মিলটন সফির 'নিভৃতে নির্বাসনে" এক প্রেমের  কাব্য পরমাণু



নুরুল আমিন রোকন
মিলটন সফির 'নিভৃতে নির্বাসনে" এক প্রেমের  কাব্য পরমাণু

মিলটন সফির 'নিভৃতে নির্বাসনে" এক প্রেমের  কাব্য পরমাণু

  • Font increase
  • Font Decrease

 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিশাল জগতের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে কাব্যাঙ্গন। কাব্যাঙ্গনের বৃহদায়তনে এক নিভৃতচারী কবির নাম মিলটন সফি। কব্যভাব যাকে আবিষ্ট করে, আঁকড়ে ধরে, আকণ্ঠ ভাবজগতে নিমগ্ন করে, ভাব সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে তাড়িয়ে বেড়ালে রূপায়িত হয় কবিতা। ভাবকে তিনি আমন্ত্রণ জানান না। কবিতা ধরা দিলেই তিনি লিখেন। এটি তার তৃতীয কাব্যগ্রন্থ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয় ২০০৪ সালে। দ্বিতীয়টি পরের বছর। এরপর দীর্ঘ ১৫ বছর কবি হিসেবে কাব্যজগতের সূর্য কিংবা চন্দ্রলোকে দেখা নেই তার।

কবির ভাষায় " একটা সময় ছিলো যখন এক দুপুরে দশ-বারটা কবিতা লিখে ফেলতে পারতাম। এখন তা পারিনা। কবিতা আমাকে নির্বাসন দিয়েছে, তাই নিভৃতে নির্বাসনে কেটে যায় সময় অসময়। জীবন ও জীবিকার অর্থ -অনর্থ দাঁড় করাতে না করাতেই চলে যায় দিন-মাস-বছর, বড় অবহেলায়।

সুতরাং কেন তিনি নিভৃতে নির্বাসনে ছিলেন এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা কিংবা কারণ বিবৃত করার বাসনা পরিত্যাগ করাই সমীচীন হবে বলে মনে করি। কিংবা এর মীমাংসার দায়িত্ব পাঠকের জন্যেই থাকুক।

মূলতঃ প্রচার বিমুখ এই কবি মানুষ হিসেবে, মানবিক গুণাবলীতেও অনন্য সাধারণ।  পেশায় ব্যাংকার মিলটন সফির রয়েছে এক বড় গণযোগাযোগ জগৎ। সেবায় যেন তিনি সকলের। ভাবেন অনেক, বলেন খুব কম। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় সমসাময়িক কালে, সমগোত্রীয়দের মধ্যে তার জুড়ি নেই বলে আমার বিশ্বাস। কাব্যকলায় তার পাণ্ডিত্যের বিস্ফোরণ "নিভৃতে নির্বাসনে" উচ্চকিত। বিশেষ করে প্রেমের কবিতায় প্রকৃতিই তার অন্যতম প্রধান উপজীব্য বিষয়।

মিলটন সফির কবিতার প্রতিটি লাইনেই যেন বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর গভীরতা লক্ষণীয়। যা বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোট গল্পকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছিলেন। কবিতার ছোট্ট পরিসরের উদরে তার তুলনায় বিশালকায় ছোট গল্পের ভাববৈচিত্র্য সন্নিবেশিত করার মত আরও দুর্বোধ্য এবং দুর্গম পথে দুর্বার যাত্রায় তার অদম্য গতির সুস্পষ্ট সাক্ষ্য আলোচ্য ‘নিভৃতে নির্বাসনে’। 

