুট ভাষার ফিসফিস!’

মুজতাহিদ ফারুকীর ফেরা কবিতাটি বেশ ব্যতিক্রমী, বিচিত্র এবং বর্ণাঢ্য। ‘অবশেষে ফেরা হলো / সময় পেরিয়ে গেছে ঢের, / দরজায় লোহার তালাটি, গায়ে তার গাঢ় অভিমান / বহুদিন ভুলেছে সে অভ্যর্থনার গান / মরিচার টানে। / যতই ঘোরাই চাবি মোচরানো সার। / ভুল চাবি ঢুকিয়েছি এমত সংশয়ে / ভয়ে ভয়ে নিজের মুখেই রাখি ব্যর্থ আঙুল / সেই নাক, সেই গাল, কাঁচাপাকা চুল / সব ঠিকঠাক আছে শুধু নেই যৌবনের সাড়।’

মুজতাহিদ ফারুকী কবিতায় আঞ্চলিক ভাষাকে ব্যাপক ভাবে উপস্থাপন করেছেন। আগাম মেরাজ বা কৈফিয়ত কবিতায় তা লক্ষ্য করা যায়। ‘জেবন অ্যাবাও ক্যারে? ম্যাড়ম্যাড়া, বুজি না তো খেল্ তার / হুদাই গেসুর পাড়ে, গসটায়, নাই বুজি অ্যাজ্লা নিস্তার / য্যান্ চরো আটকিসে যার্তী ভরা গুদারার নাও / যতই গলুই ঠেলো, আইত দিন যতই ক্যান্ না লগি বাও / নাও আরও বালুত্ হামায়, ভিজা লগি খালি পিছলায় / হুগনা গাঙ্গের পানি হে-ও কান্দে মনিষ্যির দুষ্কে ডাক ছাড়ি। / কারে ম্যান্ জিগামু গুমর, কেডা জানে জিন্দেগির সার / ক্যান্ নদী ভাঙ্গে গড়ে, ক্যান্ ভাঙ্গে হাজাইন্যা সংসার? / আবার অঙিলা দিনো চোক্ষে ক্যান্ নাগে নেশা ঘুর / আওলা বাতাসে মুন্ ক্যান্ অয় উৎলা সমুদ্দুর? / যুদিল না থাহে সুখ কুনুদিন পুড়া ই কফালো উগো সাঁই / কিসেরে দিলেন কন্ অবুঝ পরানো মুহব্বতের রুশনাই?’

দক্ষিণ জামালপুরের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা কবিতায় ব্যবহৃত শব্দার্থও তিনি দিয়েছেন। জেবন>জীবন; অ্যাবাও>এমন; ক্যারে>কেন; ম্যাড়ম্যাড়া>মলিন, অনুজ্জ্বল; বুজি না>বুঝি না; খেল্>খেলা; হুদাই>শুধু শুধু; গেসুর পাড়ে>ঘেষড়ে চলে; গসটায়>ঘষটায়; অ্যাজলা>একটু; য্যান>যেন; চরো>চরে; আটকিসে>আটকে গেছে; যারতী>যাত্রী, গুদারার নাও>খেয়া নৌকা; লগি>লম্বা বাঁশ, যা দিয়ে নৌকা বাওয়া যায়; বালুত্>বালুতে; হামায়>ঢোকে, প্রবেশ করে; হুগনা>শুকনা; হে-ও>সে-ও; দুষ্কে>দুঃখে; জিগামু>জিজ্ঞাসা করবো; গুমর>গুঢ় বা গোপন রহস্য; কেঠা>কে; হাজাইন্যা>সাজানো; নাগে>লাগে; ঘুর>ঘোর; কফালো>কপালে; কিসেরে>কী জন্যে; রুশনাই>রোশনাই, আলো, জ্যোতি।

মুজতাহিদ ফারুকী একেবারে শৈশব থেকে লেখালেখি শুরু করলেও পরিকল্পিত ভাবে লিখেছেন বলে মনে হয়নি। কলেজ জীবনে রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার অর্জন ছিলো উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পরে সর্বপ্রথম ছাপার অক্ষরে নাম প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক জাহানে নও পত্রিকার কিশোরদের পাতায়।


ঢাকায় সম্ভবত ৮১/৮২ সালে কবি আমিনুল হক সম্পাদিত সাময়িকী সাপ্তাহিক বিপ্লবে প্রকাশিত হয় পিকাসোর চিত্রকর্ম বিষয়ে তার প্রথম অনূদিত ফিচার। তারপর থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় কমবেশি লেখা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু কোনওটাই নিয়মিত নয় বলে জানা যায়।

মুজতাহিদ ফারুকী প্রেম-বিরহকে অবলম্বন করে জন মানুষের হৃদয়ের উচ্ছ্বাস ফুটিয়ে তুলেছেন। এক সময় গল্প লিখে বিতর্কের ঝড় সৃষ্টি করেছিলেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সফল অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সম্পাদনায় নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত একাধিক ছোটগল্প নানা কারণে আলোচিত হয়। ১৯৮৬/৮৭ সালের দিকে সাত ধোয়া শাড়ি অথবা নারী শিরোনামের একটি গল্পের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে।

দীর্ঘ ছয় মাস ধরে এ নিয়ে সম্পাদক বরাবর পাঠকের তীব্র প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে। সম্পাদক আনোয়ার হেসেইন মঞ্জু পর পর ছয়টি সংখ্যায় পাঠকের প্রতিবাদী চিঠি ছাপান। পরে লেখক ও সম্পাদকের ব্যাখ্যামূলক চিঠি ছাপার মাধ্যমে সেই পর্বের ইতি ঘটে। ওই সময় লেখক হিসাবে মুজতাহিদ ফারুকী অনেকটাই পরিচিতি অর্জন করেন। ওই ঘটনার প্রায় ৪০ বছর পর এখনও কোনও কোন পাঠকের সঙ্গে পরিচয় ঘটলে তারা ওই গল্পের কথা স্মরণ করেন। লেখক হিসাবে এটি এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা বটে।

পরে ১৯৯৫ সালে নতুন ঢাকা ডাইজেস্টে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘স্বপ্নের দেশে যতো যাই’। সেই প্রথম অনুষ্ঠানের ওপর দৈনিক বাংলায় ফিচার লিখেছিলেন তখনকারে সেরা ফিচার রাইটার হেদায়েত হোসেন মোরশেদ। ফিচারটি তিনি শুরু করেছিলেন প্রথম পুরস্কার পাওয়া নবীন লেখক মুজতাহিদ ফারুকীর গল্পের সূচনা অংশ দিয়ে।

৮০-র দশকের শেষ দিকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র তরুণ লেখকদের নিয়ে গল্পপাঠ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সেই প্রতিযোগিতায় দু’বার অংশ নিয়ে প্রথমবার প্রথম এবং দ্বিতীয়বার দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৯৯ সালে দৈনিক যুগান্তরে যোগ দেয়ার পর থেকে পরবর্তী ২০ বছর সৃজনশীল লেখালেখি প্রায় বন্ধ ছিলো। এটিকে বলা যায় সাহিত্য থেকে তার স্বেচ্ছা নির্বাসনের কাল।


২০১৯ সালের শেষদিকে আবার নতুন করে লেখালেখি শুরু করেন। এখন পর্যন্ত মূলত কবিতা এবং উপসম্পাদকীয় লিখছেন। গল্প বা উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছেন বলে চোখে পড়েনি। পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠানোর ব্যাপারে এক ধরণের অনীহা তার মধ্যে কাজ করে। তাই প্রচারণা থেকে তিনি পিছিয়ে। তবে গত দুই বছরে এফবিতে মুজতাহিদ ফারুকীর কবিতা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

আমার কবিতা, গল্প এবং ভ্রমণকাহিনীর কিছু অগ্রসর পাঠক ও সমালোচক রয়েছেন। যারা প্রায় নিয়মিত লেখাগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে পড়েন এবং মূল্যবান অভিমত ব্যক্ত করেন। কেউ কেউ টেলিফোনেও বিশ্লেষণ করেন। এমন একজন আবার মুজতাহিদ ফারুকীর কবিতার ভাল পাঠক।