বইটিতে সন্নিবেশিত কবিতাগুলো পাঠ করে প্রতিটি পাঠকেরই মনে হবে এর প্রায় প্রতিটি কবিতায়, প্রতিটি ছত্রে যেন তিনি এঁকেছেন সৌন্দর্যের এক একটি লীলাভূমি। আধুনিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতার যুগে, মহাজাগতিক কাল-পরিক্রমায়, দিব্য দৃষ্টিতে অবলোকন করলে মনে হতেও পারে মিলটন সফির প্রতিটি কবিতায় প্রতিটি লাইনেই যেন এক একটি কাব্য পরমাণু।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কাব্যাঙ্গনে নব্বইয়ের দশকে আবির্ভৃত হন কবি মিলটন সফি। কাব্যচর্চায় সিদ্ধহস্ত মিলটন সফি শুধু কবিই নন, বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল বিভাগেই তার রয়েছে কম-বেশী বিচরণ। লেখক হিসেবে সার্থকতাও রয়েছে সব ক্ষেত্রেই।

২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্র্রন্থ "কালোপুরুষ" দ্বিতীয় কাব্যগ্র্রন্থ "একটি স্বপ্নস্নাত নারীর জন্যে প্রার্থনা" প্রকাশিত হয় পরের বছরই। তারপর পনেরটি বছর স্বেচ্ছায় নির্বাসনে থাকার পর ২০২০ সালে আবার সগৌরবে, স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ। প্রকাশিত হয় ‘নিভৃতে নির্বাসনে’ বাংলার কাব্যাকাশে বিস্ফোরিত হয় এক কাব্য পরমাণু। ধুয়াকু-লীতে আচ্ছাদিত হয় চারদিক। কাব্যাকাশের সব উজ্জ্বল নক্ষত্র যেন আচ্ছাদিত হয় ধোয়ায়। দূরে-বহুদূরে, খালি চোখে আর দেখা নেই কারো। ক্ষাণিক পর ঠিক তার মধ্যভাগে, মিটমিট করে দৃষ্টি কাড়ে একটি নক্ষত্র, ক্রমেই ধুয়াকু-লী ভেদ করে অণুবিক্ষনে যেন জ্যোতি ছড়াতে থাকে, উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর দীপ্তিমান হয়ে উঠে উর্ধ্বাকাশের মধ্যভাগে লাল নীলে ‘নিভৃতে নির্বাসনে’

নিম্নে তার মিলটন সফি, যেন আরেক মহীরুহ'র আবির্ভাব। এটি তার তৃতীয কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থের সূচিতে তিনি সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন ৬৬ টি কবিতা। রয়েছে একটি মুখবন্ধ, উৎসর্গ এবং শেষে সংক্ষিপ্ত কবি পরিচিতি।

 প্রেম, প্রকৃতি, নারী, শ্রেণীসংগ্রাম, সমাজবাস্তবতাসহ নানাবিধ বিষয় তার কবিতার উপজীব্য  হলেও আলোচ্যে গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবিতায়  প্রেমের সুর অনুরণিত।

হৃদয়ে প্রেম থাকলে দৃষ্টিতে তা  বিচ্ছুরিত হয়, কোনো সৌন্দর্যই দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে না। একজন কবি যখন কাব্যভাবসমুদ্রে নিমগ্ন থাকেন, তখন তার নির্জলা প্রেমের দৃষ্টি অপরূপ সৌন্দর্যম-িত হয়ে উঠে। তখন তিনি যা অবলোকন করেন, তার প্রকৃত রূপ বর্ণনায় নিখুঁত পারদর্শী হয়ে উঠেন। খুঁজে পান স্রষ্টার সৃষ্টির প্রকৃত রূপ। এ প্রসঙ্গে কবির "পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর" এর কটি লাইন তুলে ধরা হলো -

 ‘আমি চোখ নামিয়ে ওর চোখের জলে

কদমের ছায়া দেখলাম এবং

 সেদিনই প্রথম বুঝেছিলাম -

মানুষের মুখের চেয়ে সুন্দর ফুল

পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর,।

এই যে চোখ নামিয়েই ওর চোখের জলে কদমের ছায়া দেখা এবং তা থেকে বুঝতে পারা, মানুষের মুখের চেয়ে সুন্দর ফুল পৃথিবীতে নেই আর। অর্থাৎ ছোট্ট একটি শিশুর মুখকে

 সুন্দর পৃথিবীতে এতসব প্রজাতির সুন্দর সুন্দর ফুল থাকতেও কবি বর্ষা ঋতুতে প্রস্ফুটিত কদমকে সবচেয়ে সুন্দর ভেবে কল্পলোকে এক শিশুর মুখে তা বসিয়ে দিয়ে শিশুর মুখকেই সবচেয়ে সুন্দর ফুল হিসেবে আবিষ্কার করেছেন।

 একথা মহাসত্য, ঐশীগ্র্রন্থ মহাপবিত্র আল কুরআনে সৃষ্টির সেরা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃত মানবজাতিকে নি:সন্দেহে সবচেয়ে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন মহান স্রষ্টা, আবার তার মধ্যে সেরাটাও মানুষের মুখ। কবি এখানে যথার্থই সুন্দরের সুন্দর উপমা হিসেবে এনে নিজের সৃষ্টি জগতের প্রতি প্রেম ও সৌন্দর্য প্রীতির সার্থক স্বাক্ষর রেখেছেন।

আবার একই কবিতার প্রথম স্তবকে তিনি লিখেছেন -

"বর্ষাই আমার প্রিয় ঋতু

তবু বর্ষাতেই বড় আনাড়ি হয় মন

যদি ধরে নিই, আকাশের একটা মন আছে

তবে নিশ্চিত, তার মনের সাথে

আমার মনের কোথায় যেন মিল আছে।

অর্থাৎ বাংলার ষড়ঋতুর মধ্যে বর্ষা, কবি, সাধক, ভাবুকদের কাছে যুগ যুগান্তরের আবেগের, সৌন্দর্যের চিরন্তন অনুভূতির সমুজ্জ্বল স্বাক্ষরবাহী এক মহীরুহ। এখানেও কবির আবেগাপ্লুত মন ও ভাবালুতার যথার্থই সার্থক রূপ ফুটে উঠেছে।

"সেই জামগাছটা নেই" কবিতার মধ্যভাগে তিনি লিখেছেন -

'পরদিন সকালে উঠে তুমি পেলে

একরাশ ঝরাফুল, আমাকে ভুলোনা বলে

ফুলগুলো নিঃশব্দে রেখে এসেছি

 তোমার দরজায়, তোমার পায়ের

স্পর্শে যে ফুল পেল সজ্জা

 সেটাও কিছু কম ছিলনা সেই সময়

অথবা-

'কোথাও বৃষ্টি ঝরছে কবিতায়

"মনে পড়লো তোমাকে বিদায়  জানিয়ে এসে

প্রচ- বৃষ্টিতে পেয়েছিল সেদিন

মনে হয়েছিল তুমি বৃষ্টি হয়ে এলে

আমার ধুসরতা ধুয়ে নিতে

আমি পরিপূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পণ

করলাম তোমার কাছে

বাঞ্ছিতকে মনে করে নিরবে, নিভৃতে, নিঃশব্দে, চুপিসারে দরজায় একরাশ ফুল রেখে আসা, যেন অলক্ষ্যে তার পদপিষ্টে হলেও স্পর্শ পায় ফুল, পায় সজ্জা। আর এই পাওয়ার মধ্যে কবি পরম পাওয়ার তৃপ্তি লাভ করতেন, যা এক সময় সেই জামগাছটার জন্যে পেতে চাইলেও পেতেন না।  তাই তিনি শেষাংশে লিখেছেন -

'তোমাদের জামগাছটা কেটে  ফেলেছো

শুনেছি, ঐ গাছটার জন্যে

কখনও তোমাকে প্রাণ ভরে দেখতে পেতাম না',

কবি মনের এই যে অভিব্যক্তি,  কাক্স্খিতকে না পাওয়ার বেদনার আর্তি, আর পাওয়ার চেষ্টায় গোপনে রেখে যাওয়া তার ফুলে অজ্ঞাতে চরণ স্পর্শটুকু নিয়ে ভাবনায়ও যেন  প্রশান্তি।

এই ভাবনা এবং এমন ভাবনা কোন সাধারণের নয়। বরং অসাধারণেরই হয়। তাইতো তিনি কবি। এখানেই নিহিত কবিত্ব শক্তি।