ফারুকীর কবিতা পড়তে-পড়তে মনে হবে জনমানুষের হৃদয়ে পোষিত মনভাবনাকে সরাসরি তুলে এনেছেন। লেখার শৈলী বেশ সরস, সুন্দর। আমাদের সাহিত্যে এই রকম লেখা হবে, সেই আশায় অনেকের লেখা পড়েছি। সেটা সার্থক হয়েছে এত দিনে। আমার মত অন্য কেউ যদি তার কবিতার গভীরে যেতে চান, মুক্তা কুড়াতে পারেন। এত সুন্দর, এত নিখুঁত পঙক্তিমালা হৃদয়ে শিহরণ জাগায়, অন্তর আলোড়িত হয়।

২০১৯-২০ সালে ব্রেক্সিট নিয়ে কয়েকশত রিপোর্ট করেছি। জাতীয় দৈনিক মানব জমিনেই অর্ধশত হবে। তখন ব্রেক্সিট বিষয়ে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভনডার লেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রধান সমন্বয়ক মিশেল বার্ণিয়ার এবং তার যুক্তরাজ্যের প্রতিপক্ষ লর্ড ডেভিড ফ্রস্টের মধ্যে ব্রাসেলসে বা বৃটেনে যে আলোচনা হয় তা নিয়ে বিশেষ করে অমীমাংসিত বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে। শেষের দিকে বৃটেনের জল সীমায় ফিশিং অধিকার এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তথা যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়ীরা যাতে ন্যায্য সুবিধা পায় সে সম্পর্কে প্রায় প্রতি সপ্তাহে লিখেছি। সংশ্লিষ্ট সুত্রগুলোর সাথে নিয়মিত কথাও বলেছি।

একদিন দৈনিক নয়াদিগন্তে মুজতাহিদ ফারুকীর ‘ব্রেক্সিট : ইংরেজের অহমিকা রক্ষার মরিয়া চেষ্টা!’ শীর্ষক কলাম দেখে সাথে সাথে পড়ে নেই। লন্ডনে বসবাসকারী হিসেবে এই লেখার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হতে পারিনি। তবে ভাষার শৈলী ও তথ্যের সমাহারে লেখাটি যথার্থ মানোত্তীর্ণ ছিল। ২০০০ সালের জুলাই মাসে অন্য দিগন্তে ‘মুরাকামি ও প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন’ শিরোনামে আরেকটি লেখা আমাকে আকৃষ্ট করে। এরপর নয়াদিগন্তে আসামের ‘মিঞা কবিতা’ প্রতিরোধের নতুন আগুন, জলবায়ু সম্মেলন বিশ্বনেতাদের বার্ষিক পিকনিক! ইত্যাদি লেখা পড়ে চমৎকৃত হই। ফলে প্রায়ই তার লেখা পড়তে চেষ্টা করি। নয়াদিগন্তে প্রতি বুধবার উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। অসাধারণ তার সব কলাম। চলতি বছর সাহিত্য নিয়ে অনৈতিক বাণিজ্য শীরোনামের লেখাটি পড়ে তাকে নিয়ে লেখার আগ্রহ জাগে।

এখানে মুজতাহিদ ফাররুকীর কয়েকটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ তারিখ সহ উল্লেখ করলাম। আগ্রহী পাঠকেরা নয়াদিগন্তের আরকাইভ থেকে পড়ে নিতে পারেন। পর্যটন নিয়ে ঢনঢন (২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১), নতুন দল আসছে, কী আছে আশা করার (১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১), একটি গান পাল্টে দিচ্ছে পুরো দৃশ্যপট (০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১), তাদের ‘দায়মুক্তি’ দেয়াই উচিত (৩১ আগস্ট ২০২১), ফের ‘মুক্ত-স্বাধীন’ আফগানিস্তান! (১৭ আগস্ট ২০২১), রোবোটিক্স ও প্রযুক্তির নতুন বিপ্লব (১৩ জুলাই ২০২১), বিশ্বজুড়ে ইসলামী সঙ্গীত এবং আমরা (০৬ জুলাই ২০২১), রোহিঙ্গা ইস্যু ও মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকার (২৯ জুন ২০২১), করোনা-সতর্কতা কেন জরুরি (১১ মে ২০২১), খাদ্যাভাবে পড়বে না তো দেশ? (২০ এপ্রিল ২০২১), মার্কিন বিদেশনীতির অগ্রাধিকার ইরান (০২ মার্চ ২০২১), ধনীরা পালিয়ে যাক মঙ্গলে, পৃথিবী বাঁচুক (২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১), সাহিত্য নিয়ে অনৈতিক বাণিজ্য (০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১), মুরাকামি ও প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন (০৭ জুলাই ২০২০), কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার প্রতিষ্ঠা সহজ হবে না (১৬ জুন ২০২০), অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ (০২ জুন ২০২০), সর্বস্তরে বাংলার আশা ছেড়ে দেয়াই শ্রেয়! (১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০), বৈশ্বিক পরিচিতির জন্য অনুবাদের বিকল্প নেই (০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০), এক কিশোরী ও অশীতিপর নারীর যুগলবন্দী (২৪ ডিসেম্বর ২০১৯), জলবায়ু সম্মেলন বিশ্বনেতাদের বার্ষিক পিকনিক! (১৭ ডিসেম্বর ২০১৯), উইঘুর জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন (১৯ নভেম্বর ২০১৯), সামাজিক নর্মস শিখুন, স্মার্ট হোন (০১ অক্টোবর ২০১৯), সরল বিশ্বাস’ নিয়ে অস্বচ্ছতা, কিছু কথা (২৩ জুলাই ২০১৯), আসামের ‘মিঞা কবিতা’ প্রতিরোধের নতুন আগুন (১৬ জুলাই ২০১৯), ব্রেক্সিট : ইংরেজের অহমিকা রক্ষার মরিয়া চেষ্টা! (১৮ জুন ২০১৯)


 

মুজতাহিদ ফাররুকীর প্রকাশিত বই:

১. কখনও ব্যর্থতাকে (কাব্য): প্রকাশকাল- ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭। প্রকাশক: সাহিত্যের অন্যতম সেরা লিটল ম্যাগাজিন ঊষালোকে খ্যাত সম্পাদক মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ, অভিজন প্রকাশন, ৫৮, পশ্চিম মালীবাগ, ঢাকা-১৭। প্রচ্ছদ: হামিদুল ইসলাম। চার ফর্মার এই বইতে কবির প্রথম জীবনের মোট ৩৮টি কবিতা স্থান পায়।

২. ঝুলে আছে (গল্পগ্রন্থ): প্রকাশকাল- ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮। প্রকাশক: মজিবর রহমান খোকা, বিদ্যাপ্রকাশ, ৩৮/২-খ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০। প্রচ্ছদ: ওয়াকিল আহমদ। বইটির কোনও কপি নিজের কাছে সংরক্ষিত নেই। এতে কয়টি গল্প ছিলো এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।

৩. ২৫ বসন্তের হাওয়া: বাংলাদেশের ছোটগল্প সম্পাদনা (বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫তম বর্ষে দেশের গল্পকারদের গল্পের সংকলন); প্রকাশকাল- ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭। প্রকাশক: চৌধুরী আবদুস সালাম। অবগাহন প্রকাশনী, ৬৬, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা। এ বইতে ষোল জন গল্পকারের গল্প সংকলিত হয়। ক্রমানুসারে আতা সরকার- ল্যাম্পপোস্টের শেয়াল, হুমায়ূন আহমেদÑ আনন্দ-বেদনার কাব্য, হরিপদ দত্ত- কুকুর ও আকাশের চাঁদ, মঞ্জু সরকার- পুণ্যভূমি, সুশান্ত মজুমদার- রক্তমাংস, ইমদাদুল হক মিলন- নিরন্নের কাল, মঈনুল আহসান সাবের- ভুল বিকাশ, রেজোয়ান সিদ্দিকী- আড়াল, মাখরাজ খান- মানব, মুজতাহিদ ফারুকী- জীয়নখোলার জীবন-মৃত্যু অথবা দুধমাতা, তমিজউদ্দিন লোদী- প্রজন্মের দোলা, মোশাররফ হোসেন খান- ডুব সাঁতার, বুলবুল সরওয়ার- হিটলারের লাশ, সাবিনা মল্লিক- ফিরে চল সীমান্তে, নাজিব ওয়াদুদ- কারফিউ, ফকরুল চৌধুরী- শূন্যলোক।