ঠিক এরই সম্পূরক কবিতা কবির ' কোথাও বৃষ্টি ঝরছে '

 সেখানে তিনি এক ঐকান্তিক অনুভূতিতে শিহরিত হয়েছেন প্রচন্ড বৃষ্টিতে। বলে উঠেছেন তোমার কাছে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করলাম। প্রিয়জনকে দূরে কিংবা কাছে বিদায় জানিয়ে সেই বিরহে যখন কাতর, তখনই প্রচন্ড বৃষ্টি পেয়েছে তাকে, এই বৃষ্টি প্রাকৃতিক ধারায় উর্ধ্বলোক থেকে পতিত কিংবা বিরহ কাতরতায় মনোজগতে বয়ে যাওয়া ঝড়ের তীব্রতায় অজান্তে দৃষ্টিতে ঝরা জল, যাকে তিনি ভেবে নিয়েছেন, তার প্রিয় ছেড়ে যায়নি দূরে কোথাও....

ফিরে এসেছে বৃষ্টি হয়ে তার মনের ধূসরতা ধুয়ে নিতে, অমনি তিনি তাতে সমর্পিত সম্পুর্ণভাবে।

এখানেই তিনি ব্যতিক্রম। তিনি যা দেখেন, তার গভীরে প্রবেশ করে তলদেশে অরক্ষিত মুক্তা সংগ্রহ করে উপলব্ধিতে বসান। তারপর তার নির্যাসটুকু অনুভূতিতে মিশিয়ে, চর্বিত-চর্বন করে, ভক্ষণ করে নির্যাসটুকু ঘটান কাব্যে, পাপ কিংবা পূণ্যে, প্রেম কিংবা দ্রোহে, মিলন কিংবা বিরহে, ফুল কিংবা কাটায়, মিষ্ট কিংবা কটুতায়, আবেগ কিংবা ভাবাবেগে পরিপূর্ণ করে। আঁধারের গভীরে প্রবেশ করে আলোক বর্তিকা আবিষ্কারে পারদর্শী, কঠিনতম কটুতায়ও পরম সুখের সন্ধান দেন, কন্টকাকীর্ণ পথে যোজন-যোজন দূরে মনৃণ পথের আবিষ্কারক, চরম তিক্ততা ভেদ করে পরম প্রেমের পরাগ, পূতিদুর্গন্ধময় নর্দমায় সুভাসিত ফুলের সুবাস আর প্রিয়জনের পদপিষ্ট হয়েও তার স্পর্শে ভালোবাসার অতৃপ্ত বাসনার পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভে পুলকিত হন। উল্লিখিত কবিতা দুটির উদ্ধৃত লাইন কটিতে তা সুস্পষ্টরূপে বিবৃত করতে যথার্থই পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এখানে তিনি পুরোপুরিই ‘রিয়ালিস্ট’। এই রিয়ালিজমই নি:সন্দেহে একজন সার্থক কবি হিসেবে মিলটন সফিকে তার যথার্থ স্থানে বসিয়ে দিয়েছে।

 এরপর "যে ফুলে মিলনের গন্ধ" কবিতার শেষ স্তবকে তিনি লিখেছেন -

"ঐ লম্বা দূরে, ঐতো ঐখানে

ডুবেছে আমার মিলনের তরী

নদী পথে পথ নেই জেনেও

তাকে আমি সমধিক ভালোবাসি।

যে নদীতে জল নেই, অন্তসার শূন্য

তার কষ্টকে আজ আমি

সমধিক উপলব্ধি করি"।

অর্থাৎ ভালোবাসা অমর, অক্ষয়, মরেনা কখনো। যদি তা প্রকৃত ভালোবাসা হয়। তাই কবি বলেছেন, যে নদীতে একদিন জল ছিল, ছিল জোয়ার, ঐ দূরে যেখানে তার মিলনের তরী নিমজ্জিত হয়েছে একদিন ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে। আজ সে নদীতে জল নেই, জোয়ারও নেই, শুধু ধূ-ধূ বালুচর, অন্তসার শূন্য। তারই কষ্ট আজ তাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়, তাকেই তিনি সমধিক ভালোবাসেন আজও। যে ফুলে মিলনের গন্ধ ছিল, কিন্তু আজ আর নেই, তাকেও তিনি ভালোবাসেন।