৪. স্বপ্নের দেশে যতো যাই (প্রেমের উপন্যাস); প্রকাশকাল: ২০০৪। প্রকাশক: মজিবর রহমান খোকা। বিদ্যাপ্রকাশ, ৩৮/২-খ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০। প্রচ্ছদ: সমর মজুমদার। লেখকের ভূমিকা থেকে- ‘মিষ্টি একটি প্রেমের গল্প লিখতে চেয়েছি। হয়ে উঠেছে ত্রিভূজ প্রেমের নিরন্তর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে পীড়িত হৃদয়ের বেদনামথিত করুণ আর্তনাদ। দু চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে যাদের পথচলার শুরু বিরূপ পারিপার্শ্বিকতার চাপেতারা পিষ্ট, ক্লিষ্ট, পীড়িত। তবুও লালন করে দুর্মর স্বপ্ন। একটি সুন্দর সমৃদ্ধ দেশ, একটি স্বপ্নময় জীবনের অঙ্গীকার, একটি সংবেদনশীল হৃদয়ে নিশ্চিত আশ্রয়ের অন্বেষণ তাদের এগিয়ে নেয়। সংগ্রামে-সংগঠনে, উজ্জীবনে-অনুপ্রেরণায় স্বপ্নই প্রকৃত পঙ্খীরাজ। মাটির পৃথিবীর কাদাজলের পটভূমিতে কালস্রোতের যেসব অমোচনীয় চিহ্ন আঁকা হয়ে যায় তারও খন্ডিত স্থিরচিত্র মুদ্রিত হয় স্বপ্নেরপরতে পরতে। স্বপ্নের দেশে যতো যাই- সেই স্বপ্নিল ভালোবাসার চিরন্তন গল্প।

৫. নৈরাজ্যে একা (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক উপন্যাস); প্রকাশকাল- ফেব্রুয়ারি ২০০৮। প্রকাশক: মজিবর রহমান খোকা। বিদ্যাপ্রকাশ, ৩৮/২-খ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ। গ্রামের মোটামুটি স্বচ্ছল একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় একাত্তর সালে। বাবা-মার মৃত্যুর পর তাদের কিশোর সন্তান কিসমতের কাছ থেকে গায়ের জোরে সম্পত্তি দখল করে নেয় গ্রামের মাতব্বর। নিঃসঙ্গ ও ভাগ্যবঞ্চিত কিসমত ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে চলে আসে। এই কিশোর কিসমতের জবানিতে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের নানা টুকরো ঘটনার চিত্র। মুক্তিযোদ্ধা ও আলবদর রাজাকার উভয় পক্ষেরই বেশ কাছাকাছি এসেছে কিসমত। তাদের কর্মকান্ড চাক্ষুস করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির মত কিছু সাহসী ভূমিকাও পালন করেছে। কিন্তু সব হারিয়ে যেদিন শহরে আসে কিসমত তখন সে তিনদিনের উপোসী। শরীর হাড় জিরজিরে। পেটে ভীষণ ব্যথা। এক মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বাইরে কয়েকজন তরুণকে দেখে সে সাহায্যের হাত পাতে। কিন্তু তরুণরা তাকে ভিক্ষা দেবে না। তারা কাজ করে খাবার পরামর্শ দেয়।

এক তরুণ নিছক মজা করার ছলে কিসমতকে একটি কাজ দেয়। কাজটি হলো, দৌড়ে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে নিয়ে আবার দৌড়ে ফিরে আসতে হবে। যাওয়া এবং ফিরে আসার সময় দৌড়ের ওপরেই থাকতে হবে। থামলে চলবে না। এভাবে ২০টি ফুল এনে দিতে পারলে এর বিনিময় হিসাবে তাকে ২০০ টাকা দেয়া হবে। ক্ষুধার্ত, পেটে ব্যথা, জীর্ণ ভঙ্গুর শরীরে কিসমত তখন নড়ার অবস্থায়ও নেই। তবু সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। সে সম্মানজনক ভাবেই বাঁচতে চায়।

দৌড় শুরু হলে অনেকের কাছে একটি কৌতুককর দৃশ্যের অবতারণা হয়। রাস্তায় লোক দাঁড়িয়ে যায়। এই যে ভাতের জন্য ফুলের পেছনে ছোটা- এ এক প্রতীক হয়ে এসেছে উপন্যাসে। দৌড়ে ২০টি ফুল কিসমত ঠিকই নিয়ে আসে কিন্তু তখনই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তরুণেরা টাকা না দিয়েই পালিয়ে যায়। কিসমতের কিসমত থেকে দুর্ভাগ্যের মেঘ আর কাটে না। উপন্যাসে ফুলের জন্য কিসমতের দৌড়ের মধ্যে আধা চেতন, আধা অচেতন এক ঘোরের মধ্যে উঠে আসে একাত্তুরের ঘটনা-দুর্ঘটনা, চুয়াত্তুর সালের বিপর্যয়কর দুর্ভিক্ষ, এক মুঠো খাবারের জন্য সরকারি লঙ্গরখানায় মানুষের প্রাণপণ লড়াই, পথেঘাটে মৃত্যুর দৃশ্যাবলী।

মুজতাহিদ ফারুকী ১৯৫৯ সালের ২৭ মে জামালপুর জেলার সদর থানার তিতপল্লা ইউনিয়নের পশ্চিম পাড় দিঘুলী গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার পুরো নাম মুজতাহিদ বিল্লাহ ফারুকী। তবে লেখক নাম মুজতাহিদ ফারুকী হিসেবেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।

বাবা প্রিন্সিপাল আশরাফ ফারুকী। একজন ভাষা সৈনিক। ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার তমুদ্দুন মজলিসের অন্যতম নেতা এবং সংগঠনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিকের অন্যতম লেখক হিসেবে ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে নিরলস ভূমিকা রাখেন। পাকিস্তান সরকারের তথ্য বিভাগের প্রথম শ্রেণির চাকরি ছেড়ে দিয়ে শুধুই বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসার কারণে তিনি তমুদ্দুন মজলিসের সভাপতি প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের সঙ্গে ঢাকার মিরপুরে বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের দায়িত্বে থেকে মূলত তিনিই সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টায় কলেজটি গড়ে তোলেন।

আশরাফ ফারুকী ৫২-র ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুনো যে মিছিলে পুলিশ গুলি চালায় সেই মিছিলে শরিক ছিলেন। তার কানের পাশ দিয়ে গুরি চলে যায় বলে স্মৃতিচারণ তিনি করেছেন বহুবার। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী হিসাবে যে ক’জন ব্যক্তিকে স্বীকৃতি দেয়া হয় তিনি তাদের অন্যতম।

ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সৈনিক হিসাবে তিনি বাংলা একাডেমির প্রস্তাবক ও প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর উপর্যুপরি তিন বার একাডেমির পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। ঢাকার মিরপুরে প্রতিষ্ঠিত মিরপুর বাংলা কলেজেরও তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি জামালপুরের সরিষাবাড়ি কলেজসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

আশরাফ ফারুকী একজন সুলেখক হিসাবেও সুনাম ছিলো। তিনি দক্ষ অনুবাদকও বটে। লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফীর সবুজ বিপ্লব খ্যাত রাজনৈতিক দর্শনের ওপর তিনি বই লিখেছেন। তার অনূদিত কয়েকটি গ্রন্থের মধ্যে, মার্কিন গবেষক মেরী ও লরেন্স কে. ফ্রাঙ্ক-এর রচিত শিক্ষাপদ্ধতি বিষয়ক গ্রন্থ স্কুলে তারা মানুষ হোক (১৯৬৬), এবং ফরাসী ঐতিহাসিক চরিত্র জোয়ান অব আর্ক-এর জীবনী ভিত্তিক শিশুতোষ গ্রন্থ বীর কন্যে জোয়ান উল্লেখযোগ্য।