"বৃষ্টির কাছে পরাজিত আমি "কবিতার প্রথম স্তবকে তিনি বলেছেন -

"আকাশটা বেশ মেঘলা

বৃষ্টি হবে হবে মনে হচ্ছে

তব্ওু যেতে হবে যে করেই হোক

 কেননা আজ তুমি আসছো

 মেঘলা আকাশ, মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসবে, তবুও যেতে হবে গন্তব্যে, যেখানে তার প্রিয় কেউ আসছে আজ। সুতরাং কোনো বাধাই তাকে আটকে রাখতে পারে না।

আবার একই কবিতার শেষের দিকে বলেছেন,

"যে বৃষ্টি আসবে আসবে করেও

এলো না, তার জন্যেই ছিল প্রতিক্ষা

আর যে এসেও ফিরে গেলো

তার জন্যে ছিল না কোনই অপেক্ষা

এই যে অপেক্ষা এর কোন শেষ নেই। ভালোবেসে মানুষ অপেক্ষা করে তার প্রিয়জনের জন্যে। এই যে ভালোবাসা এটা নিখাদ, প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে তাই হয়। যদি তা একমুখী হয়, তাহলেও তা ভালোবাসাই হয়। তাতে হয়তো মিলনের সুখ থাকে না, বিরহের যন্ত্রণা থাকে এক পক্ষের, তবুও ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যায় না, উপরোক্ত চারটি লাইনের অন্তর্নিহিত ভাব বিশ্লেষণে একথাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। এরপর "তোমায় ভালোবেসে" কবিতার প্রথম ও শেষ পাঁচ চরণ-

"যতটুকু বৃষ্টি পড়ে

সমস্তটুকুই আমার শরীর

দৃশ্য - দৃশ্যান্তরে চোখ বন্ধ করে

পায়ে পা ফেলে সারিবদ্ধভাবে

এগিয়ে যায় অকারণ, তোমায় ভালোবেসে"।

ভালোবাসা কোনো কারণ কিংবা বারণ মানে না। এর উৎপত্তি এবং পরিনতি কখন, কোথায়, কিভাবে, কেউ তার নিশ্চিত কেন্দ্র নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছে, হচ্ছে, কিংবা হতে পারবে এমনটা কে বলতে পারে। কারণ প্রেম পবিত্র এবং স্বর্গীয় সুখের অনুভূতির নাম। কিভাবে বড় হয়, কোথায় এর শেষ, কি পরিনতি, কেউ তা আগে থেকে জানে না। তা উপলব্ধি করেই কবি বলেছেন "এগিয়ে যায় অকারণ, তোমায় ভালোবেসে"। শেষটায় ওই কথাই আসে, যেখান থেকে আসে প্রেম সেখানেই মিলিয়ে যায়। কবি মিলটন সফির কবিতার সাথে কিংবা তার সাথে কবিতার প্রেম সেই অলঙ্ঘনীয় সত্যের সাক্ষ্য। প্রেমের কবি হিসেবে তিনি এখানে পুরোপুরি সার্থক।

এরপর ‘পথেই বসে আছি’ কবিতায়

ধুপখোলায় পুড়তে দিয়েছি হৃদয়

লাল না হওয়া পর্যন্ত তা জ্বলতেই থাক

অথবা- ‘নিম ফুলের মতো ভালোবাসি কবিতায়

ভুলিনি আমার ভালোবাসায় তোমার নীরবতা

 তোমার বঞ্চিত মুখ আমার অযোগ্যতা

 জেনে গেছি আজ, তোমাকে ঠেকানোর চেয়ে

নিজেকে বঞ্চিত করা সহজ

ভালোবাসা এবং ত্যাগের মহিমায় বড় প্রেমের ঐশ্বর্য্যরে নির্জলা চিত্র এঁকেছেন। এখানে তিনি কাব্যভাবের গভীরতার মধ্যদিয়ে সেই অমিয় বাণীর অবতারণা করেছেন। "বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, কখনো কখনো দূরেও ঠেলে"। তিনি ছোট ছোট চরণে বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর গভীরতা এনে কবিতার এক একটি লাইনকে পরমাণু শক্তিতে পরিনত করেছেন, জ্ঞাতসারে কিংবা ভাব জগতে  নিমজ্জিত হয়ে অজ্ঞাতে কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে তার আধুনিক কবিত্ব শক্তির জোরে অত্যাধুনিক কাব্য পরমাণু।

এরপর তবু আমি ফিরবোই, ফাগুনের চিঠি, হৃদয় ভাঙ্গার গল্প, প্রার্থনায় নিমগ্ন আছি, সেদিনের জন্যেও অপেক্ষায় থাকবো, থেকে যায়, থেকে যেতে হয়, বোঝ বলেই বোঝ না, কেউ কি ভালোবেসেছে, পত্র দিও, কবে দেখবো তোমায়, আজও সকাল হলো না,  ইত্যাদি কবিতাগুলোর অন্তর্নিহিত ভাব কিংবা প্রতিটি চরণই প্রেমের কষ্টিপাথরের ছোঁয়ায় একেকটি প্রেম পরমাণুতে পরিনত হয়ে উঠেছে। তাই একজন সমালোচক তাকে বিশ্বখ্যাত রোমান্টিক কবি মিলটনের সাথে তুলনা করেছেন। আমি বলবো সেকালের মিলটনের চেয়ে একালের মিলটন সফির কবিতা প্রেমের কষ্টিপাথরে বিচারে অনেক বেশি শক্তির আধার। প্রেমের পরাগরেনু কিংবা কাব্য পরমাণু সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে, কিংবা বড় প্রেমের ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত বেদনা কিংবা পরম সুখের পংক্তিমালা গাঁথায়, কাছে টানা অথবা দূরে ঠেলার অমর  কাব্যবাণ নিক্ষেপের সুদক্ষ কারিগর হিসেবে কাব্যাকাশের বিশাল অঙ্গন জুড়ে রথী মহারথীদের সুবিন্যস্ত, সুরক্ষিত আসন সমূহের মধ্যভাগে ঝড়োগতিতে আবির্ভূত হয়ে স্বীয় আসনটিতে স্বমহিমায় আসীন হয়ে কাব্যাকাশের জ্যোতি বিকিরণের গতিতে সমৃদ্ধি আনয়নের মধ্যদিয়ে নিজের অনন্যসাধারণ কবি প্রতিভার সুউচ্চ মার্গ প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছেন। এখানে তার তুলনা তিনি নিজেই।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি।

মিলটন সফিকে মূলত প্রেমের কবি হিসেবে ধরে নিলেও, কিংবা প্রেম বিষয়ে তার কাব্যপিপাসা, ভাবগাম্ভীর্যের সাথে তার কাব্যভাবনার প্রকাশ এবং পংক্তিতে পংক্তিতে তার বিচ্ছুরণ তাকে প্রেমের কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠা দিলেও তিনি শুধুমাত্র এখানেই থেমে থাকেননি। তার কাব্যপ্রতিভা বহুমুখী ধারায় প্রবাহিত হয়েছে সতর্কতার সাথে। এমন বহু কবিতার তিনি রচয়িতা,  যেগুলো পাঠে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়  সমাজের হেন কোনো বিষয় নেই, যা তার দৃষ্টিকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, কিংবা এড়িয়ে গেছে। সমাজবাস্তবতার সব দিক নিয়ে তিনি লিখেছেন

বহু কবিতা, যা আমাদের এই সমাজেরই জলজ্যান্ত প্রতিচ্ছবি। এমন একটি কবিতা "বেঁচে থাকা ভালো" যার শেষাংশের দুটি স্তবক তুলে ধরলেই পাঠকমাত্রেরই ধারণা সুস্পষ্ট হতে পারে।