মুজতাহিদ ফারুকীর মাতা বেগম সুরাইয়া ফারুকী। জামালপুর জেলার অন্যতম জয়িতা, রত্নগর্ভা মা হিসাবে সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তার ভাইবোন হলেন ১. নাসরিন জাহান (অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা) ২. মুজতাহিদ বিল্লাহ ফারুকী ৩. মুয়াহ্হিদ বিল্লাহ ফারুকী (এনজিওকর্মী) ৪. মুজাহিদ বিল্লাহ ফারুকী (প্রিন্সিপাল, সরকারী আশেক মাহমুদ কলেজ, জামালপুর) ৫. মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী (অতিরিক্ত সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) ৬. ব্যারিস্টার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী (কমিশনার অব ট্যাক্সেস, এনবিআর, এবং ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, ২০২১-২০২২)। ৭. মুশাহিদ বিল্লাহ ফারুকী (অকালমৃত) ৮. মাজকুরা নাজনীন (ব্যাংকার) ৯. মুস্তানজিদ বিল্লাহ ফারুকী (ব্যবসায়ী)

মুজতাহিদ ফারুকীর স্ত্রী মাহমুদা আখতার অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। একমাত্র সন্তান মুস্তায়ান আবরার ফারুকী বেসরকারি খাতের আহছানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বস্ত্র প্রকৌশল বিষয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করে দেশের অন্যতম গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি হামিম গ্রুপে কর্মরত।

মুজতাহিদ ফারুকীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু মিরপুর ন্যাশনাল বাংলা স্কুলে। পরে জামালপুরের সরিষাবাড়ি থানায় আরামনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন। মাধ্যমিক শিক্ষা আরামনগর হাইস্কুল, কামালখান হাট হাইস্কুল এবং দিঘপাইত ধরণীকান্ত হাইস্কুলে। দিঘপাইত ধরণীকান্ত হাইস্কুল থেকে ১৯৭৫ সালে এসএসসি, ১৯৭৮ সালে দেওয়ানগঞ্জ কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ মাস্টার্স পাশ করেন ১৯৮৩ সালে।

কর্মজীবনে সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় লেখালেখির অভ্যাস বশে ১৯৮১ সালে সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা। ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দিলে ১৯৮৩ সালে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৯৯ সালে সিনিয়র রিপোর্টার হিসাবে দৈনিক যুগান্তরে ও ২০০৪ সালে দৈনিক নয়াদিগন্তে ফিচার এডিটর পদে যোগদেন। ২০০৬ সালে বৈশাখী টেলিভিশনের মাধ্যমে ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ায় পদার্পণ করেন। একই বছর চ্যানেল ওয়ানে নিউজ এডিটর হিসাবে যোগদান এবং কিছুদিন পরে দৈনিক আমার দেশ ও পরবর্তীতে দিগন্ত টেলিভিশনে দায়িত্ব পালন। বর্তমানে দৈনিক নয়াদিগন্তে সহকারী সম্পাদক ও সম্পাদকীয় বিভাগের নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করছেন।

মুজতাহিদ ফারুকীর কাব্যে ভাষা বৈচিত্র্য নিয়ে অন্যসময় বর্ধিত কলেবরে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা আছে। তবে সেটি বুঝতে হলে তার কবিতা পড়তে হবে। নির্লোভ ও সাদাসিধে জীবন যাপণে অভ্যস্ত লেখক মুজতাহিদ ফারুকীর জীবনবোধ ভীষণ গভীর। মানুষের জন্য তার মমত্ববোধ অসাধারণ। তাকে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রাখতে অনুরোধ করি। তার লেখা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাতে ছড়িয়ে পড়ে, সে ব্যাপারেও মনযোগ দিতে হবে। আমি প্রিয় কবি মুজতাহিদ ফারুকীর শতায়ু কামনা করি।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;