"হায়রে সংসার, কোথায় গেলো

আবুলের মায়

 নোলক দুলিয়ে দুলিয়ে

 যে কথা বলতো, বার বছর

বয়সে যে এসেছিলো ঘরে

 সে আজ পথেই সংসার পেতেছে

বিধাতার বিচার আছে, এক টুকরো জমির

বদলে পুরো জমিদারী

পুরো আকাশটা তার ঘরের ছাদ

আহা: বিধাতার বিচার আছে

এখানে কবি সুনিপুণভাবে এঁকেছেন আমাদের এই সমাজের চারপাশের বাস্তব চিত্র। যা আশপাশে তাকালেই দেখা যায়, বোঝা যায়। সমাজবাস্তবতা বা শ্রেণী বৈষম্যের প্রতিবিম্ব এতে সুস্পষ্ট। যে আবুলের মায় বার বছর বয়সে এসে ঘর বেধেছিল, সংসার পেতেছিল সুখের আশায়। শ্রেণীবৈষম্য আর সমাজপতিদের শোষণের শিকার আবুলের মা আজ পথেই পেতেছে সংসার।

 যে একদিন এক টুকরো জমি আর ছোট্ট একটি ছাদ চেয়ে নোলক দুলিয়ে দুলিয়ে কথা বলতো, তার ঘর আজ ফুটপাতে, খোলা আকাশের নীচে। যেন পুরো জমিদারীই তার। পুরো আকাশটাই তার ঘরের ছাদ। এই যে সর্বহারা মানুষের পাওয়া-না পাওয়ার, আশা-নিরাশার মাঝেও আশা জাগানিয়া শান্তনার বাণী কবিকণ্ঠে উচ্চারিত, এটা কেবল বড় কবির দৃষ্টিতেই দেখা সম্ভব। যিনি দুনিয়ার পুরো জমিদারীটাকেই এক জমিদারী হিসেবে দেখেন, তার দৃষ্টিতে যার প্রকৃত মালিক আবুলের মায়েরা।

“সূতোকাটা ঘুড়ি" কবিতায় লুকিয়ে আছে সৃষ্টি রহস্য। যা ভেদ করার সাধ্য কারো নেই, কবি কিংবা নবী। এখানে সবাই অসহায়, যে যেই পথেই আসুক সাধনায়, এক মোহনায় প্রচ- ঘূর্ণিপাকে এসে সবাই হারিয়ে যায় অদৃশ্য সুতোর টানে, আবার ফেরে সেই স্থানে। গোলাকার পৃথিবীতে। কবির ভাষায় -

"অমনি নিজেকে সুতোকাটা ঘুড়ি ভেবে

ভাসিয়ে দিয়েছি বাতাসের প্রবাহমানতায়, যখন -

খোলা মাঠের চৈতালী বাতাস আমাকে ডেকেছে

নীমফুল আর সোনালী স্বপ্ন মাতিয়েছে সারাবেলা

যখন নিজেকে পেয়েছি পরিপূর্ণ মুগ্ধতায়

তখনই কেউ নাটাইয়ের সুতো টানছে

তবে কি অদৃশ্য ঐ প্রান্তে কেউ একজন

রয়ে গেছে হায়!

 তোমার প্রয়োজনের কাছে

নিতান্ত ক্ষুদ্র এ অভিপ্রায়"।

এই যে রহস্যাবৃত্ত সৃষ্টি, চলছেতো চলছেই, আবার থমকে দাঁডাচ্ছে, শুরু থেকে শেষ এবং শেষের শেষটা থাকছে অজানা, এক অজানা বিশ্বাস। এই সীমারেখাই সৃষ্টি রহস্য বলে আমারও বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের বৃত্তে ঘুর্ণায়মান থেকে এতটুকু সময়ে যত সৃষ্টি দৃষ্টির সামনে কিংবা অন্তরালে, সেখানে কীর্তিমান কবি মিলটন সফি তার বিচিত্র সৃষ্টিতে।

সার্থক কবি মিলটন সফি। তার কবিতার বিষয়বস্তু নির্বাচনেও রয়েছে বৈচিত্র্য। তিনি একাধারে প্রেম, ভালোবাসার কবি। পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীবন-প্রকৃতি, অতিপ্রাকৃত, সমাজবাস্তবতা, শ্রেণিবৈষম্য, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিক দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন।

তবে তার সগৌরবে আবির্ভাব রোমান্টিক কবি হিসেবে।

দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত দৈনিক থেকে শুরু করে, সাপ্তাহিক, মাসিক, পাক্ষিক এবং সাহিত্য সাময়িকীতে তার বিচিত্রমুখী লেখা ছাপা হচ্ছে। তিনি কবিতা লেখার স্বপ্ন দেখেন না, তবে কবিতা তাকে যখন স্বপ্ন দেখায়, তখন তিনি তা রচনার মাধ্যমে মানুষকে স্বপ্ন দেখান। আবৃত্তি এবং গান রচনার মাধ্যমে মানুষকে তিনি সচেতন করেন, আলোকিত করেন। তিনি শুধু আবৃত্তি নয়, নির্দেশনা এবং গ্রন্থনাও করে থাকেন। তিনি সাহিত্যকর্মে বিশেষ সম্মাননা হিসেবে ২০১৮ সালে "পার্সন অব দ্য ইয়ার" এ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন।

ফরিদপুরের নগরকান্দা থানার কোদালিয়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে ১৯৮১ সালের ১১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন কবি মিলটন সফি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কাব্যাঙ্গনে বিরল প্রতিভার অধিকারী এই কবি, গীতিকার, বাচিকশিল্পী ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে। তারপর দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্র্যান্ড এন্ড কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আলোচ্য গ্রন্থের শেষের দিকের দুটো কবিতার আগে রয়েছে শিরোনামের কবিতা "নিভৃতে নির্বাসনে" যার প্রথম দুটি স্তবকে লিখেছেন -

"চোখের জলে গল্প লিখি তোমার

নিজেকে ক্রুশবিদ্ধ করার

সমস্ত আয়োজন শেষ

নিজের পায়ে নিজেই ঠুকেছি

বিশ্বস্ত পেরেক, যেন তোমার থেকে পালিয়ে না যাই।

আগাম ভোরের বিশ্বস্ত আয়োজনে

তুমি কিন্তু এসো!

 তোমাকে ঘিরেই এ আয়োজন

 তোমাকে কাঁদাবো বলেই হয়ত

আজ এ সুখের নির্বাসন

কেন কবি নির্বাসনে গেলেন, দীর্ঘ ১৫ টি বছর পর কাব্যাঙ্গনে আবার কেন, কিভাবে, কি কারণে ফিরে এলেন তা খুঁজে নিতে হবে পাঠককেই, তার এই গ্রন্থের প্রচ্ছদের প্রথম ভাজের ভূমিকা কিংবা ভেতরে সন্নিবেশিত কবিতা, নামকরণের কবিতা বিশ্লেষণে।

পরিশেষে বলা যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিশাল কাব্যাকাশে "নিভৃতে নির্বাসনে" কাব্যগ্রন্থের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কবিতাগুলো পাঠে যে কোনো কবিতা প্রেমিক মনযোগী পাঠকই নি:সন্দেহে এবং নি:সংকোচে বলবেন কি বিষয় নির্বাচন, কি ভাবের অবতারণা, কি চরণ বিন্যাস, কি শব্দ এবং উপমা অলংকার ব্যবহারে প্রায় প্রতিটি কবিতাই হয়ে উঠেছে সার্থক  ও এক একটি কাব্যপরমাণু। চারু পিন্টুর আকা প্রচ্ছদ এবং আককাস মাহমুদ এর আলোকচিত্র চমকপ্রদ। সাদা কাগজে ঝকঝকে-তকতকে ছাপা, সুন্দর বোর্ড বাঁধাই ৭৮ পৃষ্ঠা বইয়ের তুলনায় ১৭৫ টাকা মূল্য খুব বেশী নয়। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে সুন্দর এই প্রকাশনার জন্যে শিখা প্রকাশনীর প্রকাশক নজরুল ইসলাম (বাহার) কে ধন্যবাদ না দিলেই নয়। বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;